|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
তোষণের বৃথা চেষ্টা |
শেষ রাতে জয়ী হইবার চেষ্টা করিলেই যে ওস্তাদ প্রতিপন্ন হওয়া যাইবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নাই। ইউ পি এ সরকারকেও তাই ওস্তাদের তকমা দেওয়া যাইতেছে না। রামলীলা ময়দান হইতে শেষ রাতে বাবা রামদেবকে উৎখাত করিবার ফলে তাঁহার অনশন-কুনাট্য বন্ধ করা গিয়াছে, কাঁদানে গ্যাস ও পাথর ছোড়াছুড়ি সত্ত্বেও যথাসম্ভব কম সংঘর্ষের মাধ্যমে তাঁহার দুর্দম ভক্ত-অনুচরদের ছত্রখান করা গিয়াছে, এ সবই সত্য। কিন্তু তবু রামদেবের মতো ব্যক্তিকে তাঁহার ঘোষিত কুনাট্য হইতে নিবৃত্ত করিতে এতখানি সময় কেন লাগিল, এত দূর তাঁহাকে কেন আগাইতে দেওয়া হইল, এই সব প্রশ্ন সরকারের দিকে ধাবিত হইবেই। প্রশ্ন উঠিবেই, যে সকল অবাস্তব দাবির অবতারণা করিয়া তিনি সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়াছিলেন, তাহার মোকাবিলার জন্য কেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-সহ চার-চার জন মন্ত্রী তাঁহার সহিত আলোচনার নিমিত্ত বিমানবন্দর পর্যন্ত ছুটিয়া গেলেন, প্রচারমাধ্যমের চড়া আলোর সামনে তাঁহাকে ও তাঁহার দাবিগুলিকে এতখানি গুরুত্ব কেন দিলেন, রাজনৈতিক ভাবে তাহা একটি সুস্থ অথবা সফল চাল হইল কি না, ইত্যাদি। রামদেব-সংকট সংক্রান্ত সিদ্ধান্তসমূহ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গাঁধীর নেতৃত্বে ক্যাবিনেট কমিটিতে গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেস দলের মধ্যে এ বিষয়ে প্রচুর মতদ্বন্দ্ব: পুরাতন নেতারা অনেকেই প্রশ্ন তুলিয়াছেন, এবং গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছেন।
আশঙ্কাগুলি যথেষ্ট সঙ্গত। বাবা রামদেবের প্রতি ভক্তিভাব প্রদর্শন করিয়া যে ভাবে তাঁহার সকল বক্তব্যকে প্রয়োজনের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হইল, তাহাতে কংগ্রেসের ‘সংখ্যাগুরু-তোষণ’নীতি অর্থাৎ ‘নরম হিন্দুত্ব’ নীতি পরিষ্কার। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার ক্যাবিনেট পারিষদ নিশ্চয়ই ভুলিয়া যান নাই যে ইতিপূর্বে যত বার কংগ্রেসের তরফে এমন নরম হিন্দুত্বের পথ পরিক্রমা হইয়াছে, তত বারই ফল হইয়াছে ভয়ানক। ইন্দিরা গাঁধীর আমলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বিরাট উত্থানই হউক, কিংবা রাজীব গাঁধীর সময়ে রামমন্দিরের দরজা খুলিয়া পরবর্তী সাম্প্রদায়িক হানাহানির পথ প্রশস্ত করাই হউক, সংখ্যাগুরু সমাজকে তুষ্ট করিয়া অত্যধিক নমনীয়তা দেখাইবার পদ্ধতিটি যে দেশের পক্ষে সুফলদায়ক হয় নাই, সনিয়া ও মনমোহন তাহা জানেন। দলের জন্যও এই পথে কোনও সুফল আসে নাই। দীর্ঘমেয়াদে বার বারই বিজেপি-র কাছে পর্যুদস্ত হইয়াছে কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্বের পথ। এই বার্তা স্মরণ রাখিয়া, এ বারও কি কংগ্রেস নেতাদের উচিত ছিল না প্রশাসনিক নীতিতে দৃঢ় থাকা? বিজেপি যে ভাবে রামদেবের মঞ্চটি আত্মসাৎ করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে, তাহার বিপরীতে এই মঞ্চ হইতে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখিয়া বিষয়টির মোকাবিলা করা? কিন্তু সেই দৃঢ়তা কোথায়? দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারের অন্যান্য কাজের সঙ্গে সঙ্গতি রাখিয়া এ ক্ষেত্রেও বহু দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর, বহু ভুল পদক্ষেপের পর ঠিক পথটি যদি-বা গ্রহণ করা হইল, ক্ষতি যাহা হইবার তাহা হইয়া গেল। ঠিক পদক্ষেপ সত্ত্বেও সুশাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা গেল না।
বস্তুত মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে দ্বিতীয় পর্বের সরকার বিষয়ে এই তথ্যটিই ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকিবে। যে কোনও বড় ও বিপজ্জনক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়াইয়া কত বিলম্বে কত কম প্রতিক্রিয়া জানানো যায়, তাহার উদাহরণ হইয়া থাকিবে এই সরকার। দুর্নীতি বিষয়ে আজ যে রামদেব কিংবা আন্না হাজারের মতো বিক্ষোভকারীরা এতখানি গুরুত্ব পাইতেছেন জনগণের কাছে, তাহার জন্যও এই ‘অতিবিলম্বে লঘুক্রিয়া’ দায়ী। যে পরিমাণ দুর্নীতির দায় সরকারের স্কন্ধে চাপিয়াছে, তাহার উপশমের যোগ্য ব্যবস্থা আজও গৃহীত হইয়াছে কি? নিজেদের দায়বদ্ধতা প্রমাণের কাজটি এখনও বাকি, তাহার মধ্যে রাতের চুপিসাড়ে এই রামদেব-উৎখাত-পর্ব সরকারের নিজের অসীম দুর্বলতাই প্রমাণ করে। |
|
|
|
|
|