স্মরণ ২...
অথচ তিনিই ছিলেন
ভারতের শিল্পদূত
সালটা আন্দাজ ১৯৬২, অর্ধশতাব্দীর ব্যবধান, ফলে অনুপুঙ্খ মনে নেই, কিন্তু আচমকা সেই উত্তেজনাটা স্মরণে আছে। কলকাতা। চ্যাপলিন স্কোয়ার। আমরা কয়েকজন তরুণ শিল্পী, চালচুলো বিশেষ নেই, সেখানে প্রদর্শনী করছি। স্বাভাবিক, আমিও আছি, আড্ডা চলেছে জোরদার, হঠাৎ কে যেন এসে বলল, হুসেন সাহেব এসেছেন। তোর ছবি দেখেছেন, তোকে খুঁজছেন...
কথার প্রথমটুকু কানে গেল, শেষটুকু কানে যেতেই হাত-পা প্রায় বিকল। তত দিনে মকবুল ফিদা হুসেন ভারতীয় শিল্পকলার পুরোধাদের অন্যতম, তিনি আমাকে খুঁজছেন! চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লাম, পাছে আমাকে ফের ডাকেন, তাই অকুস্থল ছেড়ে দ্রুতপায়ে উধাও। মকবুল ফিদা হুসেন-এর প্রয়াণের খবর পেয়ে মনে হচ্ছে, মকবুল ফিদা হসেন মানে কি শুধুই বিতর্ক? শুধুই গ্ল্যামার? ফিদা হুসেন কি সেই শিল্পীও নন যিনি খ্যাতির চূড়ায় থেকেও বার বার তরুণদের খুঁজেছেন, তাঁদের স্বীকৃতি দিয়েছেন, পাশাপাশি নিজেও তুলি চালিয়েছেন অনায়াসে! আমাকে এবং প্রয়াত বিকাশ ভট্টাচার্যকে সর্বভারতীয় স্তরে যাঁরা প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছেন, মকবুল ফিদা হুসেন-এর নাম তাঁদের সর্বাগ্রে। তরুণদের ছবি ভালবাসতেন, নিজেই খুঁজে নিতেন তাঁদের।
আমার কাছে মকবুল ফিদা হুসেন মানে আশ্চর্য এক ‘ডায়নামিক’ চরিত্র। এই শব্দটির কোনও প্রতিশব্দ হয় কি না, জানি না। শিল্পীর জীবনচর্যা, ব্যবহার, বহিরাবরণ, তাঁর খ্যাতি সব মিলিয়ে নির্মিত হয় সেই ডায়নামিজম, মকবুল ফিদা হুসেন-এর মধ্যে যার একটি বিশিষ্ট প্রকাশ। বিশাল মাপের পেন্টিং করেছেন অবলীলায়। চিত্রকলার করণকৌশল সম্পর্কে যাঁদের সামান্য ধারণা আছে, তাঁরাই বুঝবেন যে এই কাজটি ঠিক কী পরিমাণ কঠিন! অথচ হুসেন সাহেব-এর তুলির টানে মনে হত, যেন অতীব সহজসাধ্য সেই কাজ। দুরূহকে সহজ বলে প্রতীয়মান করে তোলাই প্রতিভার নিজস্ব জাদু।
ভারতীয় শিল্পকলাকে যাঁরা আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁদের মধ্যে ফিদা হুসেন-এর নামটি বিশিষ্ট। বস্তুত, তাঁর কাজটি ছিল আরও কঠিন। যাঁরা প্রায় বিশ্বাসই করতেন না যে, ভারতে অণুচিত্র, মানে মিনিয়েচার-এর পরেও ছবি আঁকা হয়েছে, তাঁদের সামনে মকবুল ফিদা হুসেন তাঁর ছবি দিয়ে প্রমাণ করলেন, ভারতীয় আধুনিক শিল্পকলা নামে একটি বস্তু সগৌরবে বিদ্যমান! ভারতে যে শিল্পকলার ধারাটি জীবন্ত এবং বহমান, এটা আজ আর কোনও খবর নয়। কিন্তু পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে একটি সদ্য-স্বাধীন, উপনিবেশের থাবা থেকে মুক্ত দেশের পক্ষে সেটুকুই প্রমাণ করা ছিল অনেক কঠিন কাজ। মকবুল ফিদা হুসেন ভারতীয় শিল্পকলার দূত হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বার বার দেখা দিয়েছেন। বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরেছেন ভারত-শিল্পের ধ্বজা উড়িয়ে।
নিয়তির পরিহাসই বলতে হবে, অবশেষে সেই ভারতই তাঁকে ছাড়তে হল। তাঁর সম্পর্কে ‘দেশদ্রোহী’ গোছের কথাবার্তাও উড়ে বেড়াল এ দিক ও দিক। মকবুল ফিদা হুসেনের সঙ্গে সমার্থক হয়ে উঠল একটিই শব্দ, বিতর্ক। সেই বিতর্ক, প্রচারমাধ্যমের তৎপরতা, জনতার উন্মাদনা এ সবই কি তিনি উপভোগ করতেন নিজের মনের ভিতরে কোথাও? ওঁর সঙ্গে একান্তে কথা হয়েছে একাধিক বার, এ দেশে এবং বিদেশে। কথাও বলেছি। স্বচক্ষে দেখেছি, বিদেশে ওঁকে ছেঁকে ধরেছে মানুষের ভিড়। তাঁদের কত দাবি। স্বাক্ষর চাই, ছবি এঁকে দেওয়া চাই। উনি নির্বিকার, এবং সহাস্য। দিব্য খোশমেজাজে সকলের আবদার মেটাচ্ছেন। পরে জিজ্ঞেস করেছি, কেন করেন এ সব? উনি হেসেছেন, বলেছেন, ভালই তো! সত্যের খাতিরে বলা উচিত যে তিনি আরও কিছু বলেছিলেন। সে সব কথা আজ ইতিহাস। ইতিহাসের যে অংশটুকু গভীর ভাবে ব্যক্তিগত, ঠিক গণ-উপভোগের জন্য নয়, হুসেন সাহেবের সঙ্গে আমার সেই সংলাপটুকু তেমনই এক টুকরো ইতিহাস। সেই বাক্যালাপ আমাকে আলোড়িত করেছে, কিন্তু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম যে সেই কথাবার্তা একান্ত ব্যক্তিগত, ফলে আজকেও তা জনচক্ষুর আড়ালে রেখে দেওয়াই সঙ্গত বোধ করি। তবে, নিরুপায় হয়ে মকবুল ফিদা হুসেনের দেশত্যাগ আমার মতে একটি অতীব মর্মান্তিক ঘটনা।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার আরও মনে হয়, প্রচারমাধ্যম এবং জনজোয়ার বাদ দিলে মকবুল ফিদা হুসেনের ব্যক্তিত্বকে ধরা যাবে না। তিনি ওই রকমই, শিল্পের নিভৃতি বুকের গভীরে আছে নিশ্চয়ই কোথাও, কিন্তু বহিরঙ্গে তিনি সর্বদাই প্রচারমাধ্যমের চড়া আলোর নীচে। কেন মকবুল ফিদা হুসেন এ রকম, আমার মনে হয়, এই প্রশ্নটি অর্থহীন। এটাই তাঁর শিল্পিত স্ব-ভাব। বরং, অন্য দিক থেকে ভাবলে এই বিতর্ক, প্রচার, গ্ল্যামার এই সব কী ভাবে মকবুল ফিদা হুসেন-এর কিংবদন্তি হয়ে ওঠার অন্তরালে কাজ করল, সেটাই ভেবে দেখা উচিত।
ভেবেছিলাম, তিনি শতায়ু স্পর্শ করবেন। অন্তত, আমি তো নিশ্চিত ছিলাম যে, একশোর এত কাছে এসে কিছুতেই তিনি বয়সের কাছে পরাভূত হবেন না। শেষ বার দেখেছি লন্ডনে, কাগজপত্রেও পড়েছি যে, জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন। পঁচানব্বই বছরের কোনও শিল্পীর পক্ষে এত বড় গৌরব আর কী-ই বা হতে পারে?
এই মুহূর্তে আমি মর্মাহত। মকবুল ফিদা হুসেন-এর মৃত্যুতে ভারত-শিল্পে খুব বড় মাপের একটি শূন্যস্থানের সৃষ্টি হল। বিতর্ক যা-ই থাক, ভারতশিল্পে মকবুল ফিদা হুসেনের অবদান কিংবদন্তির মতো। অনন্য।
অনস্বীকার্যও।
Previous Item Editorial First Page



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.