এই গ্রহে সবচেয়ে দামি (১০ লক্ষ পাউন্ড) পুরস্কারটি ঘিরে শুরু হয়েছে এক বিতর্ক। খেতাবের দুনিয়ায় খ্যাতির শীর্ষে নোবেল প্রাইজ। যার অর্থমূল্য এখনও ১০ লক্ষ পাউন্ডে পৌঁছয়নি। আর, গণিতে নোবেল নেই বলে নরওয়ে-র আকাদেমি অব সায়েন্স ২০০৩ সাল থেকে চালু করেছে যে আবেল প্রাইজ, তা তো ১০ লক্ষ ডলারেরও কম। সুতরাং, ১০ লক্ষ পাউন্ড অর্থমূল্য যে পুরস্কারের, তা লক্ষণীয় বইকী। গ্ল্যামারে না-হয় তা হলই বা কম। সেই টেম্পলটন প্রাইজ নিয়েই বিতর্ক।
পুরস্কারটি শুরু হয়েছে ১৯৭৩ সাল থেকে। প্রথম বছরে পেয়েছিলেন মাদার টেরিজা। তখন তিনি পৃথিবীবিখ্যাত নন। থাকেন কলকাতায়, তবু তখন রাজনীতি-ফুটবল-মাতোয়ারা এ শহরে তাঁকে বেশি কেউ চেনে না। তিনিই প্রথম টেম্পলটন প্রাইজ প্রাপিকা। তার পর বেশ কয়েক বছর ধরে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে সেই সব ব্যক্তিত্বকে, যাঁদের সঙ্গে ধর্মের বলা ভাল, শুধু খ্রিস্ট ধর্মের যোগ প্রবল। যেমন বিলি গ্রাহাম। নানা বিতর্কে গির্জার পক্ষে সওয়াল করার জন্য যিনি একদা বিখ্যাত হয়েছিলেন। পুরস্কার প্রাপক নির্বাচন নিয়ে বলার কিছু থাকতে পারে না। কারণ, এ ক্ষেত্রে যোগ্যতা স্পষ্ট ভাবে বলা আছে ‘একসেপশনাল কনট্রিবিউশনস টু লাইফস স্পিরিচুয়াল ডাইমেনশনস’। জীবনের আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী অবদানের জন্য নির্ধারিত এই পুরস্কার। সুতরাং, মমতার মূর্ত প্রতীক যিনি, অথবা যিনি ধ্বজা ধরেন ধর্মচিন্তার, তারা তো এই প্রাইজ পাবেনই। ইদানীং শুরু হয়েছে নতুন এক ধারা। তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে এ বছর। এ বার টেম্পলটন প্রাইজ পেয়েছেন বর্ষীয়ান ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যর মার্টিন রিস। ইংল্যান্ডে অ্যাস্ট্রনমার রয়াল। এবং রয়্যাল সোসাইটি-র প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। |
২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত পর পর ছ’বছর এই পুরস্কার পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গত বছরও তা পেয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতত্ত্ববিদ ফ্রানসিসকো আয়লা। কেন?
প্রশ্নটির উত্তরে ফিরতে হবে টেম্পলটন প্রাইজের ইতিবৃত্তে। এ পুরস্কার দেয় জন টেম্পলটন ফাউন্ডেশন। যার সদর দফতর আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরের অদূরে। ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠাতা জন মার্কস টেম্পলটন। ৯৫ বছর বয়েসে মারা গিয়েছেন ২০০৮-এর জুলাই মাসে। টেনেসি প্রদেশে উইনচেস্টার শহরে নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জন শেয়ার কেনাবেচায় বনেছিলেন ধনকুবের। তারই সামান্য অংশ দিয়ে গড়েছিলেন যে তহবিল, তা আজ দাঁড়িয়েছে ২১০০ কোটি ডলারে। টেম্পলটন প্রাইজ আসে ওই ভাণ্ডার থেকে। প্রথম থেকেই পুরস্কারদাতার বাসনা ছিল, তাঁর নামাঙ্কিত প্রাইজের অর্থমূল্য যেন নোবেলকেও ছাপিয়ে যায়। নিজেকে এক জন ‘উৎসাহী খ্রিস্টান’ বলতেন টেম্পলটন। ধর্ম বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন তিনি। আর, ছিল এক বিশেষ ধারণা। টেম্পলটন মনে করতেন, ধর্ম কেবল কিছু স্থবির চিন্তার সমষ্টি হতে পারে না। তার বিবর্তন বা উত্তরণ সম্ভবই নয়, প্রয়োজনীয়ও বটে। কীসের অভিঘাতে ঘটতে পারে সেই পরিবর্তন? বিজ্ঞান।
১৯৮০-র দশকের শেষে টেম্পলটনের মনে হল, বিজ্ঞানের নানা শাখায় নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে ধর্মের সঙ্গে তার ‘ডায়ালগ’ হয়ে পড়েছে জরুরি। সহমর্মিতা কি জীবরাজ্যে টিকে থাকার যুদ্ধে এক অভিশাপ? বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কি কেবলই পদার্থকণার আকর্ষণ-বিকর্ষণের অর্থহীন খেলা? প্রাণ বস্তুটা কি তুচ্ছ রাসায়নিক বিক্রিয়া? বিজ্ঞান যদি এমন সব মহার্ঘ প্রশ্নের উত্তরে উদ্যত হয়, তা হলে তো মানতেই হয়, বিজ্ঞানীরা প্রবেশ করেছেন আধ্যাত্মিকতার অন্দরমহলে। টেম্পলটন ভাবলেন, বিজ্ঞানীরা তাঁর বন্ধু। তাঁর ভাল লাগল বিজ্ঞানীদের ‘বিনম্র দৃষ্টিভঙ্গি’। তিনি বললেন, ‘প্রায় সব গবেষকই মানেন যে, তিনি জানেন সামান্য, জানতে চান অনেক।’ টেম্পলটন ফাউন্ডেশনের আপ্তবাক্য স্থির হল: ‘হাউ লিটল উই নো, হাউ ইগার টু লার্ন’। ওই স্লোগান থেকে টেম্পলটন ফাউন্ডেশন নামল নতুন কর্মকাণ্ডে। অনুদান দিল নানা উদ্যোগে। বই প্রকাশ, গবেষণা, সেমিনার ইত্যাদি। ওই ফাউন্ডেশনের অর্থে আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছে গবেষকদের সবচেয়ে নাম করা সংগঠন আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স।
এ-সব উদ্যোগ মোটেই ভাল চোখে দেখেননি একদল বিজ্ঞানী। শিকাগো ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী জেরি কইন বলেছেন, ওই সংস্থা ‘ক্রিয়েশনিস্টদের (যারা বিশ্বাস করে জগতের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর) চেয়েও ধান্দাবাজ’। তাঁর মন্তব্য: ‘ওরা বলেন বটে যে ওরা বিজ্ঞানের দলে, কিন্তু ধর্মবিশ্বাসকে জাহির করতে চান মহান গুণ হিসেবে। ধর্মের ভিত্তি গোঁড়ামি আর অন্ধবিশ্বাস। বিজ্ঞান এগোয় সন্দেহ আর জিজ্ঞাসায়। ধর্মে সব কিছু মেনে নেওয়া পুণ্য। বিজ্ঞানে পাপ।’
এ হেন মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে স্যর মার্টিন-এর পুরস্কারপ্রাপ্তি যে বিতর্কে নতুন ইন্ধন জোগাবে, তাতে আর আশ্চর্য কী। তাঁর গবেষণা বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ে। বিগ ব্যাং, ব্ল্যাক হোল ইত্যাদি নিয়ে। ব্রহ্মাণ্ড শুধু এই একটাই, নাকি আছে অগুনতি, সে প্রশ্নেও মাথা ঘামান তিনি। পুরস্কারের জন্য তাঁকে নির্বাচন করে টেম্পলটন ফাউন্ডেশন-এর তরফে বলা হয়েছে, ‘তিনি মানুষের জ্ঞানের পরিধি বহু দূর বিস্তৃত করেছেন। বাস্তব সত্য কত বড়? এই প্রশ্ন তুলে তিনি জীবনের মূলে দার্শনিক এবং ধার্মিক ভাবনাগুলিতে নাড়া দিয়েছেন।’
বিতর্ক বাড়িয়েছেন রিস নিজেও। সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি নিজে ধর্মবিশ্বাসী নন। তবে, কেমব্রিজে ট্রিনিটি কলেজ-এর মাস্টার হিসেবে চার্চে যান। সেখানকার বৃন্দগান তাঁর ভাল লাগে। আর, ধার্মিক না হলেও, ধর্ম সম্পর্কে তাঁর কোনও অ্যালার্জি নেই। সতীর্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং গত বছর বই লিখে যখন ঘোষণা করেন যে ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের মূলে কোনও ঈশ্বরের হাত নেই, তখন রিস মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি স্টিফেনকে এতটা চিনি যে বলতে পারি, ও দর্শন আর ধর্ম নিয়ে মোটেই পড়াশুনো করেনি। তাই আমি মনে করি না যে ওঁর মতের কোনও গুরুত্ব আছে। ও-সব ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। বিজ্ঞানীরা কিছু বললে আমার মনে হয় বোকামি।’ রিস মনে করেন, বিজ্ঞানে মগ্ন থেকে তিনি যা শিখেছেন, তা হল সহজতম জিনিসও বোঝা কঠিন। ফলে যাঁরা বাস্তবের কোনও গভীর দিক সম্পর্কে বেশি বুঝেছেন বলে দাবি করেন, তাদের তিনি সন্দেহের চোখে দেখেন।
বিজ্ঞানী হয়েও ধর্ম বিষয়ে স্যর মার্টিনের সহিষ্ণুতায় খেপে গিয়ে কট্টর নাস্তিক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স এক বার তাঁকে বলেছিলেন ‘কমপ্লায়েন্ট কুইসলিং’ বা ‘বশংবদ বিশ্বাসঘাতক’। আর এখন তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আরেক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী নোবেলজয়ী হ্যারি ক্রটো মন্তব্য করেছেন, ‘দশ লক্ষ পাউন্ডের টোপ দিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের গাঁথার চেষ্টা করা হলে কেউ কেউ যে বলবেন তাঁরা বিজ্ঞান আর ধর্মে কোনও সংঘাত দেখেন না, সেটা অভাবনীয় নয়। তবে, যাঁরা তা বলেন, তাঁরা ভুগছেন ইনটেলেকচুয়াল স্কিৎজোফ্রেনিয়ায়।’
রিস যে গালমন্দের শিকার হয়েছেন, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা অন্য। বিজ্ঞান কি আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে পারে? |