|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
মেয়েলি, সেন্টিমেন্টাল পুরুষ, না, পৌরুষ উবাচ |
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় |
মেয়েরা বাজে লেখে, তাদের লেখা মানেই সেন্টিমেন্টের আড়ত এমন কথা সভার মাঝে পড়তে না পড়তে সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত নিন্দায় উত্তাল এবং ধিক্কারে মুখরিত হবে, স্যর বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নয়পল অবশ্যই সেটা জানতেন। তাঁর ‘নারীবিদ্বেষী’ মন্তব্যের নিন্দা প্রতিবাদ সমালোচনা ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষ্ফল। সেই কোন বিংশ শতাব্দী থেকে তিনি কত বিষয়ে কত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছেন, এখন এই আশির চৌকাঠে পৌঁছে সহসা বাক্সংযম অভ্যাস করবেন কোন দুঃখে?
মেয়েদের লেখা সত্যিই সেন্টিমেন্টাল কি না, নয়পলের সাহিত্যবিচার ঠিক কি ভুল, সেটা সাহিত্যতাত্ত্বিকরাই জানেন। কিন্তু স্যর বিদিয়া-কে গালি দেওয়ার আগে এক বার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নেওয়া ভাল। মেয়েরা সেন্টিমেন্টাল এই ধারণাটিকে কেবল সত্য নয়, স্বতঃসিদ্ধ মনে করেন, এমন পুরুষ চোখ বুজে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের দলে স্থান পেয়ে যাবেন। তাঁরা বেশির ভাগই কথাটা মুখ ফুটে বলবেন না, বলতে নেই তাই বলবেন না, কিন্তু মনে মনে ভি এস নয়পলকে অপ্রিয় সত্য ভাষণের জন্য বাহবা দেবেন, কিংবা ‘স্ট্যাগ-পার্টি’তে পরস্পর বলবেন, ‘আরে, এ রকম কথা পাবলিকলি বলতে আছে নাকি?’ নয়পল যা বলেছেন, সেটা নিছক পুরুষের কণ্ঠস্বর নয়, পৌরুষের কণ্ঠস্বর। এবং বহু মেয়েও নির্ঘাত প্রতিধ্বনি করবেন, সসংকোচ সম্ভ্রমে বলবেন, ‘সত্যিই, মেয়েরা তো একটু সেন্টিমেন্টাল বটেই!’ সেটাই স্বাভাবিক, মেয়েদের মুখে নিজের কথা বসিয়ে দিতে পেরেছে বলেই তো পুরুষতন্ত্র কালজয়ী, দেশজয়ী।
সেন্টিমেন্ট মানে কী? ‘আবেগ’ বললে অর্ধেকটা বলা হয়, সেন্টিমেন্ট বলতে আমরা যা বুঝি, তার নাম যুক্তিহীন আবেগ। অভিধানেও তেমন কথাই লেখা থাকে। ‘সেন্টিমেন্টাল’ মানে বোঝাতে গিয়ে অক্সফোর্ড ঘোষণা করে: connected with your emotions, not reason. যখন যুক্তি দিয়ে না দেখে আবেগ দিয়ে দেখি, তখনই আমি সেন্টিমেন্টাল। আচ্ছা, সেটা খারাপ কেন? যুক্তি দিয়ে দেখা-ই ভাল, আবেগ দিয়ে দেখা ভাল নয়, এমনটা কেন ধরেই নিতে হবে? প্রশ্নটা শুনলেই কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে করে, তাই না? ঠোঁটের আগায় হাজির-জবাবটি চলে আসে, ‘ও আবার কী কথা? যুক্তি দিয়ে দেখতে হবে না? হাঁউমাউ করলে চলবে?’
হ্যাঁ, সেন্টিমেন্টাল মানে আমরা বুঝি, হাঁউমাউ করা। বাড়াবাড়ি করা। আনন্দ, দুঃখ, অভিমান, সবেতেই বাড়াবাড়ি। মেয়েরা হাঁউমাউ করে, তাই তারা সেন্টিমেন্টাল, ফালতু, বাজে। তারা যখন লিখতে বসে, তখনও তো তারা মেয়েই, তাই না? তা হলে তাদের লেখাও সেন্টিমেন্টাল হবে, নয়পল সে লেখার দুটো প্যারাগ্রাফ পড়েই ধরে ফেলবেন তার মেয়েলিপনা, রাঁধুনি যেমন একটা ভাত টিপেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা মেয়েদের লেখার দোষ নয়, মেয়েদের মেয়ে হওয়ার দোষ। বস্তুত, কোনও মেয়ে ব্যক্তি হিসেবে এই দোষ থেকে মুক্ত হলেও নয়পলরা তাঁদের তত্ত্বে অবিচল থাকবেন, বলবেন, সেই মেয়ে ব্যতিক্রমমাত্র, তিনি ‘পুরুষের মতো’ লেখেন। ঠিক একই কারণে, কোনও পুরুষের লেখা তাঁদের মতে ‘সেন্টিমেন্টাল’ সাব্যস্ত হলে রায় দেবেন: মেয়েলি লেখা! ফালতু বাজে!
সেন্টিমেন্ট লড়াই শুরু হওয়ার আগেই হেরে বসে আছে। অক্সফোর্ডের বাণীটি মন দিয়ে পড়ুন। দেখবেন, সেন্টিমেন্ট কী, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল, সেন্টিমেন্ট কী নয়। না-এর বোঝা মাথায় নিয়েই তার জন্ম, যুক্তির অভাব হিসেবেই তার সংজ্ঞা নির্ধারণ। যুক্তিই মাপকাঠি, সেন্টিমেন্ট সেই মাপকাঠিতে ফেল, তাই ফালতু, বাজে। এই দুটি বস্তুর জন্য মানবদেহে এমনকী দুটি আলাদা ঠিকানাও তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সেন্টিমেন্টের বাস হৃদয়ে, যুক্তির বসতি মস্তিষ্কে। হৃদয় বনাম মস্তিষ্কের লড়াই কাকে বলে, সেটা তো আমাদের অজানা নয়, জীবনে কত বার কত উপলক্ষে অসহায় অপরাধীর সুরে বলেছি, ‘কী করব? মস্তিষ্ক তো বারণ করেছিল, কিন্তু হৃদয় যে মানল না!’ মস্তিষ্ক বারণ করেছিল, সেটা তার গুণ; হৃদয় মানল না, সেটা তার দোষ। ওই জন্যই তো বলে হৃদয়দৌর্বল্য। ভেবে দেখলে, খেলাটা মস্তিষ্ক বনাম হৃদয়ের, আবার হারজিতের নিয়মটাও মস্তিষ্কই ঠিক করে দিচ্ছে। শকুনি বনাম যুধিষ্ঠির দ্যূতক্রীড়ার কথা মনে পড়ে যায়।
খেলাটা আসলে ক্ষমতার। যুক্তি বলে যাকে চিনি, চিনতে শিখি, সেটা ক্ষমতার যুক্তি। সেই যুক্তি নানা পরিসরে নানা রূপ ধারণ করে, কিন্তু তাকে ক্ষমতা যেমন চালায়, সে তেমনই চলে। পরিবারের ক্ষমতা যুক্তি দেয়: ছোটদের (এবং মেয়েদের) অভিভাবকের কথা মেনে চলা উচিত; বাজারের ক্ষমতা যুক্তি দেয়: যে দামে চাহিদা আর জোগান সমান হয়, সেটাই উচিত দাম। ছোটরা (এবং মেয়েরা) যদি বলে, নিজের মতো চলবে, কারণ সেটাই তাদের ভাল লাগে, সেটা যুক্তিহীন, সুতরাং অন্যায় দাবি। গরিব যদি বলে, বাজারদর এত বেশি যে সে দুবেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছে না, সুতরাং দরটা কমানো উচিত, সে দাবিও যুক্তিহীন, সুতরাং অন্যায়। নোবেলজয়ী নয়পল যখন অসীম আত্মপ্রত্যয়ে ঘোষণা করেন, মেয়েরা তাঁর মতো ভাল লিখতে পারে না, এমনকী জেন অস্টিনও নয়, কারণ তারা বড় বেশি সেন্টিমেন্টাল, তখন তাঁর মুখ দিয়ে ক্ষমতা কথা বলে, তাঁর অহমিকা ক্ষমতার অহমিকা। সেই ক্ষমতা স্থির করে দেয়, সাহিত্যবিচারের মাপকাঠি কী হবে। সে অন্য মাপকাঠিকে গ্রাহ্য করতেই রাজি হবে না, ‘সেন্টিমেন্টাল হওয়া খারাপ কেন’ এই প্রশ্নটাকেই সে স্বীকার করবে না।
করতে পারবে না। কারণ ক্ষমতার যুক্তি আবেগকে ভয় পায়, কারণ আবেগ তার ছকটা ভেঙে দিতে পারে। কী ভাবে? রাজনীতির পরিসরে ক্ষমতার ছক ভেঙে দেওয়ার এক বৃত্তান্ত সদ্য দেখে উঠল আমাদের এই রাজ্যটি। যাঁরা বলেছিলেন, ‘কৃষি থেকে শিল্প, গ্রাম থেকে শহর, এটাই তো উন্নয়ন’, তাঁরা যুক্তির কথা বলেছিলেন। তাঁদের ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০’-এর আস্ফালনে অহমিকা ছিল, কিন্তু যুক্তিও ছিল, বিশুদ্ধ পাটিগণিতের যুক্তি। নির্বাচনে বেজায় রকমের হেরে গিয়ে এখনও তাঁরা ‘কী যে হয়ে গেল’ বলে হাহাকার করে চলেছেন, কিন্তু সোজা কথাটা স্বীকার করছেন না। সেটা এই যে, তাঁরা সেন্টিমেন্টের কাছে হেরে গিয়েছেন। ‘মা মাটি মানুষ’ নামক যে স্লোগানটি নিয়ে তাঁদের এত হাসিঠাট্টা, তার ক্ষমতাটা তাঁরা ধরতেই পারেননি, এখনও পারছেন না, হয়তো কোনও দিনই পারবেন না, কারণ তাঁরা মস্তিষ্ক দিয়ে অঙ্ক কষতে শিখেছেন, ‘হৃদয়দৌর্বল্য’র রহস্য তাঁদের অধরা।
এখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির একটা বড় তাৎপর্য। তিনি ব্যক্তিপরিচয়ে নারী, এটা প্রথম কথা মাত্র। পরের কথাটা এই যে, তিনি রাজনীতির একটা ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন চেহারা বেছে নিয়েছেন, তাতে আবেগের ভূমিকা খুব বড়। তাঁর প্রতিপক্ষ, নয়পলের মতোই, সেই রাজনীতিকে অনেক দিন ‘সেন্টিমেন্টাল’, ‘ফালতু’, ‘বাজে’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, কিন্তু সে উড়ে যায়নি, বরং ক্রমশ তার শক্তি বেড়েছে, তার পর বিপক্ষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। লক্ষণীয়, নির্বাচনের পরেও সেই ‘সেন্টিমেন্ট’-এর প্রভাব নিঃশেষ হয়নি, নতুন সরকারের, বিশেষত তার মুখ্যমন্ত্রীর, আচরণে এখনও আবেগ, এমনকী আবেগের আতিশয্য রীতিমত প্রকট। এটা ভাল কি মন্দ, এর পরিণাম পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে শুভ কি অশুভ, সে বিষয়ে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করতে গেলে নয়পল-সুলভ স্পর্ধার প্রয়োজন হয়, সুতরাং সে চেষ্টা না করাই ভাল। যুক্তি এবং আবেগ, কাকে কতটা জায়গা দেব, সেই প্রশ্নের কোনও হাজির-জবাব হয় না, প্রত্যেকটি পরিস্থিতিতে আলাদা করে তার উত্তর খোঁজাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসই দেখিয়ে দেয়, যুক্তির আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেলে আবেগের মাহাত্ম্য চিনতে ভুল হয়ে যেতে পারে। রাজবৃত্তে ‘মেয়েলি’ আবেগের কিছু দৃশ্য দেখে এখনই ‘সেন্টিমেন্টাল, ফালতু, বাজে’ বলে উড়িয়ে না দেওয়াই শ্রেয়। পৌরুষের যুক্তি তো এত দিন ধরে এই মরূদ্যানে এনে দাঁড় করিয়েছে! |
|
|
|
|
|