|
|
|
|
সিপিএম ‘অসাংবিধানিক’ বললেও আমল দিচ্ছেন না মমতা |
টাটা প্রকল্পের হাজার একরই ফিরিয়ে নিতে জারি অর্ডিন্যান্স |
নিজস্ব সংবাদদাতা ² কলকাতা |
সিঙ্গুরের জমি নিজের হাতে নেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলল রাজ্য।
বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণে ঘোষণা করেন, “রাজ্যপাল এ দিনই এ ব্যাপারে অর্ডিন্যান্স সই করেছেন।” পাশাপাশিই মমতা বলেন, “অর্ডিন্যান্স জারি করে সিঙ্গুরের হাজার একর (সঠিক হিসেব ৯৯৭.১১ একর) জমিই সরকার নিয়ে নিল। তার থেকে ৪০০ একর জমি অনিচ্ছুক চাষিদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বাকি ৬০০ একর জমি শিল্পের জন্য রেখে দেওয়া হবে। টাটারা বা অন্য যে কেউ চাইলে সেখানে শিল্প করতে পারে। তবে এ জন্য তাদের নতুন করে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে।”
অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমের সঙ্গে টাটা মোটরসের ‘সিঙ্গুর চুক্তি’ কার্যত বাতিল করে দিল রাজ্য সরকার।
মমতা বলেন, “টাটারা কয়েক মাস আগেই রাজ্য সরকারকে (তৎকালীন বাম সরকার) চিঠি দিয়ে ক্ষতিপূরণ পেলে জমি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিল। সে ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী (আরবিট্রেটর) নিয়োগ করে আইনমাফিক টাটাদের ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি সরকার।”
সরকারি সূত্রে খবর, সিঙ্গুরের অধিগৃহীত মোট ৯৯৭ একর জমির মধ্যে ৬৪৫ একর জমিতে ন্যানো গাড়ির মূল কারখানাটি তৈরির জন্য ২০০৭-এর মার্চ মাসে টাটাদের সঙ্গে শিল্পোন্নয়ন নিগমের ‘লিজ চুক্তি’ হয়। আরও ২৯০ একর জমিতে সহযোগী শিল্প গড়ার জন্য ৫৪টি সংস্থাকে লিখিত ভাবে ‘অনুমতি দখল’ দেওয়া হয়। টাটাদের সঙ্গে চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ‘তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পের জন্য জমি ব্যবহার করতে হবে’। কিন্তু টাটা গোষ্ঠী মাঝপথে (২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর) প্রকল্পের কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ায় তিন বছর পরে ২০১০ সালের জুন মাসে নিগমের পক্ষ থেকে তাদের ‘নোটিস’ পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, চুক্তিমতো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের জন্য জমি ব্যবহার করা হয়নি। এই অবস্থায় টাটাদের পরিকল্পনা কী? |
|
মহাকরণে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার। সুমন বল্লভ |
জবাবে ২০১০-এর ২৮ সেপ্টেম্বর শিল্পোন্নয়ন নিগমের এমডি সুব্রত গুপ্তকে চিঠি লিখে টাটা ইন্ডিয়ার ম্যানেজার (অপারেশন্স) প্রকাশ তেলাং জানান, সিঙ্গুরে তাঁরা এবং সহযোগী শিল্পসংস্থাগুলি বাড়ি, শেড-সহ পরিকাঠামো তৈরির জন্য যে অর্থ ব্যয় করেছে, সেই বাবদ ক্ষতিপূরণ পেলে তাঁরা প্রকল্প এলাকা থেকে সরে আসার কথা বিবেচনা করবেন। টাটা গোষ্ঠীর দাবি, সিঙ্গুরে গাড়ি তৈরির প্রকল্পের জন্য সব মিলিয়ে ২০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল। প্রকল্প সরিয়ে নেওয়ায় বেশ কিছু যন্ত্রপাতি অবশ্য চলে গিয়েছে সানন্দে। তবু ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কয়েকশো কোটি টাকা হবে। অর্ডিন্যান্স করে চুক্তি বাতিলের পথে ‘তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পের জন্য জমি ব্যবহার’ এবং তেলাংয়ের ওই চিঠিকেই নতুন সরকার ‘হাতিয়ার’ করেছে বলে মনে করছে প্রশাসনের একাংশ।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “চিঠি দিয়ে টাটারা বলেছিলেন, ওঁরা শিল্প করতে চান না। ক্ষতিপূরণ চান। এর পর চার বছর কেটে গিয়েছে। কিছুই এগোয়নি। জমিটা পড়ে রয়েছে।” একইসঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রসঙ্গ টেনে মমতা বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, ৪০০ একর জমি অনিচ্ছুক চাষিদের ফিরিয়ে দেব। তাই অর্ডিন্যান্স জারি করে জমি ফেরত নিলাম।”
মমতার ওই ঘোষণার পরেই তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “নতুন বিধায়কদের শপথের সঙ্গে সঙ্গে বিধানসভা চালু হয়ে গিয়েছে। আপাতত তা মুলতুবি। এই সময়ে অর্ডিন্যান্স জারি করা যায় না। একমাত্র বিল আনা যায়।” একই যুক্তি দেন লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভার দুই প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং হাসিম আব্দুল হালিমও।
কিন্তু এ সব যুক্তিকে আদৌ আমল দেননি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, “রাজ্যপাল অর্ডিন্যান্সে সই করেছেন। কিন্তু কবে থেকে তা কার্যকর করা হবে, সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত। যত ক্ষণ নোটিস জারি না-হচ্ছে, তত ক্ষণ কার্যকর হওয়ার প্রশ্ন কোথায়। আগে মন্ত্রিসভায় আনুষ্ঠানিক ভাবে বিষয়টি জানাব। প্রয়োজন হলে অর্ডিন্যান্সের বদলে বিধানসভায় বিলও আনা যেতে পারে। কিন্তু তাতে বিষয়টির সারমর্ম বদলায় না। সিঙ্গুরের জমি নিয়ে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটাই কার্যকর হবে।” বস্তুত, খানিকটা কটাক্ষের সুরে সিপিএমের প্রতি মমতার বক্তব্য, “ওঁরা চাইলে না-হয় অর্ডিন্যান্সটা রেখেই দেব! বিধানসভা ডাকা হলে পাস করিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, লোকসভা জারি থাকলেও প্রয়োজনে সরকার প্রশাসনিক আদেশবলে তেলের দাম বাড়ায়। লোকসভা বা বিধানসভার অধিবেশন যদি দীর্ঘদিন মুলতুবি থাকে, তা হলে কি সরকার কোনও জরুরি সিদ্ধান্ত নেবে না? এটা হয় নাকি!” |
|
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তো বটেই, মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের প্রথম সিদ্ধান্তই মমতা নিয়েছিলেন সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের ৪০০ একর জমি ফেরানোর বিষয়ে। কী ভাবে সেই জমি ফেরানো যেতে পারে, তা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই আইনি পরামর্শ নিচ্ছিলেন তিনি। এর মধ্যে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সিঙ্গুরের জমি দেখেও এসেছিলেন। ঘটনাচক্রে, আজ, শুক্রবার পার্থবাবুর আবার সিঙ্গুর যাওয়ার কথা। সঙ্গে থাকবেন স্থানীয় বিধায়ক ও স্কুল শিক্ষামন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
বৃহস্পতিবার বিকেলে পার্থবাবু এবং রাজ্য বিচারবিভাগের অফিসারেরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তার পরেই পার্থবাবু যান রাজভবনে। সেখানে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে শিল্পমন্ত্রীর আলোচনা হয় এবং রাজ্যপাল অর্ডিন্যান্সে সই করেন। পার্থবাবু মহাকরণে ফিরলে মুখ্যমন্ত্রী নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করে ওই ঘোষণা করেন।
তার পরেই শুরু হয়ে যায় রাজনীতির চাপানউতোর। সিপিএম প্রশ্ন তোলে রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়েও। হায়দরাবাদে দলের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে গিয়ে বিমানবাবু বলেন, বিষয়টি ‘সংবিধান-বিরোধী’। তাঁর কথায়, “ভারতের সংবিধানের ২১৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী দেশের সংসদ বা কোনও রাজ্যের বিধানসভা চালু থাকাকালীন অর্ডিন্যান্স আনা যায় না।” রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিমানবাবুর মন্তব্য, “সরকারই বা এই সময়ে কী করে অর্ডিন্যান্স আনল এবং রাজ্যপাল যদি সই করে থাকেন, তা হলে তিনিই বা তা কী করে করলেন, সেটা বুঝতে পারছি না! এমন কিছু হয়ে থাকলে তা অসাংবিধানিক এবং সংসদীয় রাজনীতিতে বিপজ্জনক।” এ ব্যাপারে তাঁরা আইনজ্ঞদের পরামর্শ নিচ্ছেন বলেও বিমানবাবু জানান। তাঁর সুরেই বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “এটা নজিরবিহীন ঘটনা। অগণতান্ত্রিক। খুব সুস্পষ্ট ভাবে সংবিধানে আছে রাজ্যপাল অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারেন তখনই, যখন বিধানসভার সংশ্লিষ্ট অধিবেশন শেষ হয়ে যায়।” টাটাদের ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ নিয়ে বিমানবাবু বলেন, “মধ্যস্থতাকারী বসানো, জমি ছাড়া বা না-ছাড়ার প্রশ্ন কিছুই এখানে আসে না। অর্ডিন্যান্স জারি করাটাই অসাংবিধানিক!” রাজ্য বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হালিমও বলেন, “কোন আইনে এটা করা হল? বিধানসভা চালু রয়েছে। ২৪ জুন পর্যন্ত বিধানসভার কাজ মুলতুবি আছে! বিধানসভা চালু থাকলে অর্ডিন্যান্স করার সংবিধানে সংস্থান নেই।”
সরকারের তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী তো বলেননি, তিনি রাত পোহালেই জমি ফেরত দিয়ে দেবেন! এক তৃণমূল নেতার কথায়, “অর্ডিন্যান্স আগে আসুক! তার পর সিপিএম এ সব বলবে! ওরা চিন্তিত সংবিধান নিয়ে! সংবিধান রক্ষার দায়িত্ব নেবে বিধানসভা! আমাদের নেত্রী জানেন, কী করে কী করতে হয়! প্রয়োজনে বিল আসবে! বিধানসভার অমর্যাদা করে কিছু করা হবে না।” তাঁর যুক্তি, “এখনও তো রাজ্যপালের ভাষণই হয়নি! কার্য উপদেষ্টা কমিটিই গঠিত হয়নি! তা হলে কী করে বিধানসভার কার্যধারা চালু হল! সংবিধানের দোহাই না-তুলে সিপিএম বরং বলুক যে, ওরা সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি ফেরত দিতে চায় না!”
ন্যানো কারখানা তৈরি নিয়ে শিল্পোন্নয়ন নিগমের সঙ্গে চুক্তির পরে সিঙ্গুরে দ্রুতগতিতেই কাজ শুরু করে দিয়েছিল টাটারা। কিন্তু একই সঙ্গে চলছিল ‘জোর করে’ জমি নেওয়ার অভিযোগে আন্দোলন। ২০০৮-এর সেপ্টেম্বরে তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর উদ্যোগে ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের জমি ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে তৃণমূলের সঙ্গে চুক্তি হয় রাজ্য সরকারের। কিন্তু সেই চুক্তিও শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়। এর পরেই ৩ অক্টোবর সিঙ্গুরের প্রকল্প বাতিল করার কথা ঘোষণা করেন টাটা গোষ্ঠীর প্রধান রতন টাটা। যদিও লিজ-চুক্তির নিয়ম মেনে জমির ভাড়া প্রতি বছরই মিটিয়ে যাচ্ছে তারা। এ দিন মমতার ঘোষণার পর অবশ্য টাটা মোটরসের তরফে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। স্রেফ বলা হয়েছে, ‘‘আমরা এ ব্যাপারে অবগত নই। অর্ডিন্যান্স ভাল করে না-দেখে মন্তব্য করব না।” অর্ডিন্যান্স তৈরির কথা ঘোষণা করে দৃশ্যতই খুশি মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “আজকের দিনটা হোক সিঙ্গুরের দিন!”
|
সিঙ্গুর সমাচার |
২০০৬ |
• ১৮ মে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-রতন টাটা মিলে সিঙ্গুর প্রকল্প ঘোষণা
• ২৫ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুরে ধর্নায় বসা মমতা গ্রেফতার
• ৪ ডিসেম্বর ধর্মতলায় মমতার অনশন শুরু |
২০০৭ |
• ১ জানুয়ারি কেন্দ্রের আশ্বাসে অনশন ভাঙলেন মমতা
• ৯ মার্চ টাটার সঙ্গে রাজ্যের জমি চুক্তি
• ৪ জুন জ্যোতি বসু-মমতা বৈঠক |
২০০৮ |
• ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে ‘ন্যানো’র উদ্বোধন
• ২৪ অগস্ট সিঙ্গুরে মমতার অবস্থান শুরু
• ৭ সেপ্টেম্বর রাজভবনে সরকার-তৃণমূল সিঙ্গুর-চুক্তি
• ৩ অক্টোবর সিঙ্গুর থেকে কারখানা গোটাল টাটারা |
২০১০ |
• জুন সিঙ্গুরের জমি নিয়ে টাটাকে রাজ্যের চিঠি
• ২৮ সেপ্টেম্বর জমি ফেরাতে ক্ষতিপূরণ চাইল টাটারা |
২০১১ |
• ২০ মে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই ৪০০ একর ফেরতের সিদ্ধান্ত
• ৯ জুন লিজ-চুক্তি বাতিল করে অর্ডিন্যান্স |
|
|
|
|
|
|