পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পশ্চিমবঙ্গে একটি আস্ত মন্ত্রক রহিয়াছে, সম্ভবত সারা দেশে সর্বাগ্রগণ্য মন্ত্রক। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এই মন্ত্রকের কাজকর্ম বিশেষ চোখে পড়িত না। সম্পূর্ণ দায়সারাভাবে অপেক্ষাকৃত হাল্কা ওজনের কোনও রাজনীতিককে মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হইত। তাঁহার নামও বিশেষ শুনা যাইত না। আদালতের কড়াকড়িতে পরিবেশ লঙ্ঘনের কোনও ঘটনার প্রতিক্রিয়া দিতে কেবল তিনি নিজের উপস্থিতি জানান দিতেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তনকামী সরকার যে এই মন্ত্রকটিকেও সচল ও কর্মচঞ্চল করিয়া তুলিবে, ইহা প্রত্যাশিত ছিল। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপনের মধ্যে সেই সচল তৎপরতা দেখা গিয়াছে। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, স্কুলপড়ুয়া ও স্বেচ্ছাসেবীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, বক্তা ও শ্রোতাদের উদ্দীপনা ছিল লক্ষণীয়। শহরের বিভিন্ন স্থানে নানা অনুষ্ঠানে দিনটি উদ্যাপিত হইলেও নিষিদ্ধ এলাকায় (যেমন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে কিংবা দেশপ্রিয় পার্কের সবুজ মাঠে) উদ্যোক্তা ও অংশগ্রহণকারীদের একের পর এক গাড়ি পার্ক করা ছিল, যাহা কিন্তু পরিবেশ সচেতনতার পরিচয় দেয় না।
দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে, এ দেশের বিশিষ্ট জনেরা ইতরজনদের অর্থাৎ আম জনতাকে সর্বদা যাহা করিতে বলেন, নিজেরা সচরাচর তাহা করেন না। পরিবেশ সচেতনতা জাগাইবার বিষয়টিতেও দেখা যাইতেছে, যাঁহারা এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল ও অগ্রগামী, তাঁহারাই পরিবেশবিধি লঙ্ঘন করিয়া চলিয়াছেন। এই যুক্তি তাঁহাদের ক্ষেত্রে অন্তত খাটিবে না যে, ভিক্টোরিয়া চত্বরে গাড়ি পার্ক না-করা বিষয়ক আদালতের নিষেধাজ্ঞার কথা তাঁহারা ‘জানিতেন না’। তবু যদি কেহ তেমন অজুহাত দেন, সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন থাকে, নিষেধাজ্ঞা থাক বা না থাক, গাড়ি পার্কিং যে ওই সবুজ গালিচার উপর অত্যাচারের শামিল, পরিবেশ-বিশেষজ্ঞ হিসাবে তাহা তাঁহাদের জানা উচিত। যে স্কুলপড়ুয়াদের বাহনগুলি দেশপ্রিয় পার্কের সবুজের উপর দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করানো ছিল, তাহারা অতটা সচেতন না হইলেও সংগঠকদের কাছে তো সেই সচেতনতা প্রত্যাশিত। তাঁহারাই বা কোন আক্কেলে পরিবেশ দিবস উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে অত দূষণকারী গাড়ির সমাবেশ ঘটাইয়াছিলেন?
যদি পরিবেশ সচেতনতার পরাকাষ্ঠা নির্মাণ করিতে হয়, তবে পরিবেশ মন্ত্রক, দফতরের কর্মী, পরিবেশবিদ, অসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মকর্তা, সকলকেই জীবনাচরণে পরিবেশবান্ধব সামগ্রী ব্যবহার করিতে হইবে। এক-একজন কর্মকর্তা বা বিশেষজ্ঞ এক-একটি গাড়িতে না আসিয়া পুল-কার পদ্ধতি ব্যবহার করা, যাহাতে জ্বালানির অপচয় না-হয়, পেট্রোল বা ডিজেল-চালিত যানের পরিবর্তে বায়ো-ডিজেল বা সৌরশক্তি বা ব্যাটারি চালিত যান ব্যবহার, পরিবেশ সংক্রান্ত যাবতীয় অনুষ্ঠানে খনিজ তেল বা তাপবিদ্যুৎ-এর বদলে সৌর-বিদ্যুৎ ব্যবহার করা এ ধরনের বিকল্পের দিকে জনসাধারণকে কেমন করিয়া আকৃষ্ট করা যাইবে, যদি পরিবেশবিদরা নিজেরাই সাবেক জ্বালানি-সংহারক উপভোক্তা থাকিয়া যান? আসলে পরিবেশ সচেতনতা কোনও সেমিনার বা উদ্যাপনের অনুষ্ঠান নয়, ইহা একটি সর্বক্ষণের আবেগ, যাহাকে জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রসারিত করিতে হয়। এ দেশে এখন পরিবেশবিদের অভাব নাই। অনেকেই পরিবেশ চেতনা বৃদ্ধির কাজটিকে পেশা বা বৃত্তিতে পরিণত করিয়াছেন। ভাল লক্ষণ। তবে সর্বাগ্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করাটাই প্রধান কাজ। |