|
|
|
|
আমার শিলিগুড়ি |
|
সবুজ ফেরাতে
জোট বাঁধুক শহর সুশীল রাহা |
|
শৈশব থেকে প্রাচীনত্বে পৌঁছে গিয়েছি এই শিলিগুড়ি শহরে। যে দিন বাবা-মায়ের হাত ধরে দুই ভাই সমেত দার্জিলিং মেলে টাউন স্টেশনে নেমেছিলাম সেটা ১৯৩২ সালের প্রথম দিক। আশিটা বছর পার হতে চলল। শৈশব থেকে জীবনের প্রাচীনত্বে পৌঁছে গিয়েছি। বয়সের সঙ্গে আমার পছন্দের তালিকাও বেড়েছে। অপছন্দের তালিকাও।
টাউন স্টেশন আমার বিশেষ পছন্দের তালিকায় ছিল। কত রকমের মানুষ যে আসত। শ্বেত, পীত, কৃষ্ণকায়, দেশের সব প্রান্তের বিশিষ্ট মানুষেরা। একপাশে ইবিআরের গাড়ি থেকে নেমে অন্য প্রান্তের ডিএইচআরের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে টয় ট্রেন, দার্জিলিং মেলে চড়া। মরসুমের সময়ে ডিএইচআর বগি জুড়ে চার ভাগে টয় ট্রেন পাহাড়ে রওনা করানো হত। সে সব বিশেষ দিনে প্ল্যাটফর্ম জুড়ে খুশির পরিবেশ তৈরি হত। এমন কাণ্ড আমি অনেকবার দেখেছি।এ ছাড়া কিছু যাত্রী ওভারব্রিজ দিয়ে ‘কার স্ট্যান্ডে’ গিয়ে গাড়ি রিজার্ভ করে রওনা হতেন। একটা অনেক লম্বা এবং উঁচু ওভার ব্রিজ যাত্রী কিংবা সাধারণ মানুষকে মহাবীরস্থানে পৌঁছে দিত। এসডিএমও-র বাংলোর সামনে থেকে এসডিওর বাংলোর দিকে বাঁক নেওয়া বজরি বিছানো রাস্তা পর্যন্ত অনেকগুলি বড় বড় গাছ ছিল। তার মধ্যে ৯-১০টি ছিল গগনভেদী মহীরুহ। কয়েকটা শিরিষ গাছ সমস্ত এলাকা ঘন ছায়ায় ঢেকে রাখত। ওই উঁচু গাছগুলির মাথা অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো ছিল। সেখানে বহু সংখ্যক শকুনের বাস ছিল। হাসপাতাল রোড, হিলকার্ট রোড জুড়ে শকুনের সাদা বিষ্ঠা দিয়ে সব সময়ে আঁকিবুকি দেওয়া থাকত। শকুন এখন আমাদের শিলিগুড়ি থেকে প্রায় অদৃশ্য।
কালিম্পং রেল লাইনের পূর্ব দিকে ডিএইচ লোকো শেডের পূবে খেলার মাঠ। হাসপাতাল রোড থেকে উত্তরে স্টেডিয়াম পর্যন্ত ছড়ানো। তিনটি পূর্ণ মাপের ফুটবল মাঠ। যা ছিল শহরের মানুষের খেলাধুলার জায়গা। শিলিগুড়ির সব বয়সের মানুষ এখানে আসতেন। মাঠের পূব দিকে এসডিও-র তিন বাংলো। ইউনিয়ন রোড আর ফিশারিজ। তার পরেই উদোম কৃষিক্ষেত্র আর অসংখ্য বাঁশঝাড়। দূরে একটি, দুটি গ্রামের কুটির নজরে পড়ত। সব শেষে দিগন্ত ছুটে থাকা বৈকুণ্ঠপুর অরণ্য। আমাদের কাঠের দোতালা বাড়ির বারান্দা থেকে ওই তেপান্তরের মাঠের দিকে চেয়ে বসে থেকেছি কত দিন। শীতের শেষে অরণ্যের দাবানলের সঙ্গে বইত প্রবল বাতাস। ভয় হত, বোধহয় পুরো অরণ্যই জ্বালিয়ে দেবে। পর দিন সকালে উঠে দেখেছি, সব কিছু অন্য দিনের মতোই স্বাভাবিক।
একটু দূরেই রোড স্টেশন। এখান থেকে হিলকার্ট রোড উত্তর দিকে ঘুরে গেল। রোড স্টেশন জংশনের বা দিক হিলকার্ট রোড। ডানদিক দিয়ে ডিএইচআরের লাইন চলে গেল। যার শেষ স্টেশন দার্জিলিং। ডান দিক দিয়ে গেল কালিম্পং লাইন। যে লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে তৈরি করা হয় বিধান রোড। হিলকার্ট রোড ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললে হিমালয়ের নৈসর্গিক শোভা দেখা যায়। মহানন্দার দু-পাড় ছিল বিস্তীর্ণ ঝকঝকে পাথরে বোঝাই। ছুটির দিনে ছোটরা মহানন্দার বুকে আনন্দে মেতে উঠত। বর্ষায় ফুলে ওঠা নদীর গর্জন ক্ষুদিরামপল্লির বাড়িতে বসেই শোনা যেত। ভোর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বর্ণনার অতীত সে সব দৃশ্য।
১৯৪৮ সাল থেকে শিলিগুড়িতে লোক সমাগম বাড়তে থাকে। সব ফাঁকা জায়গা ভরে যেতে থাকে। শিলিগুড়ি আমার কাছে অচেনা হয়ে যেতে থাকে। যে শিলিগুড়িতে রাজনৈতিক জীবনে ঘনিষ্ঠ ছিলাম কমিউনিস্ট পার্টির উদ্বোধনের দিন থেকে। সেই রাজনৈতিক জীবন থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছি অনেকদিন। পথে বেরোলে বিশেষ চেনা মুখ আর দেখতে পাই না। ব্যস্ত রাস্তায় দেখি স্কুটার, বাইক, অটো ও গাড়ির ব্যস্ততা। সাইকেল আরোহী আর পথচারীরা আরও অবহেলিত, কোণঠাসাও!
প্রতিটি ট্রাফিক কনট্রোলে দীর্ঘ সময় ধরে যানজট। তা কী ভাবে ঠিক করা যায় সে দিকে নজর দেওয়া দরকার। শহর জুড়ে যথেচ্ছ গতিরোধক রয়েছে। সেগুলি কেটে রাস্তা মসৃণ করতে হবে। প্রায় ২০ বছর আগে শহরের রিকশার স্প্রিং অকেজো করে দেওয়া হয়েছিল ‘বাম্প’-এর কারণ দেখিয়ে। এখন লোহার রড ওয়েল্ডিং করে লাগানো থাকে। বাম্প আর রিক্শার যুগপৎ আঘাতে রিকশা আরোহীর শিরদাঁড়ায় চোট লাগে। ডাক্তারদের কাছ থেকে যা শুনি তাতে শিলিগুড়ির বেশির ভাগ মানুষ ‘স্পন্ডেলাইটিসের’ শিকার। তা হলে রিকশার স্প্রিং ফেরানো বাধ্যতামূলক হবে না কেন?
আরও কিছু বিষয় গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। ভাঙা স্ল্যাব বদলে ফুটপাতগুলিকে চলাচলের উপযুক্ত করতে হবে। সঙ্কীর্ণ বাজার এলাকায় মেলা হলে যান নিয়ন্ত্রণ আরও ভাল করে করা জরুরি। ব্যস্ত রাজপথগুলির উপর দিয়ে আরও ফ্লাইওভার করা ছাড়া উপায় নেই। সে জন্য এখনই পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি। শিশুরা ছোটাছুটি করে খেলা করতে পারে এমন ছোট ছোট পার্ক তৈরি হওয়া জরুরি। প্রতিটি পাড়ায়। প্রতিটি ওয়ার্ডে এটা দরকার। নিকাশি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা। শহরকে জঞ্জালমুক্ত করলে মশার হাত থেকে কিছুটা রেহাই মিলতে পারে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য হোম গড়ে তুলতে হবে। সেখানে যাতে অনেকটা ফাঁকা জায়গা থাকে। এটার প্রয়োজনীয় বাড়ছে ও বাড়তেই থাকবে। শহর এবং লাগোয়া এলাকায় সবুজ হারিয়ে যাওয়াটা আমাদেরই বন্ধ করতে হবে। সে জন্য সংগঠিত একটা প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ‘আমার শিলিগুড়ির’ জন্য শহরের সব স্তরের মানুষের এগিয়ে আসা ভীষণ জরুরি। |
|
|
|
|
|