সম্পাদক সমীপেষু...
শ্রেণি-র বদলে ‘আইডেন্টিটি’র রাজনীতি?
সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীর সাক্ষাৎকার (২৪-৫) প্রসঙ্গে এই চিঠির অবতারণা। আশিস নন্দী বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের যারা নীচের তলার লোক, যাদের ‘শোষিত সমাজ’ বলতে পারেন, তাদের আইডেন্টিটিগুলো (বামফ্রন্টের আমলে) মুছে দেওয়া হল। তারা গরিব, তারা শোষিত যেন স্রেফ এইটুকুই তাদের পরিচয়। এর মধ্যে যে অজস্র কমিউনিটি আছে, নানা ধরনের সমাজ, সংস্কৃতি, জাতি, সেগুলো কোনও দিনও স্পষ্ট হয়ে উঠল না।” অর্থাৎ আশিস নন্দীর মতে, বাম রাজনীতির প্রধান ভুল হল, ‘কমিউনিটি’ ভিত্তিক রাজনীতির পরিবর্তে ‘শ্রেণি বা ক্লাস’ ভিত্তিক রাজনীতি করা।
প্রসঙ্গত বিশ্বব্যাঙ্কের ঘোষিত নীতির মূল লক্ষ্য হল, শ্রেণিভিত্তিক আন্দোলনকে দুর্বল করে ‘আইডেন্টিটি’কে রাজনীতির মূল ভিত্তি বানিয়ে মানুষকে বিভাজিত করা এবং বিভেদের চরম গণ্ডগোলে দেশগুলিকে সাম্রাজ্যবাদের মৃগয়াক্ষেত্র বানিয়ে তোলা। ঠিক এমনই ঘটেছে পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক বসনিয়া, সার্বিয়া, কসভো, চেচেনিয়া এমনকী আফগানিস্তানে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি খচিত বিশ্বায়নের হাত ধরেই এসেছে বিশ্বব্যাপী জাতিদাঙ্গা ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ। বিশ্ব ব্যাঙ্ক তার ওয়ার্ল্ড ডেভেলেপমেন্ট রিপোর্ট ২০০১-এ এই অভিমত প্রকাশ করেছে যে, স্থানীয় স্তর থেকে জাতি/ধর্ম ভিত্তিক সম্প্রদায়গত মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই অধিক সামাজিক মূলধন (সোশ্যাল ক্যপিটাল) গঠনের মাধ্যমেই গ্রাম ও শহরের উন্নয়ন হতে পারে। এখানে বিশ্বব্যাঙ্ক ধরে নিয়েছে যে, প্রতিটি সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণকারী মানুষজন সমশ্রেণিভুক্ত। বিশ্বব্যাঙ্কের প্রধান দাওয়াই হল, স্থানীয় স্তরে জাতি-ধর্ম খোচিত কমিউনিটি পঞ্চায়েতগুলি হবে ‘অরাজনৈতিক’, ‘রাষ্ট্রীয়’ প্রভাব মুক্ত। যদিও তাতে আই এম এফ/বিশ্ব ব্যাঙ্কের আশীর্বাদধন্য এন জি ও-রা প্রবলবিক্রমে হাজির থাকবে।
বর্তমান পত্রলেখক তাঁর গবেষণাপত্র ‘ক্লাস অ্যান্ড পলিটিক্স অব পার্টিসিপেটরি রুরাল ট্রান্সফরমেশন ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এ (জার্নাল অব অ্যগ্রারিয়ান চেঞ্জ, ব্ল্যাকওয়েল, জুলাই, ২০০৭) বিশ্বব্যাঙ্কের এই অবস্থানকে খারিজ করে দেখান পশ্চিমবঙ্গের তফসিলি জাতি, উপজাতি, এবং মুসলিম সম্প্রদায় (আশিস নন্দীর ‘নীচের তলার লোক’) শ্রেণিগত ভাবে বিভাজিত এবং ক্লাস ডিফারেনটিয়েটেড। অর্থাৎ তফসিলি জাতি ও উপজাতিগুলির ভিতরেও বিত্তবান শ্রেণি যেমন বড় চাষি ও মাঝারি চাষি রয়েছেন। যদিও গরিব শ্রেণির পাল্লা এদের মধ্যে অনেকটা ভারী।
জে এন ইউ-এর অধ্যাপক প্রদীপ্ত চৌধুরী তাঁর এক গবেষণাপত্রে সারা ভারতবর্ষের তফসিলি জাতি ধরে ধরে দেখিয়েছেন তারা সবাই শ্রেণিগত ভাবে বিভাজিত। বর্তমান পত্রলেখক ও প্রদীপ্ত চৌধুরীর মতে, এই জনগোষ্ঠীগুলির উত্তরণের জন্য যেটা করা দরকার তা হল, জাতি রাজনীতির মধ্যে আবর্তিত না-হয়ে শ্রেণিগত বিভাজনের মূলে কুঠারাগাত করা।
ঠিক এই জিনিসটাই পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে হয়েছে যার বিরাট অংশের লাভবান হলেন তফসিলি জাতি ও উপজাতির মানুষ যা আশিস নন্দীও স্বীকার করেছেন। নব্বই সালের গোড়ার দিকে জাতীয় রাজনীতিতে ও বি সি সংরক্ষণের প্রশ্নে ঝড় তোলা মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টেও স্বীকার করা হয়েছে, যে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলের ভূমিসংস্কার পশ্চাদপদ জাতিগুলিকে বস্তুগত সাহায্যই শুধু জোগায়নি তাদের রাজনৈতিক ভাবেও শক্তিশালী করেছে। মণ্ডল কমিশন পশ্চাদপদ জাতির স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলের আদলে সারা ভারতে এ রকম ভূমি সংস্কারের সুপারিশ করেছে (উক্ত রিপোর্ট, পৃ-৬০)। অন্য দিকে, প্রভাত পট্টনায়ক-সহ অনেক চিন্তাবিদের মতে, মাওবাদীরা শ্রেণিসংগ্রামের নামে আইডেন্টিটি রাজনীতিতে আবর্তিত হয়ে আছেন বলেই তাঁরা জঙ্গলমহলের বাইরে সংগঠন বিস্তার করতে পারেননি। তবে আশিস নন্দীর সঙ্গে এই বিষয়ে একমত যে, নিম্নবর্গীয় নানা মানুষের সাংস্কৃতিক উপাদান নিয়েই সমাজের মূল ধারার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার। বামফ্রন্টের আমলে তা একেবারে হয়নি তা নয়। বামফ্রন্ট ছোটলোকদের মাথায় তুলেছে এটা পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত ভদ্রলোক সংস্কৃতির বহুকথিত অভিযোগ। পত্রলেখক তাঁর গ্রাম সমীক্ষা নির্ভর গবেষণায় দেখেছেন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার আগে বিভিন্ন ব্রাহ্মণপাড়া দিয়ে নিচু জাতের মানুষদের জুতো হাতে ধরে খালি পায়ে হাঁটতে হত। আজ সে সব এলাকায় পঞ্চায়েতের মাথায় নিচু জাতের লোকেরা বসে আছেন। অনেক ক্ষেত্রে কিছু ব্রাহ্মণ কুসন্তানের বিচারও করছেন।
আ বা প-র সাক্ষাৎকারী আশিস নন্দীকে জানিয়েছেন বামফ্রন্ট একটি সঙ্ঘের জন্য বিশেষ সরকারি পুরস্কার চালু করেছে। এ সবেরই ফল ১৯৭৭ থেকে ২০০৯ সাল অবধি পশ্চিমবঙ্গের তফসিলি জাতি ও উপজাতি অধ্যুষিত কেন্দ্রগুলিতে বামফ্রন্ট টানা জিতে এসেছে। সাম্প্রদিক একটা দুটো নির্বাচনের ভিত্তিতে বামফ্রন্টের তরফে নিচু তলার লোকেদের উপেক্ষার অভিযোগ খুব যুক্তিযুক্ত নয়।


শব্দের অন্যায় অত্যাচার সহ্য না করে উপায় কী

সাউন্ড বক্সের নাম আয়লা। নামটি সার্থক। শব্দের দমক আয়লার ঝড়ের সঙ্গেই তুলনীয়। সকাল থেকে মধ্য রাত অবধি অবোধ্য দক্ষিণী গানের সঙ্গে উৎকট বাজনার হাজার ডেসিবেলীয় এই শব্দ বিক্ষেপ, আম আদমির জান কয়লা করে ছেড়ে দিচ্ছে। শুধু মনুষ্য জাতিই নয়, এই শব্দবাণ আশপাশের গৃহপালিত এবং গৃহহীন পশুপক্ষী কুলের কানে ও প্রাণে ঝালাপালা ধরিয়ে তাদেরকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করছে। পাড়ার পুজো মণ্ডপ, রবীন্দ্র জয়ন্তী বা স্বাধীনতা দিবস, সর্বোপরি ঠাকুর বিসর্জন উপলক্ষে এই শব্দ বাক্স (যার অপর নাম ডি জে বক্স)-র আগমন অবশ্যম্ভাবী।
কলকাতার কথা বলতে পারব না, তবে জেলার শহরগুলির ছবিটা এই রকম। হয়তো পাশের বাড়িতেই রয়েছেন কোনও অসুস্থ, বয়স্ক শয্যাগত কিংবা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। তারা দরজা জানালা বন্ধ করে কানে তুলো গুঁজেও পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। কান বন্ধ হলেও শব্দের তীব্রতায় বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে। অথচ প্রতিবাদ করা যাবে না। প্রতিবাদ করলেই সবাই বলবে, ‘তুই কি বুড়িয়ে গেলি নাকি রে? ছেলে ছোকরারা আনন্দ করছে, আর তুই কি না...’।
এ তো গেল আমাদের মতো শান্ত অঞ্চলের কথা। আর যে সব শহর বা গ্রাম একটু রগচটা গোছের, যেখানে পকেটমার বা মোবাইল চোর ধরা পড়লে গণপিটুনিতে খতম করে দেওয়ার হাতযশ আছে, সেখানে এই শব্দ দৈত্যের প্রতিবাদ করতে গেলে হলদিয়ার মাস্টারমশাই মনমোহন ক্যুইতির মতো ঘুষি খেয়ে শব্দ শহিদ হয়ে বেঘোরে পড়ে থাকতে হবে।


শিশুর ভূমিকা

‘খুদে সমর্থক’ (২৫-৪) শিরোনাম চিত্র এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে অরূপরতন আইচের চিঠি ‘পীড়াদায়ক’ (১০-৫) পড়ে এই পত্র।
তিনি শিশুর পিতার উদ্দেশে লিখেছেন শিশুটির “অন্তত আঠারো বছর হোক, আপনার দলের কর্মকাণ্ডগুলো খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিক যে সে সমর্থন করবে কি না, অন্তত চেতনাটুকু আসতে দিন।”
যথার্থ বক্তব্য। কিন্তু সমাজে সর্বদাই ঘটে চলেছে এই শিশুটির পিতার মতো আচরণ। শিশু অবস্থায় মন্দির-মসজিদ-গির্জায় গিয়ে অভ্যস্থ মানুষ। ‘বাবা নমো করে’ শুনে শিশু কপালে হাত তোলে। অজানা, অলৌকিকতায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। শিশু অবস্থা থেকে সে সাজে রাধা-কৃষ্ণ, হাতে বাঁধে মাদুলি-তাগা-তাবিজ-পাথর। শিশু অবস্থাতেই সে বাবার সঙ্গে পাঁঠার চামড়া ছাড়িয়ে মাংস বিক্রি করে। খেলাধুলা ছেড়ে গ্রন্থকীট হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। একাকিত্ব ভোগ করে।
যে শিশুকে ঘরে দেখার কেউ নেই সে বাবা-মার সঙ্গে বাজারে যায়, কাজে যায়, মন্দিরে-মিছিলে-মিটিঙে যায়। শিশুরাই তাদের অমতে, কেবল বড়দের মতে, কুমারী হিসেবে পূজিতা হয়। আবার পিতা-মাতাদের যা হয়ে ওঠা হয়নি তাই তারা শিশুর মধ্যে খুঁজে ফেরে। সবাই নিজের মতো করে শিশুকে গড়তে চায়। ‘সন্তানে’র গতি এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকম হয়। তবে যেটা প্রতি ক্ষেত্রে নিশ্চিত ভাবে হয়, তা হল, আলাদা আলাদা ব্যক্তি ত্বগুলির বিকাশ বন্ধ হয়, তাদের বারোটা বাজে।
Previous Item Editorial First Page



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.