এগোচ্ছে বিধানসভার অধিবেশন
অর্ডিন্যান্স নয়, সিঙ্গুরের জমি ফেরাতে আসছে বিল
র্ডিন্যান্স নয়, সিঙ্গুরের জমি ফেরাতে নতুন বিলই আনছে রাজ্য সরকার। সেই জন্য রাজ্য বিধানসভার অধিবেশনও এগিয়ে আনা হচ্ছে। আগে ঠিক ছিল, ওই অধিবেশন বসবে ২৪ জুন। ‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতিতে তা বসছে আগামী সোমবার, ১৩ জুন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছিলেন, অর্ডিন্যান্স জারি করে সিঙ্গুরের হাজার একর জমিই নিয়ে নিচ্ছে সরকার। রাজ্যপাল ওই দিন অর্ডিন্যান্স সই করেছেন বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। ওই ঘোষণায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় বিরোধী শিবিরে। বিরোধীরা অভিযোগ করেন, বিধানসভা চালু থাকা অবস্থায় সভাকে এড়িয়ে ওই অর্ডিন্যান্স করা হয়েছে। ওই কাজ ‘সংবিধান-বিরোধী’।
শুক্রবারই অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, অর্ডিন্যান্স নয়। সিঙ্গুরের জমি ফেরাতে আগামী মঙ্গলবার বিধানসভায় পুরোদস্তুর বিল আনা হচ্ছে। তাঁর কথায়, “অর্ডিন্যান্স আনছি না। কিন্তু আমরা দেরি করব না। সিঙ্গুরের মানুষেরা খুব কষ্টে রয়েছেন। আগামী ১৩ তারিখ বিধানসভা শুরু হচ্ছে। পরের দিনই রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে একমাত্র সিঙ্গুরের জমি ফেরতের ওই বিলটি আনছি।” প্রশাসনিক সূত্রের খবর, অর্ডিন্যান্সটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সিঙ্গুরের বিষয়ে তিনি কোনও ‘আপস’ করতে নারাজ। বস্তুত, প্রশাসনের একাংশের তরফে সিঙ্গুরের জমি সংক্রান্ত বিলের সঙ্গেই আসন্ন অধিবেশনে আরও কিছু বিল আনার একটা প্রচেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সর্বাগ্রে সিঙ্গুর। বাকি সব পরে হবে!
সরকারি সূত্রে খবর, সোমবার বিধানসভার অধিবেশন শুরু হবে প্রথামাফিক রাজ্যপালের বক্তৃতা দিয়ে। পর দিন, মঙ্গলবার শুধুমাত্র সিঙ্গুরের জমি ফেরানো নিয়ে ওই নতুন বিলটি আসার কথা। মুখ্যমন্ত্রী এদিন বলেন, “১৩ মে ভোটের ফল বেরিয়েছিল। তার ঠিক এক মাস পর, ১৩ জুন বিধানসভা শুরু হচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের ভাল দিক। আমরা রাজ্যপালের বক্তৃতার পর সিঙ্গুরের জমি ফেরত দেওয়ার বিলটি পেশ করব।” মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে বলা হয়েছে, সিপিএম যে ভাবে দাবি করছে, অধিবেশন ‘চালু’ রয়েছে, তা ঠিক নয়। বস্তুত, তৃণমূলের আইনজীবী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন ১৯৬৭ সালে রাজস্থান হাইকোর্টের একটি রায়ের দৃষ্টান্ত তুলে বলেন, “ওই রায়ে বলা হয়েছে যে, নতুন বিধানসভা গঠিত হলে তার প্রথম অধিবেশন শুরু হয় রাজ্যপালের বক্তৃতা দিয়ে। এ ক্ষেত্রে রাজ্যপালের বক্তৃতা হয়নি। ফলে স্পিকার নির্বাচনের জন্য বিধানসভার ওই অধিবেশন স্বভাবতই শেষ হয়ে গিয়েছে। অধিবেশন মুলতুবি বলা হচ্ছে কেন?”
সিঙ্গুরে উচ্ছ্বাস জনতার। শুক্রবার প্রকাশ পালের তোলা ছবি।
তবে অর্ডিন্যান্স না-আনলেও আপাতত সরকার নিশ্চিত যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফলে তারা বিনা-বাধায় বিলটি বিধানসভায় পাস করিয়ে নিতে পারবে। বস্তুত, এ দিনই তৃণমূলের সমস্ত বিধায়ককে সোম এবং মঙ্গলবার সভায় আসার ব্যাপারে জরুরি নির্দেশ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে কংগ্রেসকেও। এরই পাশাপাশি, বামফ্রন্টের শরিক দলের নেতাদের সঙ্গেও তৃণমূলের তরফে যোগাযোগ করা হবে। দলের এক নেতার কথায়, “শরিক নেতারা তো সিঙ্গুরের জমি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্তকে বৃহস্পতিবারই স্বাগত জানিয়েছেন। আমরা চাই, বিলটি তাঁরাও সমর্থন করুন। সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকরা জমি ফিরে পান।” প্রসঙ্গত, প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের নেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও কিন্তু জমি ফেরানোর বিষয়ে কোনও ‘আপত্তি’র কথা জানাননি। বস্তুত, সিঙ্গুরের জমি ফেরত নিয়ে রাজ্যের প্রাক্তন ভূমিসংস্কার মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার আগের বলা বক্তব্যের সঙ্গে দলের নীতির কোনও বিরোধ নেই জানিয়ে সূর্যবাবুর দাবি, “রেজ্জাক সাহেব যা বলেছেন আমরাও তা-ই বলছি। বাধা না থাকলে সরকার ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে দিতেই পারে। কিন্তু বাধা রয়েছে বলেই না আইন সংশোধনের প্রশ্ন আসছে।”
বৃহস্পতিবার সিঙ্গুরের অর্ডিন্যান্স-এর কথা মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করার পর রাতেই ওই বিষয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। সাধারণ ভাবে রাজ্যপালের সইয়ের পরেই অর্ডিন্যান্স জারি করার সরকারি নির্দেশিকা জারি করা হয়। কিন্তু সিপিএমের প্রতিক্রিয়ার পর এই নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং মুখ্যসচিব সমর ঘোষের পৃথক ভাবে কথা হয়। রাতেই দলীয় মহলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রীও। তখনই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, দরকারে বিধানসভার অধিবেশন এগিয়ে আনা হবে। যা থেকে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল যে, সিঙ্গুরের জমি ফেরত দেওয়ার বিষয়টি থেকে কোনওমতেই পিছু হটবেন না মমতা।
তবে ‘পদ্ধতিগত আপত্তি তুলে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে হায়দরাবাদ রওনা হওয়ার আগে এদিন রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করেন সূর্যবাবুও। ভোটের পরে রাজ্যে ‘হিংসাত্মক ঘটনা’ বন্ধ করার দাবির পাশাপাশি তিনি রাজ্যপালের কাছে সিঙ্গুর নিয়ে সরকারের অর্ডিন্যান্স জারির ‘পদ্ধতি’র প্রতিবাদও জানান। রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে সূর্যবাবু স্পষ্ট বলেন, “সিঙ্গুরের জমি ‘অনিচ্ছুকদের’ ফেরত দেওয়া হবে বলে সরকার জানিয়েছে। এটা নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। মানুষ যা চাইছেন তা অন্ধ ভাবে বিরোধিতা করতে আমরা চাই না। কিন্তু যে পদ্ধতিতে সরকার এটা করতে চাইছে, আমরা তার বিরোধিতা করছি।”
বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক বিধানসভায় যান। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও মহাকরণে একপ্রস্ত আলোচনা করেন মলয়বাবু ও কল্যাণবাবু। সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, অর্ডিন্যান্স নয়। সিঙ্গুরের জমি ফেরত দিতে বিধানসভায় বিল আনা হচ্ছে। অর্ডিন্যান্স বাতিল করার ব্যাখ্যা দিয়ে সরকারের এক মুখপাত্র জানান, সংবিধানের ২১৩ ধারার ২ উপধারায় বলা আছে, রাজ্যপাল চাইলে যে কোনও মুহূর্তে অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করতে পারেন। সেইমতো এ দিন অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
রাজ্য বিধানসভার সচিব যাদবলাল চক্রবর্তী এ দিন বলেন, “বিধানসভার অধিবেশন এখন মুলতুবি আছে। সেই মুলতুবি অধিবেশন এগিয়ে আনা হচ্ছে। এটা করার ক্ষমতা স্পিকারের আছে।” অধিবেশন এগিয়ে আসায় এ দিন বিকেল থেকেই বিধায়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে সচিব জানান। অধিবেশন শুরুর দিন এগিয়ে আসায় প্রচণ্ড ব্যস্ততায় ছিলেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয়টি নিয়ে তিনি বেশ কয়েক দফায় পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অধিবেশন শুরুর আগে স্পিকার যে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন, এ বার তা কি হবে না? সচিব বলেন, “সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা একটা প্রথা। এটা কোনও নিয়ম বা আইনের মধ্যে পড়ে না।”
মহাকরণের খবর, ১৩ জুন, সোমবার রাজ্যপালের বক্তৃতার পরে সভা মুলতুবি হয়ে যাবে। প্রথা অনুযায়ী, রাজ্যপালের বক্তৃতার পরে অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন শোকপ্রস্তাব পাঠ করে অধিবেশন মুলতুবি হয়ে যায়। তার পরের তিন দিন রাজ্যপালের বক্তৃতার উপর আলোচনা হয়। এর পরে সরকারি কাজকর্ম শুরু হয়। নতুন অধিবেশনে রাজ্যপালের বক্তৃতার পরদিনই সিঙ্গুরের বিল নিয়ে আলোচনা হবে বলে ঠিক হয়েছে। সোমবার অধিবেশন শুরুর কথা বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুকে জানিয়ে দিয়েছেন সংসদীয় মন্ত্রী পার্থবাবু।
শিল্পমন্ত্রী হিসেবে পার্থবাবু জানান, নতুন সরকারের মূল লক্ষ্য সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জমি ফেরত দেওয়া। তাঁর কথায়, “একটা প্রতিষ্ঠান কারখানা করার জন্য জমি নিয়েছিল। কিন্তু তারা তা করেনি। জমিটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল। ওই শিল্পসংস্থা যখন জানাল যে ওই জমিতে বিনিয়োগ করতে গিয়ে তাদের তহবিলে টান পড়েছে, তখন আমরা তাদের ক্ষতিপূরণের প্রস্তাবও দিয়েছি।” তাঁর আরও বক্তব্য, “এর আগেও সভার অনুমতি না নিয়ে ও রাজ্যপালের সই ছাড়াই বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী অনাদি সাহু বা মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়রা সভায় বিল পেশ করেছিলেন।” নতুন সরকারের অর্ডিন্যান্স জারি করাকে কেন্দ্র করে সিপিএম রাজনীতি করছে এবং সেই রাজনীতির ‘ইন্ধন’ জোগাচ্ছেন বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম বলেও পার্থবাবু অভিযোগ করেন।
প্রসঙ্গত, সিঙ্গুরের জমি ফেরত প্রসঙ্গে রাজ্য সরকার এখনও তাদের কিছু জানায়নি বলে দাবি করেছে টাটা মোটরস। এ দিনও সংস্থার তরফে বলা হয়েছে, জমি ফেরত নিয়ে নতুন সরকার কী অর্ডিন্যান্স জারি করছে বা বিল আনছে, তা না দেখে কোনও মন্তব্যই করা হবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পরে এ দিন টাটা মোটরস রাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। শিল্প দফতর, শিল্পোন্নয়ন নিগমের সঙ্গেও যোগাযোগ করে তারা এ ব্যাপারে রাজ্যের পরিকল্পনা জানার চেষ্টা করে। কিন্তু সংস্থার এক উচ্চপদস্থ কর্তার দাবি, তাঁরা কিছুই জানতে পারেননি। তবে সহযোগী যন্ত্রাংশ শিল্পকে (ভেন্ডার) আপাতত এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে বা কথা বলতে কারণ করেছে টাটা মোটরস। জমি ফেরত চেয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন সহযোগী যন্ত্রাংশ শিল্প সংস্থাকে ডেকেছিল শিল্পোন্নয়ন নিগম। কিন্তু সংস্থাগুলি জানিয়ে দেয়, এ ব্যাপারে তারা একা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। টাটা মোটরসের ইচ্ছেতেই তারা ওই প্রকল্প এলাকায় জমি নিয়েছিল। টাটা মোটরসও এ দিন সহযোগী যন্ত্রাংশ শিল্পগুলিকে জানিয়েছে, কেউ যেন একক ভাবে কোনও সিদ্ধান্ত না নেয়।

অভিজ্ঞ চোখে
হাসিম আব্দুল হালিম,
• অধিবেশন চালু থাকলে অর্ডিন্যান্স আনা যায় না।
• অর্ডিন্যান্সে মন্ত্রিসভার অনুমোদন বাধ্যতামূলক।
• রাজ্যপালের স্বাক্ষর হয়ে গেলেই তা কার্যকর হয়।
• গেজেট নোটিফিকেশন কবে হল তা বিচার্য নয়।
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়,

• অর্ডিন্যান্স সংশোধন করার ব্যবস্থাও আছে।
• বিধানসভায় সেটি বিল আকারে পেশ করতে হবে।
• অর্ডিন্যান্স জারির আইনি ত্রুটি স্বীকার করতে হবে।
• ত্রুটি স্বীকারের অংশটি বিলের অন্তর্গত হবে না।

বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়,
• সম্ভবত বিরোধীরা এই নিয়ে আলোচনা চান।
• সরকার অর্ডিন্যান্সের বদলে বিল আনছে তাই।
• অধিবেশন চলার সময় অর্ডিন্যান্স জারি করা যায়।
• তবে অত্যন্ত জরুরি পরিস্থিতি হলে তবেই।
Previous Story South Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.