|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
লজ্জিত ভারত |
ভারতীয় চিত্রকলাকে যাঁহারা আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিতি দিয়াছেন, মকবুল ফিদা হুসেন নিঃসন্দেহে তাঁহাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তবু ৯৬ বছর বয়সে প্রবাসে এই শিল্পীর প্রয়াণ ভারতের পক্ষে কোনও শ্লাঘার বিষয় নয়। কারণ যুগে-যুগে ‘শক-হুন দল পাঠান-মোগল’কে কোল দিলেও ভারত তাহার এই বিশিষ্ট সন্তানকে নির্বাসিত করিয়াছিল। বলা উচিত, স্বেচ্ছানির্বাসনে পাঠাইয়াছিল। সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁহাকে বিতাড়িত করে নাই, হত্যার হুমকি দিয়া তাঁহাকে দেশছাড়া করিয়াছিল ভারতবাসীদেরই একাংশ। তাহার আগে তাঁহার ছবি ছেঁড়া হয়, ছবি আঁকার স্টুডিয়োয় ভাঙচুর, তাণ্ডব চালানো হয়, তাঁহাকে ‘সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের অবমাননাকারী’ রূপে শনাক্ত করিয়া দেশময় তাঁহার বিরুদ্ধে কুৎসা ও ঘৃণা ছড়ানো হয়। ৯১ বছর বয়সে বৃদ্ধ হুসেনকে পারস্য উপসাগরীয় রাষ্ট্র কাতারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করিতে হয়। অতঃপর কাতার ও লন্ডনের মধ্যেই শিল্পী হুসেনের যাতায়াত চলিতে থাকে।
হুসেন অঙ্কিত ভারতীয় দেবদেবীর ছবি হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির অসম্মান করে, এই অপযুক্তিতে উগ্র হিন্দুত্বের লাঠিয়ালরা শিল্পীর স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। সংস্কৃতির কমলবনে মত্ত হস্তিদের এমন দাপাদাপি এই প্রথম নয়, শেষও নয়। কিন্তু চিত্রকরের হাতে তো ত্রিশূল থাকে না, থাকে তুলি, তিনি কেমন করিয়া হর-হর-মহাদেব ধ্বনিতে চরাচর প্রকম্পিত করা বানরসেনার মোকাবিলা করিবেন, যদি না সমাজ তাঁহার প্রতিভা ও উন্মেষশালিনী বুদ্ধির সুরক্ষায় দাঁড়াইয়া যূথের বর্বরতাকে তিরস্কার করে, রাষ্ট্র তাহার বরাভয় লইয়া তাঁহার স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা করিতে আগাইয়া আসে? কিছু শিল্পী-সাহিত্যিক, হুসেনের বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা নিশ্চয় তাঁহার সমর্থনে এবং তাঁহার সম্ভাব্য হন্তারকদের বিপক্ষে দাঁড়াইয়াছিলেন। কিন্তু তাহা যথেষ্ট ছিল না। সমাজের বিবেক তাঁহার স্বাধীনতার অনুকূলে জাগ্রত হয় নাই। আর রাষ্ট্র? তাহার কথা যত কম বলা যায়, ততই ভাল। আজ রাষ্ট্রপতি হুসেনের মৃত্যু ‘চিত্রকলার জগতে যে-শূন্যতা সৃষ্টি করিবে’, তাহার কথা বলিতেছেন। প্রধানমন্ত্রী এই মৃত্যুকে ‘জাতীয় ক্ষতি’ আখ্যা দিতেছেন। এ সকলই দস্তুর-মত কথা। সব প্রতিভাবানই মরণশীল এবং তাঁহাদের মৃত্যুতে যে ক্ষতি ও শূন্যতা অনুভূত হয়, তাহা অপূরণীয়ও বটে। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধারদের এ ক্ষেত্রে তাহা লইয়া দুঃখপ্রকাশ সাজে না। কেননা তাঁহারা মকবুল ফিদা হুসেনের মতো শিল্পীকে স্বদেশে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। বহু বেদনায় এক জন শিল্পী নিজের ঘর-দুয়ার, পরিচিতজনকে চিরতরে ছাড়িয়া দেশান্তরী হন। আজন্ম যাহাকে জন্মভূমি বলিয়া জানিয়াছি, সহসা কিছু সাংস্কৃতিক দুর্বৃত্তের ফতোয়া-ফরমানে তাহা আমৃত্যুপ্রবাস হইয়া যাওয়ার যে যন্ত্রণা ও রক্তক্ষরণ, তাহা হইতে ফিদা হুসেনকে নিরাময় করিতে কী করিয়াছেন এই রাষ্ট্রনায়কেরা? কেবল বিবৃতি দিয়া বলিয়াছিলেন, হুসেন দেশে ফিরিতে চাহিলে তাঁহাদের কোনও আপত্তি নাই। প্রাণভয়ে নির্বাসিত এক জন শিল্পীকে দেশে ফিরাইবার জন্য ইহাই যথেষ্ট? হুসেন কিন্তু বুঝিয়াছিলেন, ভারতীয় সমাজ শিল্পীর স্বাধীনতা শিরোধার্য করিতে শেখে নাই। তিনি নির্বাসনে যাওয়ার পরেও ভারতের যেখানেই তাঁহার চিত্রকলার প্রদর্শনী হইয়াছে, সেখানেই হিন্দুত্ববাদী তাণ্ডব চলিয়াছে। এ জন্য কেহ শাস্তি হইয়াছে, এমন শুনা যায় নাই। কিন্তু হুসেনের বিরুদ্ধে মামলার পাহাড় আদালতে জমিয়া উঠিতে দেওয়া হইয়াছে। এমন উদার ভারত মকবুল ফিদা হুসেনকে বিদায় জানাইবার সময় লজ্জায় অধোবদন হওয়া ভিন্ন আর কী করিতে পারে? |
|
|
|
|
|