|
|
|
|
প্রবন্ধ ৩... |
মুখ্যমন্ত্রী রোগীদের প্রত্যাশা বাড়িয়েছেন |
সরকারি হাসপাতালে সাড়া ফেলে দিয়েছেন তিনি। আরও কয়েকটি কাজ তাঁর করা দরকার।
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
কলকাতার সরকারি হাসপাতালে সাড়া ফেলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রোগীদের প্রত্যাশা বেড়েছে বিপুল ভাবে। সেটা স্বাভাবিক। এমন দুমদাম করে কে আর কবে মুখ্যমন্ত্রীকে হাসপাতালে এসে খোঁজখবর নিতে দেখেছেন? এত হাতের কাছে পেয়েছেন? সরাসরি বলতে পেরেছেন, “দেখুন না, আমার রোগীটাকে ভর্তি করছে না।” অদৃশ্যপূর্ব এই আগমনের ধাক্কায় সরকারি হাসপাতালও বাধ্য হয়ে ধুলোটুলো ঝেড়ে, চোখ কচলে উঠেছে। এগারোটার জায়গায় সকাল ন’টায় আউটডোরে ডাক্তারবাবুরা চলে আসছেন। দেড়টায় চলে না-গিয়ে চারটে পর্যন্ত থাকছেন, আন্তর্জাতিক জার্নালে পেপার প্রকাশ বা বিদেশে সেমিনার নিয়ে মাথা কম-ঘামিয়ে রোগী দেখায় মন দিচ্ছেন, চার বছর ধরে ভেঙে পড়ে থাকা মেশিন সারানোর কথা কর্তৃপক্ষের হঠাৎ মনে পড়ে যাচ্ছে, ফার্মাসিতে ওষুধ আসছে, বিছানার চাদর বদলাচ্ছে, ময়লা সাফ হচ্ছে, রোগীদের জন্য রান্না করা মাছের পিস রাতারাতি বড় হয়ে গিয়েছে, সুপার-ডেপুটি সুপাররা নিয়ম করে ওয়ার্ড ভিজিট করছেন। শনি-রবিবার বিকেলে হাসপাতালে ডাক্তার থাকার বিরল দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, অপারেশনের জন্য রোগীকে বেশি ক্ষণ ফেলে রাখা হচ্ছে না। ব্লাডব্যাঙ্কে রক্ত পাওয়া যাচ্ছে! যে সব হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে ঘুরে এসেছেন তারা কাজ করছে, যদি মুখ্যমন্ত্রী ‘আবার’ না-বলে চলে আসেন, সেই ভয়ে। আর যেখানে মুখ্যমন্ত্রী এখনও যাননি তারা কাজ শুরু করেছে যে কোনও দিন মুখ্যমন্ত্রী চলে আসবেন, এই আশঙ্কায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চলে আসতে পারেন, কিছু দিন ধরেই শুনছিলেন কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের সুপার। মনে রোজই উৎকণ্ঠা। এক দিন ঘরে বসে আছেন। এমন সময় এক জন দৌড়তে দৌড়তে এসে খবর দিল, “স্যার, এসে গেছেন!”
কে?
মুখ্যমন্ত্রী!
তড়াক করে লাফিয়ে সুপার বললেন, “কোথায় আছেন? ইমার্জেন্সিতে?”
না স্যার। তিনতলায় আইটিইউ-তে!
সুপার পড়িমরি ছুটলেন। গিয়ে দেখেন অপারেশন চলছে। না, মুখ্যমন্ত্রী মোটেই দাঁড়িয়ে অপারেশন দেখছেন না। তিনি নেই। কিন্তু হাসপাতালের বাতাসে তত ক্ষণে তাঁর আসার ‘খবর’ বইতে শুরু করেছে। চত্বরে থিকথিকে ভিড়। সুপার হাঁফাতে-হাঁফাতে নীচে এলেন। মুখ্যমন্ত্রী সেখানেও নেই।
কে এই সব ভুলভাল রটিয়েছে? গুলি করে দেওয়া উচিত।
কানের কাছে মুখ এনে এক জন বলল, “ভালটাও দেখুন স্যার। ইমার্জেন্সিতে তিনটে সিরিয়াস পেশেন্ট পড়ে ছিল। বাবুরা কিছুতেই ভর্তি নিচ্ছিলেন না। রেফার করার তালে ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী আসার খবরেই সাত মিনিটের মধ্যে তিন জন ভর্তি হয়ে গিয়েছেন!” |
 |
সরকারি হাসপাতালে গেলেই পরিচিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের একটাই প্রশ্ন, “আর কত দিন এই রকম চলবে? মমতা সব ছেড়ে হঠাৎ হাসপাতাল নিয়ে পড়লেন কেন? রোজ কারও না কারও পালা পড়ছে। কী টেনশন রে বাবা! দিদি কি শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্যটা নিজের হাতেই রাখবেন?” সত্যি তো। অনভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়ার চাপ তো অস্বীকার করা যায় না। এ যেন পরীক্ষার হলে কড়া গার্ডের মতো। ঘুরছেন তো ঘুরছেনই। কিছুতেই টোকা যাচ্ছে না।
মুখ্যমন্ত্রীর ‘মিশন-হসপিটাল’-এর প্রথম পর্ব সফল। অভিনব পন্থা। মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিটাই মোক্ষম কাজ করেছে। তবে এ বার এগোনো দরকার পর্বে-পর্বে, সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্কের মতো ধাপে-ধাপে একটা-একটা সমস্যা ভেঙে, প্রত্যেকটা অসুবিধার শিকড় পর্যন্ত গিয়ে। দশ-বিশ মিনিটের ঝটিকা সফরে সেটা কতটা সম্ভব? আসলে গলদ যে রয়েই গিয়েছে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযানের ভয়ে উপর-উপর ফাঁকফোকরগুলো হয়তো ভরাট হচ্ছে, ভিতরটা কিন্তু ফাঁপাই থেকে যাচ্ছে। শয্যাও রাতারাতি বাড়ছে না, চিকিৎসক-নার্স-টেকনিশিয়ানও বেড়ে যাচ্ছে না, দরপত্র করে ওষুধ সব এক্ষুনি চলে আসছে না, কিন্তু রাতারাতি ভাল পারফরমেন্স দেখানোর চাপ বাড়ছে। ফলে মুখ্যমন্ত্রী ঘুরে যাওয়ার পর কয়েক দিন পর্যন্ত সব ভাল-ভাল থাকছে, তার পরেই যথাপূর্বম্।
হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরে গেলে যদি মুখ্যমন্ত্রী রেগে যান, এই আতঙ্কে কোনও মেডিক্যাল কলেজই এখন রোগী ফেরাচ্ছে না। কিন্তু তার ফল? এক-একটি হাসপাতালের মেঝেতেই ভর্তি হয়ে গিয়েছেন ৭৮-৯০ জন রোগী। ডাক্তার-নার্সরা ওয়ার্ডে হাঁটতেই পারছেন না, পরিষেবা দেবেন কী! কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজ তো নার্সদের বসার টেবিলেও রোগী রেখেছে! এই ভাবে কি সত্যি কিছু বদলাবে?
কী হলে বদলাবে? মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী একটু ভেবে দেখুন না দয়া করে, সকাল বা দুপুরের বদলে রাতে মহাকরণে কাজকর্ম শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে যদি এক-এক দিন কোনও হাসপাতালে যেতে পারেন। তখন আউটডোরের ভিড় থাকবে না। অত্যুৎসাহীদের ঠেলাঠেলি কম থাকবে। বোধহয় অনেকটা ফাঁকায় ওয়ার্ডে ঘুরে রোগী, চিকিৎসক, নার্সদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। কথা বলতে পারবেন খোলা আকাশের নীচে কাগজ পেতে শুয়ে থাকা রোগীর আত্মীয়দের সঙ্গেও। আর একটা কথাও সত্যি। রাতে ন্যূনতম কর্মী নিয়ে কোন হাসপাতাল কতটা পরিষেবা দিতে পারছে তার থেকেই তার প্রকৃত কর্মক্ষমতা আঁচ পাওয়া যায়। সেটাও আন্দাজ করতে পারবেন।
জানেন, আপনার হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় ভিড়ের মধ্যে রোগীরা অনেক কিছু আপনাকে বলতে পারছেন না, যা তাঁরা জানাতে চান। রোগী-পরিষেবা মানে শুধু চিকিৎসা নয়। পাশাপাশি দরকার অনুভূতি, সহযোগিতা, মানবিকতা। আমাদের সরকারি হাসপাতালে যার বড় অভাব। দূর-দূর গ্রাম থেকে অল্পশিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞানহীন, গরিব মানুষগুলো চিকিৎসার জন্য অপরিচিত শহরে আসছেন। হাসপাতালেই পৌঁছচ্ছেন হাতড়াতে-হাতড়াতে। এত বড় শহর, সব কিছু নতুন, সঙ্গে আবার অসুস্থ পরিজন। ছড়ানো-ছেটানো হাসপাতালে কোথায় কার্ড করাবেন, কোথায় আউটডোর, কোথায় কোন ডাক্তার, কোথায় ওষুধ, কোন জায়গায় রক্ত, থুতু পরীক্ষা বা স্ক্যান করতে হবে, কোথা থেকে রক্ত আনতে হবে, তাঁরা কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। দিশেহারা হয়ে যান। এক বারের বেশি দু’বার কিছু জিজ্ঞাসা করলে বেশির ভাগ ডাক্তারবাবু তাঁদের ধমক দেন। স্পষ্ট করে জানান না রোগীর ঠিক কী হয়েছে। হামেশাই এক মেডিক্যাল কলেজ আর এক মেডিক্যাল কলেজে রোগী রেফার করে দেন। আর জি কর থেকে কী করে এস এস কে এম বা নীলরতন যাবেন বুঝে উঠতে পারেন না অনেকেই। কলকাতার রাস্তাঘাট চেনেন না। শয্যার জন্য কাকে গিয়ে তদবির করতে হবে বুঝতে পারেন না, পড়েন দালালের খপ্পরে। এঁদের জন্য একটা হেল্প ডেস্ক খুব দরকার। বাম জমানায় এক বার পরিকল্পনা হয়েছিল এই রকম ডেস্কের, কিন্তু তেমন ভাবে রূপায়ণ হয়নি।
আপনি নিশ্চয়ই বোঝেন, ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসক যদি তাঁর হাতটা একটু রোগীর কপালে রাখেন তা হলেই রোগী উপশম বোধ করেন। ব্যাপারটা অনেকটাই মানসিক। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে হাজার-হাজার রোগীকে আলাদা করে সময় দেওয়াটা চিকিৎসক বা নার্সদের পক্ষেও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বাড়ির লোকের হয়তো মনে হচ্ছে, রোগীকে ডাক্তার ভাল করে দেখছেন না, স্যালাইনটা ঠিকঠাক লাগানো হয়নি, ওষুধটা খাওয়ানো হয়নি। কিন্তু কাউকে বলার সাহস পাচ্ছেন না। এঁদের সাহায্য করার জন্য কি কিছু কর্মী আলাদা করে নিয়োগ করা যায় না? নেওয়া যায় না স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাহায্য?
সরকারি হাসপাতালে ট্রলি ঠেলার লোক নেই, আউটডোরে অনেক সময় এক জন রোগীকে পাঁচ মিনিট সময়ও দেন না চিকিৎসক, কোচবিহার-জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি হতে এসে সাত বার-আট বার ডেট নিয়ে ফিরে যেতে হয় গুরুতর অসুস্থকে, আউটডোরে সকাল ন’টায় এসে ডাক্তার দেখানোর জন্য বেলা দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করে অবশেষে মারা যেতে হয় গুরুতর অসুস্থকে, দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন অনেকে, মাথায় চোট পাওয়া রোগীকে, সদ্য-প্রসূতিকে শিশু-সমেত শুয়ে থাকতে হয় হাসপাতালের মাটিতে। এখানে পেস্ট
কন্ট্রোলের ওষুধে হাসপাতালের শয্যার ছারপোকা-আরশোলা মরে না, হাসপাতালে ওষুধ পান না দারিদ্রসীমার নীচে থাকা রোগী, বায়পসি টেস্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তিন মাস, অ্যাপেনডিক্স ফেটে যাওয়ার পরও দু’দিন অস্ত্রোপচার হয় না রোগীর।
এক দিনে এ সব সারবে না, কিন্তু প্রতিকারের একটা উদ্যোগ শুরু করা দরকার এখনই। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রোগীদের অনেক প্রত্যাশা। |
|
|
 |
|
|