‘জরিমানা’ না দিলেই হামলা জেলায় জেলায়
‘পরিবর্তনের’ বাজারে এখন রমরমা ‘জরিমানা’ নেওয়ার। কোথাও ‘জরিমানা’ কার্যত ‘তোলাবাজি’র নামান্তর বলেও অভিযোগ উঠছে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙুল উঠছে রাজ্যের অন্যতম নব্য শাসক দল তৃণমূলের দিকে। কিন্তু সব অভিযোগ থানা পর্যন্ত না গড়ানোয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গিয়ে অসুবিধায় পড়ছে পুলিশ-প্রশাসন।
রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার এই ‘অস্বাভাবিক’ পরিস্থিতি যে তাঁর অজানা নয়, বৃহস্পতিবার কার্যত সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘ দিন ধরেই তৃণমূল নেত্রী রাজ্যবাসীকে আইন হাতে তুলে না নিতে আবেদন জানাচ্ছেন। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের প্রতিও তাঁর একই বার্তা রয়েছে। এ দিনও মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছেন, অন্যায় দেখলে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার মুখ বুজে থাকবে না। বলেছেন, “অন্যায় করা এবং অন্যায় সহ্য করা- দু’টোই সমান অপরাধ।”
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তা যে সর্বত্র পৌঁছচ্ছে না সে উদাহরণও রয়েছে। এ দিন সকালে হুগলির গোঘাট থানা এলাকার শ্যামবাজারে ক্ষুদিরাম সেন নামে এক ব্যবসায়ীর দোকানে লুঠপাট হয়। মারধর করা হয় তাঁকে। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, ২০০৬-এ তিন তৃণমূল সমর্থককে খুনের ঘটনার সঙ্গে এ দিনের লুঠপাটের যোগ আছে। লুঠপাটে অভিযোগের তিরও তৃণমূলের দিকেই।
২০০৬-এ বদনগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের কাছে ক্ষুদিরামবাবুকে জখম করে তাঁর টাকা ছিনতাই করা হয়। ওই দিনই ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে লালপুর গ্রামের তিন তৃণমূল সমর্থকের উপরে চড়াও হয় কিছু লোক। গণপিটুনিতে মারা যান ওই তিন জন। সে সময়ে অভিযুক্ত ছিল সিপিএম। কয়েক জন সিপিএম কর্মী-সমর্থক গ্রেফতারও হন।
ক্ষুদিরামবাবুর দাবি, তিনি সরাসরি কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন এবং গণপ্রহারের ঘটনাতেও তাঁর তরফে কোনও ‘ইন্ধন’ ছিল না। তাঁর অভিযোগ, “ওই ঘটনার সূত্র ধরেই ১৩ মে ভোটের ফল প্রকাশের দিন বিকেল থেকেই আমাকে সমস্ত ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ফতোয়া জারি করেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব।” ক্ষুদিরামবাবুর ভাই অরূপ সেন জানান, টানা ২৭ দিন দোকান বন্ধ রাখার পরে, বুধবার সন্ধ্যায় তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা তাঁদের সালিশির জন্য ডাকেন। সেখানে লালপুরের মানুষও ছিলেন। তৃণমূলের স্থানীয় নেতা নিতাই নন্দী, কাদের আলিরা দাবি তোলেন, তিন নিহতের পরিবারকে ২ বিঘা করে জমি ক্ষতিপূরণ হিসাবে দিতে হবে।
অরূপবাবুর দাবি, “ঘটনার সঙ্গে যুক্ত না হলেও মানবিকতার খাতিরে প্রথমে ১ লক্ষ, পরে ২ লক্ষ টাকা করে তিনটি পরিবারকে দেব বলি। ওঁরা তাতেও রাজি হলেন না। আমরা বলেছিলাম, দশ দিন সময় দেওয়া হোক। দোকান খুলতে দেওয়া হোক। তার মধ্যে যদি আমরা শর্ত মানতে না পারি, তা হলে নিজেরাই ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাব।” ক্ষুদিরামবাবুর অভিযোগ, বৃহস্পতিবার দোকান খুলতেই কিছু মহিলা-সহ তৃণমূলের লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, ‘হামলায়’ বাঁ হাতের কনুই ভেঙেছে ওই ব্যবসায়ীর। লালপুর গ্রামের তিন মহিলা-সহ ৫ জনের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অভিযুক্তদের ধরার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তৃণমূল নেতা কাদের আলির বক্তব্য, “২ বিঘা করে জমি দিতে সম্মত হলেই এমন ঘটনা ঘটত না। ওঁরা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পেলেন না। এর পর কি দায়িত্ব নেওয়া যায়?” আর এক নেতা নিতাই নন্দী বলেন, “মানুষের ক্ষোভ রোখার উপায় ছিল না। কেউ কারও কথা শুনছে না।”
দলের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরামবাগ মহকুমার জন্য বিশেষ কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। ওই কমিটিতে আছেন পুড়শুড়ার বিধায়ক পারভেজ রহমান। তিনি বলেন, “হামলার সঙ্গে রাজনীতির যোগ নেই। তবে বিষয়টি বিশদে খোঁজ নেব।” অন্য দিকে, সিপিএমের গোঘাট জোনাল কমিটির সদস্য ভাস্কর রায় বলছেন, “তৃণমূল তো এখন স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে সকলের উপরেই জুলুম শুরু করেছে।”
সিপিএমের অভিযোগ, খানাকুলের সাইবোনায় তাদের দলের এক কর্মীর চাষ বন্ধ করে দিয়েছে তৃণমূলের লোকজন। আরামবাগের ইয়াতপুর গ্রামে প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা ‘জরিমানা’ নেওয়া হয়েছে সিপিএমের লোকজনের থেকে। তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে সে কথা লিখিত ভাবে জানিয়েছেন সিপিএম নেতারা। দলের আরামবাগ জোনাল কমিটির সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ করার মতো পরিস্থিতি যদি থাকতই, তা হলে আর কেউ জরিমানা দিত কেন?”
পশ্চিম মেদিনীপুরেও ছবিটা অন্য রকম নয়। ঘাটাল, কেশপুর, চন্দ্রকোনা রোড, চন্দ্রকোনা, নারায়ণগড়ে বাম কর্মী-সমর্থকদের গ্রামে থাকতে হলে জরিমানা দিতে হবে, এমন হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। অভিযুক্ত তৃণমূলই। তবে একটি ক্ষেত্রেও পুলিশের কাছে নির্দিষ্ট অভিযোগ জমা পড়েনি। পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি, কাঁথির শুনিয়া, ভাজাচাউলি, পটাশপুর এবং ভগবানপুরেও বিক্ষিপ্ত ভাবে ‘জরিমানা’ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সর্বত্রই অবশ্য তৃণমূলের নেতারা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বর্ধমানের কেতুগ্রাম ও মঙ্গলকোটের বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূল ‘পুরোদস্তুর তোলাবাজি’ করছে বলে সিপিএমের অভিযোগ। দলের নেতাদের দাবি, কেতুগ্রামের বিরুড়ি, চিনিসপুর এবং মঙ্গলকোট ব্লকের মঙ্গলকোট গ্রাম, আটঘড়া, খেঁড়ুয়ার মতো এলাকায় ওই ‘পরিস্থিতি’। দলের রাজ্য কমিটির সদস্য অচিন্ত্য মল্লিকের অভিযোগ, “তৃণমূলের তরফে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত তোলা চাওয়া হচ্ছে। দিতে অস্বীকার করলে গ্রাম ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে ওদের নেতারা।” অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “যে হেতু মুখ্যমন্ত্রী নিরপেক্ষ প্রশাসনের কথা বলেছেন, সেই সুযোগে সিপিএম তৃণমূলের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছে।”
জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “তোলাবাজির কথা কানে এলেও নির্দিষ্ট অভিযোগ হয়নি। তাই পদক্ষেপ করা হয়নি।” মুখ্যমন্ত্রী যা-ই বলুন, ‘প্রশাসন প্রশাসনের মতো চলা’র পথে আপাতত অভিযোগ না হওয়াই হয়তো বাধা!
Previous Story Rajya Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.