|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
তবু বদলায় না |
পরিবর্তন মানে কি শুধু মুখ ও মুখোশের পরিবর্তন, স্বভাব ও চরিত্রের নয়? পোশাকের রঙ আর মুখোশের ঢঙ বদলাইলে একটা পরিবর্তন হয় বটে, তবে সেটা কোনও মৌলিক পরিবর্তন নয়, নিছকই প্রসাধনী পরিবর্তন। রাজ্যের শাসনক্ষমতা হইতে বামফ্রন্টের বিদায় এবং তৃণমূল কংগ্রেসের অভিষেকের মধ্যে অনেকে শাসনপ্রণালীর মৌলিক পরিবর্তনের যে সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন, সম্ভবত তাঁহাদের হতাশ করিতেই তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদ নেতৃত্ব জানাইয়া দিল, সব কিছু আগের মতোই আছে, থাকিবে। কেবল বাম ছাত্র ইউনিয়নের স্থলে তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদ কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে দাপাইয়া বেড়াইবে। অন্যথায় যে তৃণমূল কংগ্রেস ২০০৮ সালের আগে ছাত্র-রাজনীতি লইয়া তত মাথা ঘামায় নাই, লোকসভা নির্বাচনে চমকপ্রদ সাফল্যের পর হইতেই তাহারা ছাত্র রীজনীতিতে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করিতে এত তৎপর হইল কেন? সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেসু) ইউনিয়ন খোলার দলীয় সিদ্ধান্তেও সেই তৎপরতারই প্রতিফলন।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন যে এই রাজ্যে অধঃপাতে গিয়াছে, তাহার অন্যতম কারণ এখানকার হিংসাত্মক ছাত্র রাজনীতি, যাহা দলীয় রাজনীতিরই পাঠশালা বা প্রশিক্ষণ-শিবির রূপে ব্যবহৃত হয়। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় খোলাখুলিই জানাইয়াছেন— প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর ও বেসু-তে রাজ্যের শ্রেষ্ঠ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাই ভর্তি হয়, তাই তাহাদের মধ্য হইতে ভবিষ্যতের ভাল নেতা গঠন করা সহজ। অর্থাৎ পঠনপাঠনের সহিত সম্পর্করহিত রাজনীতির পাঠশালা রূপেই এই সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দেখা হইতেছে, যাহা ভবিষ্যতের দলীয় নেতা সরবরাহ করিবে। বামপন্থীরাও এ ভাবেই ছাত্র-রাজনীতিকে কাজে লাগাইয়াছেন। স্বভাবতই দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতা, মারমুখী, আগ্রাসী মনোভাব ও অসহিষ্ণুতা ছাত্র-রাজনীতিকেও আচ্ছন্ন করিয়াছে। ছাত্র সংসদের দখল লইয়া মারপিট, বোমাবাজি সর্বদা কলেজ চত্বরে কিংবা ছাত্রদের মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকে নাই। স্থানীয় দুষ্কৃতীরা তাহাতে জড়াইয়া পড়িয়াছে এবং খুনোখুনি পর্যন্ত তাহা গড়াইয়াছে। এই পরিস্থিতি সমগ্র বামফ্রন্ট আমলেই ছাত্র-রাজনীতিকে কলঙ্কিত করিয়াছে। ছাত্রদের রাজনীতি করার গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে ইউনিয়ন নেতারা ছাত্র-ভর্তি ও ক্যান্টিন-কমনরুমের দখল হইতে প্রতিটি প্রশাসনিক বিষয়ে নাক গলাইয়াছেন, শিক্ষার্থীদের দলীয় মিছিলে হাঁটিতে বাধ্য করিয়াছেন, ফেল-করা ছাত্রদেরও পাশ করাইয়া দিবার জেদে অধ্যক্ষকে ঘেরাও করিয়া রাখিয়াছেন।
প্রত্যাশা ছিল, তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব, বিশেষত তাহার শীর্ষ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব বিষয়েই নূতন পথে হাঁটিতে ইচ্ছুক। বিশেষত যে সব সাবেকি বঙ্গীয় ঐতিহ্য রাজ্যের উন্নয়ন ও বিকাশের গতি রুদ্ধ করিয়া রাজ্যকে একটি অচলায়তনে পরিণত করিয়াছে, তিনি সেগুলি সযত্নে পরিহার করিতে ব্যগ্র। সর্ব স্তরের শিক্ষাকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট হইতে নিয়ন্ত্রণ করার কালোত্তীর্ণ ঐতিহ্য তেমনই একটি বর্জনীয় আবর্জনা। কিন্তু ইহাকে বর্জন করিয়া শিক্ষা ক্ষেত্রে সুপবন প্রবাহিত করাইতে হইলে ছাত্র-রাজনীতির চোরাবালি হইতেও ছাত্রসমাজকে উদ্ধার করা দরকার। ছাত্র-সংসদ দখল করিয়া সেখানে দলীয় রাজনীতির পতাকা উড়াইবার কোনও প্রয়োজন নাই। আগামী দিনের নেতা তৈরির আখড়া রূপেও ছাত্র-সংসদকে ব্যবহার করা সমীচীন নয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কারখানা নয়, মেধার উৎকর্ষ সাধনের আলয়। রাজনীতি যে যূথবদ্ধ আনুগত্য ও আজ্ঞাবহতা দাবি করে, মেধার বিকাশের সহিত তাহার মৌলিক বিরোধ আছে। |
|
|
 |
|
|