প্রবন্ধ ১...
সংকটে হলদিয়া পেট্রোকেম, আশু হস্তক্ষেপ জরুরি
শুধু রাজ্য সরকারই ঋণের সমস্যায় জর্জরিত নয়, দেউলিয়া হওয়ার পথে রাজ্যের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শিল্পসংস্থাও। যার নাম হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস, যার অন্যতম মালিক পশ্চিমবঙ্গ সরকার। রাজ্য সরকারের কেন্দ্র এবং প্রণব মুখোপাধ্যায় আছে। হলদিয়ার? রাজনীতির দ্বৈরথে রাজ্যের বেহাল অর্থনীতি এবং শিল্পও তো যুযুধান দুই পক্ষের বাহন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ব্রাত্য থেকে গিয়েছে হলদিয়ার সমস্যা। স্বাভাবিক। কারণ রাজনীতির আঙিনায় লাভক্ষতির কচকচানি ভোট টানে না। রুগ্ণ শিল্পের রোগ সারানোর যুদ্ধে ‘বাইট’ মেলে না। তাই রুগ্ণ হওয়ার পরেই শিল্প রাজনীতির যুদ্ধে স্থান করে নেয়। কে না জানে, জীবিত রাজনৈতিক কর্মীর থেকে শহিদের ভিড় টানার ক্ষমতা অনেক বেশি।

তাই আজকের রাজনীতির স্লোগানে মৃতপ্রায় হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের কোনও দম নেই। কিন্তু এটাও ঠিক যে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস জর্জরিত তার প্রধান দুই মালিক পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতবিরোধে। এতটাই যে, আজ রাজ্য সরকারের মতোই পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ইতিহাসে লগ্নির এই বিরল উদাহরণ হিসাবে বর্ণিত সংস্থাটি ঋণ করছে ঋণ শোধ করতে। এই পরিস্থিতিতে এখনই আয় না বাড়ালে দুর্ভোগ প্রচুর। ঠিক রাজ্য সরকারের মতোই। এবং সংস্থার জিয়নকাঠিটা এখন রাজ্য সরকারের হাতেই।

পিছিয়ে যাওয়া যাক ২০০০-০১ সালে। সংস্থার অর্থ সংকটের সূত্রপাত ৯৭৯ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে। প্রাথমিক ভাবে ঠিক ছিল ৫১৭০ কোটির প্রকল্পে ১৯৭৯ কোটি টাকা আসবে শেয়ার বেচে। বাকি ৩১৯১ কোটি টাকা তোলা হবে ঋণ করে। ১৯৭৯ কোটি টাকার মধ্যে চ্যাটার্জি গোষ্ঠী ও রাজ্য সরকার দেবে ৪৩৩ কোটি টাকা করে, টাটা গোষ্ঠী দেবে ১৪৪ কোটি টাকা, বাকি টাকাটা তোলা হবে বাজারে শেয়ার ছেড়ে। কিন্তু এই সময় শেয়ার বাজারে শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী মন্দা। ফলে শেয়ার বেচে টাকা তোলার চিন্তা শিকেয় তুলে ৩৯৭৯ কোটি টাকার ঋণের সঙ্গে আরও ৯৭৯ কোটি টাকা তুলতে হয়। ১৭ শতাংশ সুদে!

এর পরে পূর্ণেন্দুবাবু চান সুদের ভার কমানোর জন্য বিদেশের বাজারে কম সুদে টাকা তুলে বেশি সুদের ঋণ মিটিয়ে দিতে। কিন্তু রাজ্যের অর্থ দফতর ভিন্ন মত পোষণ করায় ১৭ শতাংশ হারেই সুদ দিতে থাকে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস। বিরোধ শুরু হয়। অনেকেই মনে করেন, এই বিরোধের মূলে যতটা না যুক্তি তার থেকেও বেশি রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী এবং পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিত্বের লড়াই। তবে এখনও পর্যন্ত দুই শরিকের প্রস্তাবের মধ্যে পূর্ণেন্দুবাবুর দিকে যুক্তির পাল্লা যে একটু বেশি ভারী, তা অস্বীকার করা যায় না।

এর পরে স্থির হয়, কিছু শেয়ার ইন্ডিয়ান অয়েলকে বিক্রি করে সেই টাকায় ঋণের বোঝা কমানো হবে। প্রাথমিক ভাবে মেনে নিলেও পরে চ্যাটার্জি গোষ্ঠী বেঁকে বসে ইন্ডিয়ান অয়েলকে শেয়ার বিক্রির শর্ত নিয়ে, এবং সমস্যাটা আদালতে গিয়ে পৌঁছয়। রাজ্য সরকার সংস্থায় তাদের শেয়ার চ্যাটার্জি গোষ্ঠীকে বিক্রিও করে দিতে চায়। কিন্তু যে দামে সরকার তা বিক্রি করতে চেয়েছিল, সংশ্লিষ্ট মহলের মতে সেই দাম ঋণের বোঝার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বেশি। কিন্তু নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর-উত্তর পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের পক্ষে দাম কমিয়ে বিক্রি করা সম্ভব ছিল না। তা মানত না আলিমুদ্দিন। এখন ব্যাপারটা আদালত ও মহাকরণের উপর নির্ভর করে রয়েছে।

হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের দায় এই মুহূর্তে ২০০০ কোটি টাকার দীর্ঘকালীন ঋণ আর দৈনন্দিন খরচ (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) মেটানোর খাতে নেওয়া ১৩০০ কোটি টাকার ঋণ। আয় আর ঋণ শোধের দায় এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে নগদ আয় ও ধার শোধের অনুপাত এখন ০.৬, কিংবা, ১ : ১.৬৬। অর্থাৎ, নগদ যে টাকা ঘরে আসে তার ১৬৬ শতাংশ যায় ধারের দায় মেটাতে। এক কথায়, ধার মেটাতে আশ্রয় নিতে হচ্ছে আরও ধারের। এই ভাবে কোনও সংস্থার পক্ষেই চালানো সম্ভব নয়।

প্রশ্ন উঠছে, যে রাজ্য সরকার টাটাদের আনতে নানান উৎসাহ-ছাড় দিয়েছে সেই সরকারই হঠাৎ নিজের সংস্থার পায়ে কুঠারাঘাতে উদ্যত হল কেন? ঠিক, আজকের দুনিয়ার রাজ্যে লগ্নি টানতে নানা ছাড় দিতে হয়। যে রাজ্যে বিনিয়োগ টানা রাজনৈতিক কারণেই সমস্যা, সেই রাজ্যকে তো পেতে গেলে ছাড়তে হবে অনেকটাই। ফলে টাটাদের হাতেও তুলে দিতে হয়েছে অনেক কিছুই। কিন্তু, হলদিয়ার সঙ্গে বিমাতৃসুলভ আচরণ কেন?

হলদিয়া তৈরি হওয়ার পরে রাজ্য সরকার সংস্থাকে বিক্রয়কর ছাড় দেয় শর্তসাপেক্ষে। বলা হয়েছিল, ৬২৫০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি বা ১২ বছর, যেটা আগে হবে তার উপরে সম্পূর্ণ বিক্রয়কর ছাড় মিলবে। কিন্তু ২০০৬ সালে হঠাৎ হলদিয়াকে তেল প্রস্তুতকারক সংস্থা হিসাবে ঘোষণা করে দেয় রাজ্য। মজার ব্যাপার, কেন্দ্র যে হিসাবে একটি সংস্থাকে তেল প্রস্তুতকারক হিসাবে আখ্যা দেয় সেই হিসাবে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস কখনই তেল সংস্থা হিসাবে গ্রাহ্য নয়।

প্রশ্ন সেখানে নয়। অবাক ব্যাপার, প্রতিশ্রুতি দিল সরকার। তার ভিত্তিতে একটা সংস্থা পরিকল্পনা করল। তার পর মাঝরাস্তায় সেই প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে অন্য রাস্তায় হাঁটা শুরু করল সেই সরকারই। ২০০৬ সালে যখন সরকার হঠাৎ এই ঘোষণা করল তখন সংস্থার পণ্য বিক্রির পরিমাণ ১৭০০ কোটি টাকা। ১২ বছরের অঙ্ক তো আরও ৬ থেকে ৭ বছর দূরে। ভাঙল প্রতিশ্রুতি। যার উপর নির্ভর করে সংস্থাটি তার আর্থিক পরিকল্পনা করে ফেলেছিল। কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে সংস্থাটি হারাতে শুরু করল ৩৬০ কোটি টাকা। প্রতি বছর। যে সংস্থা নানান বিবাদে জেরবার তার উপরে এক শরিকের চাপিয়ে দেওয়া এই দায় কোথাও গিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে রাজ্যে শিল্প ভাবনা নিয়েই।

এখন বাঁচার জন্য সংস্থা চাইছে, বিক্রয় করের ছাড় ফিরে পেতে। কোষাগারে যা গিয়েছে তা তো গিয়েইছে। কিন্তু এখন যদি শুধু কর ছাড় থেকেই ৩৬০ কোটি টাকা সংস্থাটি পায় তা হলে এক ধাক্কায় ঋণ করে ঋণ শোধের জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে খানিকটা হাত-পা মেলার জায়গা পাবে। এর ফলে নগদ আয়ের হিসাব দাঁড়াবে ঋণ শোধের দায়ের দেড় গুণ। অর্থাৎ হাতে কিছু নগদ আসবে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য।

কেন্দ্রের সঙ্গে ন্যাপথার উপর কর নিয়েও সংস্থা লড়াই করছে। কারণ এই করের বোঝা যে ভাবে চেপেছে তাতে দায় মূলত চেপেছে হলদিয়ার ঘাড়েই। কিন্তু তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউই বলতে পারে না। কিন্তু এই সংস্থা তো রাজ্য সরকারেরও। তাই হলদিয়া মনে করছে এই দাবিটা অনেক সহজে মেটানো সম্ভব। রাজ্য সরকারেরই দাবি, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে সংস্থাটি প্রায় ২ লক্ষ কর্মসংস্থান করেছে। তৈরি হয়েছে প্রায় ৭০০ ছোট সংস্থা যারা হলদিয়ার উপর নির্ভরশীল। শিল্পমহল একমত, যে ভাবে সময় মতো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে তা অভূতপূর্ব। সংস্থার প্রযুক্তিও যে আধুনিক তা নিয়েও মতভেদ নেই। তা হলে? সংস্থাটি বাঁচতে চাইছে বাজারের নিয়মে প্রতিযোগিতায় থেকেই। তার তো চাহিদা একটাই, সরকার যাতে বিমাতৃসুলভ আচরণ করে তার বাজারে টিঁকে থাকার ক্ষমতা কেড়ে না নেয়। সেটা কি খুব অন্যায়?
Previous Item Editorial Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.