|
|
|
|
পাহাড়ে ফের আশার আলো |
নতুন সংস্থা গড়েই অবশেষে সমঝোতা |
নিজস্ব সংবাদদাতা ²কলকাতা ও শিলিগুড়ি |
ক্ষমতায় এলে তিন মাসের মধ্যে পাহাড়-সমস্যার সমাধান করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার ১৮ দিনের মাথাতেই ‘কথা রাখলেন’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার মহাকরণে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতৃত্বের সঙ্গে দার্জিলিং চুক্তি স্বাক্ষর করল রাজ্য সরকার। সেই চুক্তি মোতাবেক পাহাড়ে গড়া হবে নতুন বিধিবদ্ধ স্বশাসিত সংস্থা। গোর্খাল্যান্ডের দাবি ‘হৃদয়ে রেখে’ও যে ব্যবস্থায় আপাতত খুশি মোর্চা নেতৃত্ব।
পাহাড়ের সমস্যার সমাধানের রাস্তা মসৃণ করতে পেরে তৃপ্ত মুখ্যমন্ত্রীও। মহাকরণে তিনি বলেন, “অফিসার পর্যায়ে এ দিন দার্জিলিং চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গিয়েছে। আজকের দিনটি একটি ঐতিহাসিক দিন। রাজ্যবাসী, দার্জিলিঙের ভাই-বোনদের কাছে আজ খুবই আনন্দের দিন।”
পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি যে মানবেন না, তা আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন মমতা। অতীতের ‘বঞ্চনা’ ভুলে দার্জিলিংকে সামনে রেখে উত্তরবঙ্গকে ‘সুইৎজারল্যান্ড’ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। সেই ডাকে সাড়া না-দিয়ে উন্নয়নের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ালে বন্ধ-বয়কটে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত পাহাড়বাসীর ক্ষোভ সামাল দেওয়া যে মুশকিল হবে, তা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন মোর্চা নেতৃত্ব। সেই কারণেই মহাকরণে চুক্তি স্বাক্ষরের পরে দার্জিলিঙে বসে মুখ্যমন্ত্রীর আন্তরিকতায় উচ্ছ্বসিত মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ বলেন, “আমাদের হৃদয়ে রয়েছে গোর্খাল্যান্ড। সেই দাবি থেকে আমরা সরিনি। তবে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন সংস্থা গড়ার যে দাবি আমরা তুলেছিলাম, নতুন রাজ্য সরকার তা মেনে নিয়েছে। তাতে তরাই-ডুয়ার্সের কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও খতিয়ে দেখবে রাজ্য। এটা অবশ্যই পাহাড়বাসীর জয়।”
মোর্চা প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের আলোচনা শুরু হয়েছিল সোমবার। দ্বিতীয় দফায় আলোচনার পরে এ দিন মহাকরণে চুক্তিপত্রে সই করেন স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতম এবং মোর্চা নেতা রোশন গিরি। চুক্তি সইয়ের সময় রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষও উপস্থিত ছিলেন। এর পর খুব শীঘ্রই কেন্দ্রের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যসচিব। |
 |
বোঝাপড়া। চুক্তি সইয়ের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
সঙ্গে মোর্চা নেতা রোশন গিরি। মঙ্গলবার মহাকরণে। সুমন বল্লভ |
মোর্চা নেতাদের সঙ্গে চুক্তির খবর এ দিন মহাকরণ থেকেই টেলিফোনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদমম্বরমকে জানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমি চুক্তি স্বাক্ষরের সুখবরটি দিয়েছি। কেন্দ্র বরাবরই পাহাড়ের সমস্যার সমাধানে আন্তরিক ছিল। তারা আরও ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করতে চেয়েছিল। আমরা চাইছি, টেকনিক্যাল কিছু বিষয় নিয়ে সর্বশেষ বৈঠকটি আমরা দার্জিলিঙেই করব। আমরা সবাই মিলে পাহাড়ে গিয়ে চকবাজারে মিলিত হব। আমরা চাই, এক সপ্তাহের মধ্যেই ত্রিপাক্ষিক বৈঠকটি ডাকা হোক।” মোর্চা সূত্রের খবর, গুরুঙ্গও চাইছেন, আগামী ১৫ জুনের মধ্যেই পাহাড়ে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হোক। সেই মতো মোর্চার তরফেও কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
কী ভাবে সমস্যার জট কাটল?
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “হৃদয় এবং সমস্যার সমাধান করার সদিচ্ছা থেকেই সমস্যার সমাধান হয়েছে। এর মধ্যে আর কোনও জটিলতা নেই। সব পক্ষই শান্তি চেয়েছেন। ফর্মুলা
মূলত ওই একটাই।” তিনি আরও বলেন, “পাহাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলন, তাঁদের ইচ্ছা ও ভাবাবেগকে মর্যাদা দিয়েই সব করা হয়েছে।
আমরা চাই, পাহাড়ের ভাই-বোনেরা ভাল থাকুন। শান্তিতে থাকুন। সমতলের মানুষেরাও শান্তিতে থাকুন, ভাল থাকুন।” সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আপনারা কী বলতে চাইছেন, বুঝতে পারছি। খুঁতখুঁত করে লাভ নেই। আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে ভালবাসি। ওঁরাও দার্জিলিঙের পাহাড়কে ভালবাসেন। সব পক্ষেরই মর্যাদা রাখা হয়েছে।”
এ দিন যে চুক্তি হয়েছে তাতে মোর্চা খুশি। কারণ, নতুন স্বশাসিত সংস্থা গড়ার প্রক্রিয়া শেষ করতে অন্তত ৬ মাস লাগবে। তার আগে পর্যন্ত বর্তমান পার্বত্য পরিষদ চালাতে যে বোর্ড গঠন করা হবে তাতে মোর্চার ৩ বিধায়ককেও রাখবে রাজ্য সরকার। ওই বোর্ডের অধীনে নয়া সংস্থার নির্বাচন হওয়ার কথা। মোর্চা যখন আগের বাম সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অন্তর্বর্তী স্বশাসনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছিল, তখন সাময়িক ভাবে তারা মনোনীত বোর্ড গঠনের প্রস্তাব দিলেও সরকার তা মানতে চায়নি। কিন্তু নতুন সরকার মনে করছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিতদের বোর্ডে মনোনীত করলে কোনও বিতর্ক উঠবে না।
বহু বার বৈঠক করেও আগের বাম সরকার দ্বিপাক্ষিক কোনও চুক্তিপত্রে মোর্চাকে সই করাতে পারেনি। মাত্র ১৮ দিনে কোন জাদুবলে তা সম্ভব হল? মোর্চার অন্দরের খবর, দায়িত্ব গ্রহণের পরেই মুখ্যমন্ত্রী গুরুঙ্গদের জানিয়ে দেন, আলোচনার নামে
গোটা বিষয়টিকে ঝুলিয়ে না-রেখে চটজলদি সমাধানের রাস্তা খুঁজতে হবে। জনজীবন ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত করে দীর্ঘদিন আন্দোলনও বরদাস্ত করা হবে না। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবও রোশন গিরি, গুরুঙ্গদের সঙ্গে কথা বলেন। |
দ্বিপাক্ষিক চুক্তি |
এক নজরে

|
* দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদের পরিবর্তে নতুন সংস্থা
* নির্বাচনের মাধ্যমে এই সংস্থা
গঠন। আগামী অধিবেশনেই বিল
* প্রশাসনিক, আর্থিক ক্ষমতা
ও অন্য কিছু ক্ষেত্রে বিধি
তৈরির ক্ষমতা
* তরাই-ডুয়ার্সের কিছু এলাকা সংযোজনের দাবি দেখতে কমিটি
* দু’সপ্তাহের মধ্যে সেই কমিটি গঠন। রিপোর্ট ছ’মাসে
* কমিটির রিপোর্টের জন্য আটকাবে না নতুন আইন তৈরি
* সংস্থাকে চা বাগানের জমির দখল দেওয়ার প্রশ্নেও কমিটি
* সংস্থাকে অভয়ারণ্যের দায়িত্ব প্রশ্নে কেন্দ্র-রাজ্য কথা হবে |
এখনই রাজ্য যা করবে |
* বর্তমান পার্বত্য পরিষদ চালাবে নয়া বোর্ড।
প্রশাসনের প্রতিনিধিরা ছাড়াও বোর্ডে মোর্চার তিন বিধায়ক
* পার্বত্য পরিষদের ৬ হাজার অস্থায়ী কর্মীকে সব সরকারি সুবিধা
* পাহাড়ের সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ প্যাকেজ
* সম্ভব হলে এক সপ্তাহের মধ্যেই দার্জিলিঙে ত্রিপাক্ষিক।
মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে চূড়ান্ত সমঝোতাপত্র সই |
 |
|
মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে সাড়া না-দিলে মোর্চার বিরুদ্ধে পাহাড়ের মানুষের ক্ষোভ যে তুঙ্গে পৌঁছবে, তা আঁচ করেই চুক্তিপত্রে সই করতে দ্বিরুক্তি করেননি রোশন গিরি, হরকাবাহাদুর ছেত্রীরা। চুক্তি সইয়ের পরে রোশন বলেছেন, “আমরা খুশি। ভীষণ খুশি। সামান্য কিছু সমস্যা ছিল তার কিছু মিটে গিয়েছে। বাকিটা মুখ্যমন্ত্রী মিটিয়ে দেবেন। আমরা মুখ্যমন্ত্রীকে পাহাড়ে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।” তবে পাহাড়ে এখনই বিজয় উৎসবের রাস্তায় হাঁটছে না মোর্চা। গুরুঙ্গ এ দিন বলেন, “আমাদের প্রতিনিধিরা কলকাতা থেকে ফিরুন। ওঁরা ফিরলে দলীয় বৈঠকের পরে পাহাড়বাসীর সামনে সব খোলাখুলি জানিয়ে যা করার করব।”
এ দিনের চুক্তিতে পাহাড়বাসীর জন্য উপহার কিছু কি দেওয়া হয়েছে? জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কোনও বিয়েবাড়িতে গেলে আমি কি খালি হাতে যাই? কিছু উপহার তো নিয়েই যাই। এর মধ্যে নতুনত্ব কী আছে?”
সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, বর্তমানে যে পার্বত্য পরিষদ রয়েছে, তা জিএনএলএফের আন্দোলনের জেরে সুবাস ঘিসিংয়ের সঙ্গে রাজ্য ও কেন্দ্রের ত্রিপাক্ষিক চুক্তির ফসল। ওই চুক্তিতে প্রধানত আর্থিক ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছিল ঘিসিঙের হাতে। এ বার আর্থিক ক্ষমতার পাশাপাশি নতুন সংস্থার হাতে প্রশাসনিক ক্ষমতাও তুলে দেওয়া হবে। মুখ্যসচিব জানিয়েছেন, আইনের সংস্থানকে মাথায় রেখে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিধি তৈরির ক্ষমতাও দেওয়া হবে নতুন সংস্থাকে। সেই সঙ্গে আগের পরিষদের অস্থায়ী কর্মীরা যাতে সরকারি বিধি মেনে সব সুবিধে পান, সেই ব্যবস্থাও করবে রাজ্য।
এর পাশাপাশি মোর্চার বক্তব্য, তরাই-ডুয়ার্সের কিছু এলাকাকে সংস্থার আওতায় আনার যে দাবি এত দিন গ্রাহ্যই হয়নি, তা এ বার খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছে সরকার। উপরন্তু, চা বাগান ও অভয়ারণ্যের উপরে কর্তৃত্ব করার দাবি বিবেচনারও আশ্বাস মিলেছে। মোর্চার এক কেন্দ্রীয়
কমিটির নেতার কথায়, “ঘিসিংয়ের আমলের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ও
বাড়তি এলাকা নিয়ে নয়া সংস্থা হচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছেন ‘আন্তরিক’ মুখ্যমন্ত্রী। তা হলে অন্য কোনও বিতর্কে এখনই যাব কেন? মিলেমিশে থাকতে চাই আমরাও।” |
|
|
 |
|
|