আমেরিকা-রাশিয়ার সেই ঠান্ডা যুদ্ধের ছায়া দু’দশক পরে যেন আবার ফিরে আসছে। এ বার যার মাধ্যম ইন্টারনেট। এই ঠান্ডা যুদ্ধের কেন্দ্রে আছে ইন্টারনেটে তথ্য চুরির অভিযোগ। পরিভাষায় যাকে বলা হয় হ্যাকিং। যে হ্যাকিংয়ের সমস্যায় এই মুহূর্তে জর্জরিত বিশ্বের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলি।
চিনের মাটি থেকে গুগলের ই-মেল পরিষেবায় ফের সাইবার আক্রমণের অভিযোগ ওঠার পর অন্তত এমন সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্বের প্রথম সারির বিশেষজ্ঞদের এক বড় অংশ। তাঁদের মতে, হয়তো যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি এখনও। কিন্তু এ নিয়ে চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাগযুদ্ধ যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে দুই দেশের সম্পর্কে অবনতির লক্ষণ স্পষ্ট। ঠিক যে ভাবে পারমাণবিক সমরসজ্জা নিয়ে আমেরিকা-রাশিয়ার টক্কর এক সময় ঘোর অনিশ্চয়তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল পৃথিবীকে। তাই এই বরফ গলাতে অবিলম্বে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনায় বসতে পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। আলোচনায় সামিল হতে বলছেন ইউরোপ এবং এশিয়ার প্রধান দেশগুলিকেও। কারণ, আগামী দিনে বহু ক্ষেত্রে হ্যাকিংয়ের আঁচ বিভিন্ন দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপরেও পড়বে বলে তাঁদের অভিমত।
সমস্যাটা কোথায়?
গত ২ জুন ফের চিনের মাটি থেকে সংস্থার ই-মেল পরিষেবায় হ্যাকিংয়ের অভিযোগ এনেছে গুগল। এই বহুজাতিক মার্কিন ‘সার্চ ইঞ্জিন’-এর অভিযোগ, সম্প্রতি সেখানে হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন তাদের ই-মেল পরিষেবা জি-মেলের কয়েকশো গ্রাহক। যাঁদের অনেকেই মার্কিন প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তা, এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের (মূলত দক্ষিণ কোরিয়া) সরকারি অফিসার, সেনাবাহিনীর কর্তা এবং সাংবাদিক। অনেকে আবার চিনেরই রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মী। গুগলের দাবি, এই হ্যাকিং করা হয়েছে জিনান থেকে। যাদের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে, সেই বেজিং অন্যের ই-মেল অ্যাকাউন্ট থেকে এ রকম অবৈধ ভাবে তথ্য হাতানোর চেষ্টার কথা অবশ্য পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছে চিন সরকার। এবং এর পরই এ বিষয়ে তদন্তে নামার কথা ঘোষণা করেছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই।
চিনের বিরুদ্ধে গুগলের এই অভিযোগ কিন্তু প্রথম নয়। এর আগে গত বছরের জানুয়ারিতে চিনের বিরুদ্ধে এই একই অভিযোগ এনেছিল তারা। তখন চিন থেকে গুগ্লের ব্যবসা গোটানোর ‘হুমকি’কে ঘিরে তোলপাড় হয়েছিল সারা বিশ্ব। মার্কিন-চিন কূটনৈতিক সম্পর্কে এই ঘটনা প্রভাব ফেলবে না বলে দাবি করেও, তখন এক বিবৃতিতে এ নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছিলেন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন। সর্বসম্মত নিন্দা প্রস্তাব পাশ করেছিল মার্কিন সেনেট। নিন্দা করা হয়েছিল ইন্টারনেটের মতো তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে চিনে সরকারি নজরদারির। প্রত্যাশিত ভাবেই এর প্রতিবাদ করে কড়া ভাষায় ওয়াশিংটনকে বিঁধেছিল বেজিংও। তিক্ত হয়েছিল দু’দেশের সম্পর্ক।
অভিযোগের আঙুল কি শুধু চিনের দিকেই?
হ্যাকিং নিয়ে বারবার চিনের দিকে আঙুল উঠলেও, বিভিন্ন সময়ে এই একই অভিযোগ উঠেছে পশ্চিমী দুনিয়া, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর বিরুদ্ধে। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা পেতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবৈধ ভাবে তথ্য হাতানোর চেষ্টা করেছে তারাও। তা ছাড়া, হ্যাকিংয়ের মুখে পড়ার অভিজ্ঞতা গুগলেরই প্রথম নয়। সম্প্রতি এই একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে মার্কিন যুদ্ধবিমান নির্মাতা লকহিড-মার্টিন, জাপানি বৈদ্যুতিন পণ্য বহুজাতিক সোনি-সহ বেশ কয়েকটি সংস্থা। তবে গুগল-কে কেন্দ্র করেই সব থেকে বেশি ‘যুদ্ধং দেহি’ সুর চিন ও মার্কিন প্রশাসনের।
হাতেনাতে হ্যাকিং ধরা কি সম্ভব?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কাজ যথেষ্ট শক্ত। বিশেষত, যেখানে হ্যাকার অসম্ভব ধূর্ত বা তার পিছনে মদত রয়েছে দেশের সরকারের, সেখানে এই কাজ অত্যন্ত কঠিন। গুগলের অভিযোগ সত্যি হলে, তার পিছনে আসলে কার হাত, তা শনাক্ত করা কিন্তু বেশ শক্ত। অভিযুক্ত দেশের সেনা গোয়েন্দা বিভাগ, অন্য কোনও সরকারি দফতর নাকি নিছকই নিজের শোওয়ার ঘরে কোলে ল্যাপটপ নিয়ে বসা হ্যাকার হাত থাকতে পারে এদের যে কারওরই। অনেক ক্ষেত্রে আবার চেষ্টা থাকে সন্দেহের তির অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার। যেমন, সম্প্রতি চিনা ভাষায় হ্যাকিংয়ের কোড লিখেছিলেন রাশিয়ার কয়েক জন হ্যাকার।
তা হলে সমাধানের উপায়?
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুনিয়া জুড়ে সাইবার-সুরক্ষা কবচ তৈরির একমাত্র উপায় ফলপ্রসূ আলোচনা। নিজেদের ভুল বোঝাবুঝি মেটাতে সম্প্রতি লন্ডনে বৈঠক করেন চিনা ও মার্কিন প্রতিনিধিরা। তাঁদের বক্তব্য, এ ভাবে বারবার আলোচনার টেবিলে বসতে হবে বিভিন্ন দেশকে। তৈরি করতে হবে ঐকমত্য। তবেই রেহাই মিলবে সাইবার আক্রমণ আর তাকে ঘিরে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ থেকে।
নইলে স্রেফ নেটে হেঁটেই আর একটা বিশ্বযুদ্ধ এসে পড়বে পৃথিবীর ঘাড়ে! |