প্রবন্ধ ১...
আক্রমণের আগে
ফের বোমা ফাটিয়েছেন নয়পল। ‘মেয়েরা আবেগপ্রবণ, তাদের লেখালেখিতেও সেই সঙ্কীর্ণ চিন্তাধারা...’ ব্রিটেনের রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটিতে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন নোবেলজয়ী লেখক। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে গালমন্দের বিপুল জোয়ার। ‘পিকং’ ব্যাপারটা দুনিয়া এখনও হজম করতে পারল না! ‘পিকং’ শব্দটা ত্রিনিদাদের অবদান। ফরাসি ভাষায় যাকে ‘পিকুয়েন্ট’ (piquant) বা চোখা বলে, ত্রিনিদাদের কথার লব্জে সেটাই পিকং। মানে এত চোখা, ঝাঁজালো কথাবার্তা যে সুরুচি-কুরুচির সীমানা চৌপাট হয়ে যায়, মাথা ভনভন করে। পিকং শুধু চমকে দিতে চায়। ব্যাপারটা ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ হবে কি না, তার তোয়াক্কা করে না।
আর, নোবেলজয়ী স্যার বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নয়পল তাঁর লেখালেখি, কথাবার্তা, আচরণে এই ‘পিকং’ স্টাইলটাই চালিয়ে গিয়েছেন। একদা ‘ইন্ডিয়া: মিলিয়ন মিউটিনিজ নাউ’ লিখতে গিয়ে বিজেপি ও শিবসেনার উত্থানকে তাঁর ‘নতুন ভারতীয় জাতিচেতনার উন্মেষ’ মনে হয়েছিল। কিন্তু বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে দাঙ্গায় যখন কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হল? “আমি তো আর খুন করিনি,” নির্নিমেষ বলে দিলেন নয়পল। লেখকের সামাজিক ও নৈতিক দায়, রাজনৈতিক চেতনা ইত্যাদির ধার ধারেন না তিনি।

দিদিকে চিঠি

আত্মবিশ্বাসী নয়পল সোজাসাপ্টা বাতচিত করেন। রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অনুষ্ঠানে সে দিন যেমন বলেছিলেন, কোনও লেখিকাকে তিনি সমকক্ষ মনে করেন না। ‘জেন অস্টেন?’ ৭৯ বছরের স্যার বিদিয়ার জবাব, ‘সেন্টিমেন্টাল। আবেগ-প্যাচপেচে দৃষ্টিভঙ্গি।’ তার পরই নারীবাদীরা উঠেপড়ে লেগেছেন। নয়পল খবরের শিরোনামে থাকার জন্য এ সব বলছেন। ৬২ বছর আগের চিঠিটার কথা তাঁদের খেয়াল নেই। ১৯৪৯ সালে কমলা নয়পল তখন স্কলারশিপ নিয়ে ত্রিনিদাদ থেকে বারাণসীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন। দেশে মা, বাবা, ছোট ভাইয়ের সঙ্গে চিঠির আদানপ্রদান চলে। ভাইও চমৎকার রেজাল্ট করে অক্সফোর্ডে বৃত্তি পেয়েছে। একদিন সে দিদিকে চিঠি লিখল, ‘জেন অস্টেন শুধু মেয়েলি গসিপ! ভদ্রমহিলা এখন বেঁচে থাকলে নির্ঘাত মেয়েদের পত্রিকায় ধারাবাহিক লিখতেন।’ অতএব নয়পল দুর্মুখ হতে পারেন, দাম্ভিক হতে পারেন। কিন্তু তাঁর সাহিত্যবোধকে নিছক ‘খবরে থাকার আকুলিবিকুলি’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে দিনও তাঁর জেন অস্টেনকে খারাপ মনে হয়েছিল, আজও মনে হয়!

মা-দিদিমারা

আর এ সব বলতে বলতেই নয়পল জানিয়েছেন, বাড়ির পূর্ণ কর্তৃত্ব যেমন মেয়েদের হাতে থাকে না, সাহিত্যের ব্যাপারটাও সে রকম। লোককে ইচ্ছাকৃত রাগিয়ে দেওয়া নয়পলের চিরকালের অভ্যাস। কিন্তু নারীবাদীরা হাস্যকর বিড়ম্বনা শুরু করেছেন। তাঁরা ভার্জিনিয়া উল্ফ থেকে টোনি মরিসন, আয়ান র্যান্ড প্রমুখ লেখিকার উদাহরণ টেনে যুক্তি দিচ্ছেন, কেন? নয়পল কি এঁদের লেখা পড়েন না?
আর চাপানউতোরে আসল ট্রাজেডিটাই চাপা পড়ে যাচ্ছে। নয়পল জন্মেছিলেন ত্রিনিদাদের রাজধানী পোর্ট অব স্পেনের আনন্দভবন নামে এক বাড়িতে। সে তাঁর মামাবাড়ি। দাদু কপিলদেও নয়পলের জন্মের আগেই মারা যান। দিদিমা তাঁর ৯ মেয়ের বিয়ে দেন এক-একটি দরিদ্র ছেলের সঙ্গে। সকলেই ঘরজামাই। দিদিমার কথাই সব। নাতিপুতিরা আড়ালে তাঁকে বলত, ‘ডিক্টেটর’।
এই রকম পরিবেশ থেকেই বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নয়পলের উত্থান। বস্তুত, নয়পলের পিতৃপুরুষরা নেপাল না ভারতের লোক তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কিন্তু মাতামহ কপিলদেওয়ের দেশ ছিল উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে। সেখান থেকেই নয়পল ভারতকে তাঁর দেশ মনে করেন। মাতৃতান্ত্রিক সংসারে তাঁর ঐতিহ্য এবং পরিচিতির ধারণা তৈরি হয়েছিল বলেই কি অবচেতনে নয়পল-প্রতিভা আজও ছটফট করে, সংসারের রাশ পুরুষের হাতেই থাকা উচিত?

স্ত্রী বনাম বান্ধবী

প্রথম স্ত্রী প্যাট্রিসিয়ার সঙ্গে অক্সফোর্ডে নয়পলের কলেজ-প্রেম। দুই বাড়িকে লুকিয়েচুরিয়ে ত্রিনিদাদের কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে আর ব্রিটিশ কন্যার বিয়ে। নয়পল তখন মাত্র ২২। থাকার জায়গা বলতে বেসমেন্টের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। নয়পল তখন হাঁপানিতে ভুগছেন, সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী সেখানেই তাঁকে ডিকেন্সের ‘পিকউইক পেপার্স’ উপন্যাস পড়ে শোনাতেন।
’৭২ সালে আর্জেন্টিনায় মার্গারেট গুডিং-এর সঙ্গে নয়পলের প্রেম। মার্গারেট বিবাহিতা, দুই সন্তানের জননী। তাঁকে নিয়েই ভারত, ইরান, আর্জেন্তিনার নানা জায়গায় উড়ান দিয়েছেন। কিন্তু উড়ান থেকে ফিরে ‘আ বেন্ড ইন দ্য রিভার’ বা ‘অ্যামং দ্য বিলিভার্স’ তিনি লিখবেন লন্ডনের বাড়িতে বসে। প্রায়ই স্ত্রীকে শোনাতেন, মার্গারেট ছাড়া তাঁর জীবন অসহ্য। কিন্তু স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতেও চাননি। পরিষ্কার জানিয়েছেন, ‘লেখালেখির জন্য তোমাকে চাই। সাহিত্যিক ছাড়া আমি কিছু নই। তুমি আমার সেই সাহিত্যের জন্য। মার্গারেট জীবনের জন্য, যৌনতার জন্য।’
এই অবধি পড়ে নারীবাদীরা আরও চটিতং হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু জীবনের ট্র্যাজেডি? পুরুষ যখন স্ত্রীকে জানায়, তুমি লেখালেখির জন্য আর মার্গারেট যৌনতার জন্য, তোমাদের কাউকেই আমি ছাড়তে পারব না, সেই অসহায় যন্ত্রণা কি শুধু নীতিবাদের দোহাই দিয়ে এড়ানো যায়? নারীবাদের চশমা খুলে তাকালে একটা জিনিস পরিষ্কার। দাম্পত্যে ‘সেক্সুয়াল কমপ্যাটিবিলিটি’ না থাকা জীবনে কী ভয়ঙ্কর, নয়পলের জীবন তার অকাট্য প্রমাণ।

নতুন জীবন

ইন্দোনেশিয়ায় নয়পল-মার্গারেটের চিরবিচ্ছেদ। ক্যান্সার-আক্রান্ত প্যাট্রিসিয়াকে বাড়িতে রেখে ‘বিয়ন্ড বিলিফ’ বইয়ের মালমশলা খুঁজতে নয়পল তখন বান্ধবীকে নিয়ে জাকার্তায়। সেখানেই ছাড়াছাড়ি। এক সময় ইন্দোনেশিয়া থেকে পাকিস্তানে। সেখানে এক পার্টিতে এক মহিলার সঙ্গে দেখা। পাকিস্তানের মতো ইসলামি দেশে ডিভোর্সি এক নারী! ইনিই পরবর্তী কালে লেডি নাদিরা নয়পল।
এরই মধ্যে চলে গেলেন ক্যান্সার-আক্রান্ত নাদিরা। নয়পলের ডায়রিতে লেখা, ‘শেষ দিন অবধি আমাকে তাড়া করবে প্যাট্রিসিয়ার বিবর্ণ হাসিমুখের জিজ্ঞাসা, ‘কেমন আছ? ভাল? কাজ কেমন এগোচ্ছে?’...প্যাট আচমকা আমাকে চুমু খেল। গত কুড়িটা বছর ও আমাকে এতটুকু ছুঁয়ে দেখিনি। নাদিরার কথা বললাম, প্রতিক্রিয়া নেই। কে জানে, আমার কথা সেই মুহূর্তে ও কতটা বুঝতে পেরেছিল।’ পর দিনই দীর্ঘ কোমায় চলে গিয়েছিলেন প্যাট।
৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬। সারা দিন হিমেল হাওয়া, রাস্তায় জমাট বরফ। একটু আগে প্যাট্রিসিয়াকে কবরে শুইয়ে রেখে বাড়ি ফিরলেন। সারা বাড়ি খাঁ খাঁ, শূন্য বিছানা। টেবিলে ওষুধের স্তূপ। কাজের মাসি ফুডস্টোরে খাবার কিনতে গিয়েছে। আপেল, জলপাই আর চিজ। দোকান থেকে আসা রিসিটের উল্টো পিঠে নয়পল লিখলেন, ‘সবুজ অলিভ। জীবনের প্রতীক। নাদিরার জন্য। আগামী কাল ৯ তারিখই তো হিথরোয় নামছে ও।’ প্রথম স্ত্রীকে সমাহিত করার দিনেই দ্বিতীয় স্ত্রী নাদিরাকে এ ভাবেই জীবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নয়পল।
স্বার্থপর, ধর্ষকাম? কিন্তু যে লোক স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পরেই সবুজ অলিভ আর জীবনের স্বপ্ন দেখে, তাকে ওই সব বিশেষণে বাঁধা যায়? নয়পল তাঁর কাছের নারীদের খাক করে দিয়েছেন, আবার প্রতিটি মুহূর্তে নারীর কাছেই নতজানু হয়েছেন। এখানেই ট্র্যাজেডি।
এর পরও ৭৯ বছরের ট্র্যাজিক নায়ককে অহেতুক আক্রমণ করা যায়?
Previous Item Editorial Next Item



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.