হস্টেলের মধ্যেই মদের খালি বোতল, নেশার ট্যাবলেটের মোড়ক, পোড়া গাঁজা, ছিলিম। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পরিবেশ নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মনোজিৎ রায়ের অপমৃত্যু।
সোমবার মনোজিতের জেঠা ইন্দ্রজিৎ রায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে খুনের মামলা রুজু করেছে পুলিশ। ‘দুষ্টচক্রে’র সঙ্গে মিলে ছাত্রদেরই একাংশ ওই খুন করে বলে অভিযোগ। কিন্তু মাদকক্রের রমরমার দায় কেউ নিতে রাজি নয়। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও পুলিশ পরস্পরের উপরে দোষ চাপাচ্ছে।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মনোজিতের মৃত্যু হয় শনিবার রাতে। হায়দরাবাদে চাকরি পাওয়ায় ওই রাতেই তাঁর ট্রেন ধরে বাড়িতে ফেরার কথা ছিল। তাঁর বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে। তদন্তে গিয়ে পুলিশ তাঁর ঘরে একাধিক মাদক, নাইট্রোজেন ট্যাবলেট, মদের বোতল পায়। ঘরটি ‘সিল’ করা হয়েছে। মনোজিতের মোবাইলের ‘কল রেকর্ড’ও পরীক্ষা করছে পুলিশ জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার আনন্দ কুমার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “মনোজিতের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, ওই ছাত্র মাদকাসক্ত ছিলেন। সেই কারণে মৃত্যু হয়েছে কি না, তা ময়নাতদন্তের রিপোর্টেই স্পষ্ট হবে।” |
মনোজিতের জেঠার অভিযোগ, “কলেজের হস্টেলে দুষ্টচক্র চলছে। তারাই মনোজিৎকে মাদক সেবনে বাধ্য করত। তারাই ওকে খুন করেছে।” পরিবারের সঙ্গে জলপাইগুড়ি যাওয়া বসিরহাট ২ পঞ্চায়েতের সমিতির সহ-সভাপতি আবু তাহের মহম্মদ আবদুল্লা বলেন, “কলেজে অবাধে মাদক সরবরাহ করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন প্রহসন বন্ধ করা দরকার।” মনোজিতের মৃত্যুর পরেই অভিভাবকদের একাংশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের দাবি, হস্টেলে নেশার রসদ সরবরাহে যুক্তদের চিহ্নিত করে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। কয়েক জন অভিভাবকের কথায়, “কলেজের অ্যান্টি ড্রাগ কমিটি, ছাত্র সংসদ, টিচার্স কাউন্সিল, স্থানীয় থানা, প্রশাসন, পুরসভা ও পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিরা ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করেছেন কি না, সেটা জানতে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রয়োজন।”
পুলিশের মতেও, কলেজ কর্তৃপক্ষ নজর রাখলে হস্টেলে মদ-মাদকের এমন বাড়বাড়ন্ত হওয়া সম্ভব ছিল না। বস্তুত, রাজ্যের মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, পলিটেকনিক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু হস্টেলে নেশার রমরমা কারওরই অজানা নয়। নতুন ছাত্রছাত্রীরা অনেকে কৌতূহলের বশেই এতে জড়িয়ে পড়েন। অনেকে নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ রেখে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন, কেউ কেউ পারেন না। সাধারণত এঁরাই নেশা কারবারীদের ‘দুষ্টচক্রে’র সহজ শিকার হন।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, ইঞ্জিনিয়ারিং বা পলিটেকনিক কলেজ লাগোয়া ধাবাগুলি মদের আসর হিসাবেই ছাত্রদের কাছে পরিচিত। কিছু টাকা বেশি দিলে হস্টেল চত্বরেও মেলে মদ। প্লাস্টিকে মোড়া গাঁজার পুরিয়ার দাম পাঁচ টাকা থেকে শুরু। একই ভাবে বিক্রি হয় চরসও। শিলিগুড়ি থেকে আসে ব্রাউন সুগারের প্যাকেট। হস্টেল লাগোয়া বেশ কিছু মুদি ও চায়ের দোকানে মেলে নেশা করার ট্যাবলেট। জলপাইগুড়ির সুপার জানান, বিভিন্ন ওষুধের দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই মাদক-জাতীয় ওষুধ বিক্রির খবর পাওয়া গিয়েছে। তিনি বলেন, “জাতীয় সড়ক ও কলেজ লাগোয়া এলাকায় চরস বিক্রিরও খবর মিলেছে। কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” তবে এই পরিস্থিতির জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের ‘উদাসীনতা’কেও দায়ী করছে পুলিশ। তাদের মতে, কর্তৃপক্ষ নজর রাখলে হস্টেলে মদ-মাদকের বাড়বাড়ন্ত হওয়া সম্ভব নয়।
জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ জ্যোতির্ময় ঝম্পটি অবশ্য তা মানতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, “মাদক কারবারীরা যদি কলেজের বাইরে থেকে ছাত্রদের হাতে ওই সব তুলে দেয়, তা কেমন করে আটকানো সম্ভব! পড়াশোনা বাদ দিয়ে কর্তৃপক্ষ কী তাদের পিছনে ঘুরে বেড়াবেন! তবে হস্টেলে কী ভাবে মাদক ঢোকে, তা দেখতে ইতিমধ্যেই কমিটি গড়া হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেও মনোজিৎ-সহ চতুর্থ বর্ষের কয়েক জন ছাত্র কেন বাড়ি ফেরেনি, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” আবার পলিটেকনিক কলেজের অধ্যক্ষ শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের মতে, “এটা সামাজিক সমস্যা। ছাত্রেরা সচেতন না হলে এই প্রবণতা বন্ধ করা যাবে না।”
অভিভাবকেরা ইতিমধ্যেই দাবি তুলেছেন, আগামী শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগেই হস্টেলের পরিবেশ ফেরানো হোক। তার জন্য দ্রুত পরিকল্পনা করতে হবে। জলপাইগুড়ির পুরপ্রধান মোহন বসুও বলেন, “এটা দায় এড়ানোর সময় নয়। অনেক আশা নিয়ে মা-বাবা ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠান। হস্টেলে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার দায়িত্বও সকলেরই। সব পক্ষকে নিয়ে বসতে হবে, যাতে আগামী দিনে আর কারও পরিণতি মনোজিতের মতো না হয়।” |