|
|
|
|
ছোট হয়ে ‘খাঁটি’ হোক পার্টি, চায় আলিমুদ্দিন |
সন্দীপন চক্রবর্তী ² কলকাতা |
সঙ্কটকালে ‘ঘরছাড়া’দের ফেরাতে বেশি উদ্যোগী হবে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। ‘দলছাড়া’দের জন্য নয়।
কঠিন সময়ে যাঁরা দল ছেড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের আর ‘জোর করে’ ফেরাতে চায় না সিপিএম। দুর্দিনেও যাঁরা দলের সঙ্গে থাকবেন, তাঁদেরই ‘প্রকৃত সম্পদ’ বলে এ বার গণ্য করবে তারা। ক্ষমতা হারানোর পরে সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই দলের ‘শুদ্ধকরণ’ হবে বলে আশা করছেন সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব।
জেলায় জেলায় যে সব দলীয় কার্যালয় বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে, তা খোলার জন্য জবরদস্তি না-করার জন্যও জেলা নেতৃত্বকে পরামর্শ দিচ্ছেন রাজ্য নেতৃত্ব। তাঁদের ধারনা, নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে এমনিতেই কিছু কার্যালয় আবার খুলবে। তৃণমূলের ‘সন্ত্রাসে’র ভয়ে যাঁরা দলের কাজ করতে পারছেন না, তাঁদের একাংশ আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যা হবে, তার বাইরে আলাদা করে উদ্যোগী হতে চাইছে না সিপিএম। রাজ্য জুড়ে একাধিক জোনাল কমিটিকে জুড়ে মোট কমিটি কমিয়ে ফেলার ব্যাপারেও তারা প্রাথমিক চিন্তাভাবনা করছে। এক কথায়, ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এখন সিপিএমের উদ্দেশ্য দল ছোট হয়ে যাক, ক্ষতি নেই। কিন্তু ‘খাঁটি’ হোক!
আলিমুদ্দিন বুঝতে পারছে, মহাকরণের চাবিকাঠি হাতে-থাকার সময়ে শুধু ‘ক্ষমতার গুড়’ খেতে বহু লোক সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সরাসরি দলে এবং বিভিন্ন গণসংগঠনে বহু মানুষ নাম লিখিয়েছিলেন, যার ফলে সিপিএমের বহর বেড়েছিল বিপুল। এখন দল ক্ষমতা হারাতেই এই ‘বেনিফিসিয়ারি’ শ্রেণির একটি বড় অংশই শিবির বদলে তৃণমূলে চলে যাচ্ছে। সিপিএম নেতৃত্ব আলোচনা করে দেখেছেন, এতে তাঁদের সুবিধাই হবে। বারবার বিরাট আয়োজন করেও শুদ্ধকরণের যে প্রক্রিয়া তাঁরা সম্পূর্ণ করে উঠতে পারেননি, এ বার ‘বদরক্ত’ বেরিয়ে গিয়ে সেই কাজটা হয়ে যাবে। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “আমরা জোর করে কাউকে পার্টি করতেও বলব না, কাউকে ফিরতেও বলব না। দলের আদর্শকে ভালবেসে যাঁরা থাকার, তাঁরাই থাকবেন।”
আদর্শগত ভাবে ‘শুদ্ধ’ হওয়ার পাশাপাশি কলেবর ছেঁটে ফেলার পিছনে সিপিএমের নিখাদ ‘বাস্তব উদ্দেশ্যও’ আছে। রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ফলে দলের ভাঁড়ারে এ বার অবধারিত ভাবেই টান পড়বে। দলের মোট সদস্যসংখ্যাই ছিল প্রায় তিন লক্ষ। গণ-সংগঠন ধরলে সংখ্যাটা কম-বেশি তিন কোটি। এই বিপুল পরিমাণ সদস্য বয়ে চলার খরচ, সর্বক্ষণের কর্মীদের ভাতা দেওয়ার টাকা জোগাড় করা এখন মুশকিল হবে। ‘কৃচ্ছসাধনে’র তাই এটাই আদর্শ সময়। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-সহ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর একাধিক সদস্য ইতিমধ্যেই শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত গাড়ি ছেড়ে সাধারণ গাড়ি চড়তে শুরু করেছেন। স্রেফ প্রয়োজনীয় কাজের জন্য আবশ্যিক পদক্ষেপ করার বার্তা জেলা হয়ে নিচু স্তরেও এ বার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
দলের জোনাল এবং লোকাল কমিটির বহু কার্যালয় নির্বাচনের ফল বেরনোর পরে তৃণমূল দখল করে নিয়েছে বলে সিপিএমের অভিযোগ। সিটু, কৃষকসভার মতো গণ সংগঠনের স্থানীয় দফতরও এই তালিকায় রয়েছে। তার পাশাপাশি, বেশ কিছু জোনাল দফতরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ‘সচেতন’ ভাবেই। রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, “বহু জায়গাতেই পার্টি করার লোক রয়েছে কিন্তু দফতর খুলে বসলে তাঁরা ‘টার্গেট’ হয়ে যাচ্ছেন। তার চেয়ে দফতর বন্ধ রাখা ভাল। দফতরে কিছু দিন না-গেলেও চলবে! আগে তো বাঁচতে হবে!” রাজ্যের ১৯টি জেলায় প্রায় ২৮৭টি জোনাল কমিটি রয়েছে সিপিএমের। প্রাথমিক আলোচনায় দলীয় নেতৃত্ব দেখেছেন, এখন ‘কাজ কমে’ যাওয়ায় এত কমিটি রাখার আর প্রয়োজন হবে না। তার থেকে একাধিক কমিটি মিশিয়ে দিয়ে একটি কমিটি গড়লে মোট কমিটির সংখ্যা কমে আসে। কমিটির দফতর, আসবাব-সহ সামগ্রিক ব্যয়ও নেমে আসে নীচে।
লোকসভা ভোটের পরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় প্রথম একাধিক জোনাল কমিটি মিলিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। লোকসভায় ভাল ফল হয়েছিল কিন্তু বিধানসভায় বিপর্যয় হয়েছে এমন জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়া, বীরভূমেও এখন বহু জোনাল দফতর বন্ধ। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলিতেও এমন বেশ কিছু দৃষ্টান্ত আছে। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “জেলায় জেলায় ঠিক কত দফতর বন্ধ, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য আমাদের হাতের কাছে নেই। সংখ্যাটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনও হচ্ছে। জেলাভিত্তিক পরিস্থিতিও আলাদা। আপাতত দফতর বন্ধই রাখতে হবে। তবে অনন্ত কাল তো বন্ধ রাখা যায় না!” কমিটি আছে কিন্তু দফতর বন্ধ এই জিনিস চলতে থাকলে দল সম্বন্ধেই ‘ভুল বার্তা’ যাবে। তার থেকে বেশ কিছু কমিটিই তুলে দেওয়া যায় কি না, সেই ব্যাপারে জেলা থেকে বিশদ রিপোর্ট নিচ্ছেন রাজ্য নেতৃত্ব। অগস্ট মাস থেকে শাখা ও লোকাল কমিটি স্তরে সম্মেলন শুরু হলে এই প্রক্রিয়া আরও সংহত হবে। রাজ্য কমিটির সদ্যসমাপ্ত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্র-নজরুল স্মরণে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালন করা হবে। যে ধরনের কর্মসূচি সাধারণত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে থাকেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে মার খাওয়ার সময় রবীন্দ্র-নজরুল কেন, তা নিয়ে ক্ষোভও আছে দলের একাংশে। তবে সিপিএমের এক জেলা নেতার কথায়, “সব জেলায় একই রকম কর্মসূচি হয়তো হবে না কিন্তু এখন চড়া গলায় কথা বললে বিপরীত প্রতিক্রিয়া হবে। তাই রবীন্দ্র-নজরুল দিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলতে হবে!” ‘পরিবর্তনে’র রাজ্যে সিপিএমের সংস্কৃতিতেও এখন ‘পরিবর্তন’! |
|
|
|
|
|