|
|
|
|
স্মরণ ১... |
মকবুল ফিদা হুসেন (১৯১৫-২০১১) |
জীবিতকালে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি, সর্বদা সংবাদপত্রের শিরোনাম। ছবি এঁকে যতটা বিখ্যাত, ছবি না-এঁকেও ঠিক ততটাই। রেখাচিত্রের ‘লাইন’ বা ‘পেন্টিং’-এর তুলি-চালনা দক্ষতার নির্ভুল পরিচয় দিয়েছে। পাশাপাশি, বিলাসবহুল জীবন এবং সন্নিকটের সুন্দরীরা দান করেছেন নির্বিকল্প ‘গ্ল্যামার’। শিল্পের ব্যাকরণ এবং বাণিজ্যের অঙ্ক, দুইয়ে মিলেই তাঁর উচ্চাসনটি গঠিত। বলা যায়, তাঁরা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে। শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন-এর একটিই প্রতিদ্বন্দ্বী। ‘শো-ম্যান’ মকবুল ফিদা হুসেন। একে অন্যের পরিপূরকও বটে। সাদা পোশাক, বিদেশি গাড়ি, দীর্ঘ তুলি, নগ্নপদ এবং তপ্ত বিতর্ক-সহকারে তিনি ভারতীয় শিল্পের বিচিত্র প্যাকেজিং। জীবদ্দশায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
মকবুল ফিদা হুসেন বিচরণ করেছেন আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর-বিরোধী দুনিয়ায়, কিন্তু তাদের মিলিয়েছেন এমনই অনায়াসে যে, কখনও মনেই হয়নি, কী ভাবে স্যাভিল রো-র মহার্ঘ সুট আর খালি-পায়ের পদচারণা সহাবস্থান করতে পারে একই শরীরে। অথচ, এই সম্মিলন নিয়েই মকবুল ফিদা হুসেন। সমালোচকেরা সরবে বলেছেন, ‘গিমিক’! হুসেন দৃকপাত করেননি। আপন খেয়ালে ছবি এঁকেছেন, নিজের মতো করে বেঁচেছেন, বার বার বদলেছেন তাঁর ‘মানসী’-কে মাধুরী দীক্ষিত, তব্বু, বিদ্যা বালন, অমৃতা রাও, হালফিল নাকি অনুষ্কা শর্মাও উঠেছিলেন সেই তালিকায়। গুঞ্জন উঠেছে, কান দেননি। তাঁকে ঘিরে বিতর্ক যত প্রবল, ততই খ্যাতির শিখর থেকে শিখরে উত্থান তাঁর। নিজেকে বলতেন ‘ছবিদাস’, অথচ প্রচারের আলোয় থাকলেন, তাকে ব্যবহারও করলেন আজীবন।
দীর্ঘ জীবনে স্বীকৃতি পেয়েছেন অজস্র, কিন্তু পথটি ছিল দুর্গম। লাভ করেছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ। উনিশশো পঞ্চাশ-একান্নতে কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের বার্ষিক প্রদর্শনীতে তাঁর আঁকা ছবি দেড়শো টাকায় বিক্রি হয়নি, কিন্তু শতক শেষের আগেই তাঁর ছবি হয়ে ওঠে সংগ্রাহকের সম্পদ। এক-একটি ছবির দাম কোটির ঘরে পৌঁছয়। জন্ম খুবই সাধারণ ঘরে, উনিশশো পনেরোর ১৭ সেপ্টেম্বর, বর্তমান মহারাষ্ট্রের পন্ঢারপুরে। বাবা তদানীন্তন ইনদওর রাজ্যের কাপড়ের কলের কর্মী। ছ’মাস বয়সেই মাতৃহারা শিশুটিকে বাবা নিয়ে আসেন ইনদওর-এ। লেখাপড়ায় মন ছিল না, তবে, যা দেখত, তা-ই এঁকে ফেলত। বাবা তাঁকে ভর্তি করে দিলেন একটি ‘আর্ট স্কুল’-এ। সেই ধরাবাঁধা বিদ্যালয়ের শিল্পশিক্ষায় তাঁর মন টিকল না। উনিশশো সাঁইত্রিশে বাবা চলে এলেন মুম্বইতে, চাইলেন ছেলে তাঁর ঘি-এর ব্যবসা দেখুক। পুত্র নারাজ, সুতরাং বাবা ভর্তি করে দিলেন ‘স্যর জে জে আর্ট স্কুল’-এ। সমস্যা, সেই প্রতিষ্ঠানও যে রক্ষণশীলতার কেল্লা। হুসেন যে খুব প্রীত হলেন তা নয়, তবে, পেয়ে গেলেন একঝাঁক সমমনস্ক তরুণকে। বসুদেব সন্তু গায়তোণ্ডে, ফ্রান্সিস নিউটন সুজা, শ্রীকান্ত বাক্রে, কৃষ্ণাজি হাওলাজি আরা, সৈয়দ হায়দর রজা, এইচ এ গাডে। পরবর্তী কালে এঁরা সকলেই কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যশস্বী হয়েছেন, কিন্তু দক্ষতা, বিতর্ক এবং গ্ল্যামার-এর ত্রি-ফলায় সর্বাগ্রে মকবুল ফিদা।
সাঁইত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্যে, ছবি আঁকার সরঞ্জাম কেনার জন্য তিনি এঁকেছেন সিনেমার বিশাল হোর্ডিং, রং করেছেন কাঠের খেলনা, দোকানের জন্য নতুন নতুন নকশার আসবাব এঁকেছেন। দীর্ঘকাল তাঁর স্টুডিয়ো ছিল গ্র্যান্ট রোডের ফুটপাথ। ভোজন যত্রতত্র, রাতে শয়ন ফোর্যাস রোডের এক গ্যারাজ-এ। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ছবি আঁকা থামেনি । উনিশশো পঁয়তাল্লিশে গণনাট্য সঙ্ঘের উদ্যোগে মুম্বইতে (তখন বম্বে) হল ক্যালকাটা গ্রুপের ছবি ও ভাস্কর্যের প্রদর্শনী। এমন আধুনিক শিল্পচর্চা মুম্বই তার আগে দেখেনি। এরই প্রেরণায় হুসেন ও সহমর্মী তরুণেরা সাতচল্লিশ-এ গড়লেন ‘বোম্বে প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্ট গ্রুপ’। উনিশশো পঞ্চাশে কলকাতায় ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’ ও ‘বোম্বে প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্ট গ্রুপ’-এর যৌথ প্রদর্শনী হল। মকবুল ফিদা হুসেন নামক কিংবদন্তীর উত্থানের সেই শুরু।
গোড়া থেকেই তিনি এঁকেছেন মানুষের ছবি। নিজস্ব শৈলী রচনায় তিনি কিউবিজ্ম থেকে কালীঘাট পটের বৈশিষ্ট্যকে মিলিয়ে অবয়বগুলিকে পট জুড়ে সাজালেন। রঙে-রেখায় তাঁর ছবির চেহারাটা হল ভারতীয়। দেহাতি মানুষজনের জীবনযাত্রার ছবির সঙ্গে আঁকলেন রামায়ণ-মহাভারতের ছবি। উনিশশো পঞ্চান্নতে ললিতকলা অকাদেমির প্রথম জাতীয় প্রদর্শনীতে তিনি পুরস্কৃত হলেন। বিদেশের যাবতীয় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করল তাঁর ছবি। ইউরোপ ও আমেরিকার বড় শহরগুলিতে তাঁর একক প্রদর্শনী আয়োজিত হল। উনিশশো সাতষট্টিতে হুসেন তুললেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র, শাদা-কালোয় ‘থ্রু দি আইজ অফ আ পেইন্টার’, তার মুখ্য প্রতীক একটি গরুর গাড়ি আর একটি লণ্ঠন। এই ছবি দেশে-বিদেশে পুরস্কৃত হল। তাঁর সর্বাধিক আলোচিত ছবি নিঃসন্দেহে ‘গজগামিনী’। এই ছবি বলিউডি সিনেমার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য। হুসেন নিজেই কবুল করেছেন, মাধুরীর শরীরী বিভঙ্গে তিনি ধরতে চেয়েছিলেন চিরকালের সাহিত্য ও শিল্পের সৌন্দর্যকে। এই বিচিত্র স্বীকারোক্তিই প্রমাণ, বিতর্ক ঘনাতে পারে জেনেও নিজের কথা নিজের মতো করেই বলাটা ছিল তাঁর স্বভাব।
সাহসও ছিল সেই স্ব-ভাবে। উনিশশো ঊনষাটে মুম্বইয়ের জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারিতে একক প্রদর্শনীতে তিনি একটি আগাপাশতলা চিত্রিত মোটর কার দেখালেন। এটি ছিল এ দেশে প্রথম আধুনিক ইন্স্টলেশন। গত শতকের শেষে তিনি কলকাতায় এক প্রকাশ্য মঞ্চে একটি সুবৃহৎ ক্যানভাসে ছবি আঁকার পরই সেটা শাদা রং দিয়ে ঢেকে দিলেন। সেটাও ছিল এ দেশে অনুষ্ঠিত প্রথম পারফর্মেন্স্ বা হ্যাপেনিং। জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গাঁধীকে দেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করে আঁকা তাঁর ছবি ভারতের বড় বড় শহরে উদ্বোধন করেছিলেন কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বরুয়া। সমালোচনা হয়েছিল তুমুল, হুসেন অবিচল। একদা ভারতীয় সংসদে রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। যে কয়েক জন শিল্পীর ছবি শিল্পকলার লগ্নিতে সর্বাধিক নিরাপদ বলে বিবেচিত, সেই তালিকার পুরোভাগে তিনি। সেই শিরোপা তাঁর শিল্পের স্বীকৃতি তো বটেই, আবার কিছুটা যে তাঁকে ঘিরে ঘনীভূত বিবিধ বিতর্কের ফল, তাতেও সন্দেহ নেই।
তিনি যখন নগ্ন সরস্বতীর ছবি এঁকে তুমুল সমালোচিত, অন্য শহরে তাঁর প্রদর্শনীতে ভাঙচুর, তখন কলকাতার শিল্পীরা তাঁর সমর্থনে সমবেত হয়েছিলেন। অতঃপর, হুসেন তাঁর অষ্টাশি বছরের জন্মদিনে কলকাতায় এলেন ছবি দেখাতে। সেই সময় এক সাক্ষাৎকারে করা তাঁর একটি মন্তব্য স্থানীয় শিল্পীদের একাংশকে ব্যথিত করল। শুরু হল বিতর্ক। প্রদর্শনী বয়কট। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও সেই প্রদর্শনী উদ্বোধন এড়িয়ে গেলেন। বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়ল না কোনও দিন। বিভিন্ন বিতর্কিত ছবি যেমন ‘অনাবৃত ভারতমাতা’ বা ‘নগ্ন সরস্বতী’ অঙ্কনের অভিযোগে হুসেন দেশত্যাগে বাধ্য হলেন। জীবনের অন্তিমে সেই খেদটি তাঁর থেকেই গেল, নব্বই-পেরোনো বয়সে গ্রহণ করতে হল কাতারের নাগরিকত্ব।
সমকালীন ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে তিনি বিশিষ্টতম, অথচ সেই পরিচয়কে ছাপিয়ে গেল তাঁর বিতর্কিত ভাবমূর্তি। এক মকবুল ফিদা হুসেন-এর পথরোধ করে দাঁড়ালেন আর এক মকবুল ফিদা হুসেন। বহিরঙ্গে এক, অথচ অন্তরঙ্গে দুই বিচিত্র এই আত্মবিচ্ছেদ এক সময় উপভোগ করেছেন হুসেন। অথচ, সেই বিচ্ছেদই কি শেষটায় তাঁর ট্র্যাজেডি হয়ে দাঁড়াল? স্ব-ভূমি থেকে বহু দূরে নিজের নব্বই-পেরোনো শরীরে ভারতীয় আধুনিক শিল্পকলার উত্থানের ইতিহাসটি বহন করে ফুরিয়ে গেলেন মকবুল ফিদা হুসেন। |
|
|
|
|
|