|
|
|
|
|
|
|
|
ভাঙা নৌকোর
তিন বেলা |
মানব চক্রবর্তী
|
সকাল |
কুর্মিপাড়ার খাটাল থেকে দুধ নিয়ে ফিরছিল অখিল। ইউনিট-টু’র স্কিলড ফিটার। তখনও অন্ধকার পুরো কাটেনি।
শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস অখিল কুর্মিপাড়ার বকু যাদবের খাটাল থেকে দুধ আনে। ফেরার পথে রাঁচি মোড়ের বড় শিশুগাছের মাথার ওপর সূর্য ওঠা দেখে। যেহেতু পাশ দিয়েই রাস্তা, সেই ভোররাত থেকেই দূরপাল্লার বাস যায়। হলদিয়া-আরামবাগ-কাটোয়া-বর্ধমান। সে কারণেই রাঁচি মোড়ে বুধেশ্বরের চায়ের দোকানটা ওই ভোররাতেও খোলা থাকে। বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীরা চা-বিস্কুট খায়।
অখিলও রোজই এই সময়টা বুধেশ্বরের দোকানে চা খায়। একটা সিগারেট ধরায়। তার পর ঘরে ফেরে। ঘর মানে কোম্পানির কোয়ার্টার্স। তিন তলা বিল্ডিং, ন’টা করে ফ্ল্যাট। দু’কামরার। ছোট রান্নাঘর। বাথরুম।
দশ-বারো বছর আগেও এলাকাটা দারুণ জমজমাট ছিল। প্রতি দু’বছর অন্তর কোম্পানির খরচায় চুনকাম হত। নিয়ম করে কোয়ার্টার্স মেনটেনেন্স। স্ট্রিট লাইটের আলো মোহময় মালা হয়ে সারা রাত জ্বলত।
এখন ও-সব স্মৃতি। একটা নামকরা শিল্পসংস্থা কী কারণে কে জানে খোঁড়াতে শুরু করল। বাইরের অর্ডার বন্ধ হয়ে গেল। কাঁচামালে টান ধরল। শুরু হল শ্রমিক ছাঁটাই। সেই সঙ্গে বিক্ষোভ, আন্দোলন, অবরোধ। তার পর এক দিন রুগ্ণ শিল্পের তকমা পেয়ে যেতেই সব কিছু বদলে গেল। মাইনে অনিয়মিত। প্রথম প্রথম তিন মাস বাকি পড়লে এক মাসেরটা দিত। তার পর বকেয়া বাড়তে লাগল। এখন তো যাকে বলে ভয়াবহ অবস্থা। গত সাত মাস মাইনে হয়নি। কবে হবে বা আদৌ হবে কি না, কেউ জানে না।
মাঝে মাঝেই গুজব ছড়ায়। টাটারা নাকি কারখানাটা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কখনও শোনা যায় ‘ভেল’ নেবে, ভারী শিল্পের সহযোগী যন্ত্রাংশ তৈরি করবে। এ সব কথা ক্ষণিকের আনন্দ দেয়, তার পরই দুঃসহ হতাশা। এ দিকে মাসের পর মাস মাইনে না পেয়ে শ্রমিকরা এখনও যে কী করে বেঁচে আছে, সে খবর কেউ রাখে না। কারখানা বাঁচাতে কত রাজনীতি! কত নেতা এল, গেল। আন্দোলন, ধর্না, মিটিং, মিছিল, অবরোধ... কত কী। নিট ফল শূন্য।
অন্য দিনের মতো আজও অখিল চায়ে চুমুক দিতে দিতে শিশুগাছটার ওপারে সূর্যোদয়ের প্রস্তুতি দেখছিল। পুব কোণে লালচে আভা। তখনই তার নজরে পড়ে ঘন পাতার আড়ালে কী যেন ঝুলছে। ঝড়ে উড়ে আসা ছেঁড়া ফেস্টুন কি? না, তা নয়। একটা যেন ফুলপ্যান্ট। কালচে রং। অখিল কৌতূহলী। চায়ের ভাঁড় শেষ করে এ-দিক ও-দিক তাকিয়ে রাস্তা পার হয়। তার পর গাছের তলায় এসেই দেখল দুটো পা। তার রক্ত জমাট বেঁধে গেল। সে দুধের ক্যান নিয়ে ছুটতে ছুটতে সোজা ফ্ল্যাটে। হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকতেই তাপসী বলল, কী হয়েছে, অমন করছ কেন?
অখিল দম নিয়ে বলল, সুইসাইড!
কে?
তা জানি না। মোড়ের মাথায় শিশুগাছে একটা বডি ঝুলতে দেখলাম।
তাপসী ঠোঁটে আঙুল চেপে বলল, চুপ, আস্তে। তুমিই কি প্রথম দেখলে?
জানি না। তবে সম্ভবত আমিই প্রথম।
খবরদার কাউকে বোলো না। এর পর পুলিশের ঝামেলা হবে। তোমার ডাক পড়বে।
পাগল নাকি। আমি বলব কিছু দেখিনি। কিচ্ছু না। ওহ্... ভয়ে আমার শরীরটা শিরশির করছে। ইস্.... মানুষটা যে কে...
তাপসী ঠোঁট কামড়ে বলল, ওটা যে-কেউ হতে পারে। ভেবে লাভ নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার। সাত মাসের মাইনে নেই। মানুষগুলো যে এখনও বেঁচে আছে, সেটা ভাবলেই অবাক হতে হয়।
একটু থেমে ফের বলল তাপসী, পুন্টির জ্বরটা আসছে আর যাচ্ছে। আট দিন হল। ডাক্তার দেখাবে না?
অখিল ঘোলা চোখে ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে দূরের শিশুগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
শোনো, চাল কিন্তু একটুও নেই। এই বেলায় হাঁড়ি চড়বে না।
অখিলের গালের পেশিগুলো শক্ত হল। ফের ঝুলে পড়ল। যেন সে টাল খেয়ে পড়ে যাবে। তার পর মিনমিনে স্বরে বলল, চা দাও...
সেই থেকে অখিল দোতলার জানলার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে। নজর দূরের শিশুগাছটার তলায়। সকালের কুসুম আলোয় এখন সে দেখতে পাচ্ছে দু’চার জন করে লোক জমা হচ্ছে শিশুগাছটার গোড়ায়। অর্থাৎ একটা মৃত্যু ক্রমশ মান্যতা পাচ্ছে।
চা নিয়ে এল তাপসী। অখিল বলল, দেখো, ভিড় জমেছে। চা খেয়েই আমি যাব। তার পর মুখ-চোখে অদ্ভুত একটা যন্ত্রণার ভঙ্গি ফুটিয়ে বলল, বেঁচেছে।
কথাটা তাপসীকে ছুঁল না। তার হাত খালি। গলা খালি। চোখে শূন্যতা। ভেতরের ঘর থেকে আট দিনের জ্বরে কোঁকাতে থাকা পুন্টির স্বর শুনে বলল, চাল এনো কিন্তু... |
|
দুপুর |
অন্য কোনও উপায় না পেয়ে অবশেষে বিকাশ আমলাদহি বাজারের ‘ছন্দম মিউজিক স্টোর্স’-এ সুচেতার অত শখের হারমোনিয়ামটা বিক্রি করে দিল। চোদ্দো বছর আগে কলকাতা থেকে কিনে আনা, সুচেতার প্রাণই বলা যায়, হারমোনিয়ামটা বিক্রি করতে কষ্ট হচ্ছিল খুবই, কিন্তু এ ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারে বিকাশ। গত দশ বছরে যে কারখানার বয়লারে ধুঁদুলের ঝোপ, চিমনির মাথা ভেঙে পড়েছে, কারখানার শেড চোরেরা সব লোপাট করে দিয়েছে, কাঁচামাল কণামাত্র নেই, মাসের পর মাস মাইনে বাকি, তার শ্রমিক হয়ে বিকাশ আর কী করতে পারত? এক ছেলে এক মেয়ের কলেজের, বইয়ের, মাস্টারের খরচখরচা, সংসার তো আর থেমে থাকে না, সে চলতেই থাকে, তাকে চালু রাখার নিত্যিদিনের খরচ জোটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত বিকাশ জানে ওই হারমনিয়ামে বসে আর সুর তুলতে পারবে না সুচেতা।
অত দামি হারমোনিয়ামটা বেচে দিল মাত্র দু’হাজারে।
বিক্রি করে টাকাটা পকেটে রেখেই বিকাশের চোখের সামনে সুচেতার মুখটা ভেসে উঠল, যেন সে বলছে, দু’হাজারে কত দিন? তার পর?
তড়িঘড়ি দোকান থেকে বেরিয়ে বিকাশ একটা ছোট চায়ের দোকানে ঢোকে। বুঝি সুচেতার প্রশ্নটাই এড়াতে চায়। একটা বিড়ি ধরিয়ে জোরে জোরে টান দেয়, তার পর মনে মনেই আওড়ায়, রুগ্ণ শিল্পের মাইনে না পাওয়া শ্রমিক ভবিষ্যতের কথা ভাবে না, ভাবে আজকের দিনটা কেমন করে কাটবে। আজ কাটলে কালকের চিন্তা।
পাশের লোকটা বিকাশের দিকে অবাক চোখে চেয়ে থাকে। তখনই চা দেয় দোকানি।
তারিয়ে তারিয়ে চা খেতে খেতে বিকাশের মনে পড়ে কাল রাতে
মেয়েটা মাংসের কথা বলছিল। কত
দিন মাংস খায়নি। পাড়ায় কোনও বিয়ে বাড়িও হচ্ছে না।
বিকাশের শত দুঃখেও হাসি পায়।
রুগ্ণ শিল্পের সিলমোহর লেগে যাওয়া একটা কারখানার শ্রমিকদের ঘরে যেন অন্নপ্রাশন, পৈতে, বিয়ে, বউভাত এ সব কিছু হতে নেই। কথাটা অস্বীকার করতে চেয়ে দ্রুত চা শেষ করে সে। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। আজ বিকাশ মুরগির মাংস কিনবে। অন্তত মেয়েটার মুখে তো হাসি ফুটবে। বিকাশ দ্রুত মাংসের দোকানে যায়। সাড়ে সাতশো গ্রাম মুরগির মাংস কেনে। সঙ্গে আদা-পেঁয়াজ-রসুন-আলু। তার পর দ্রুত ফেরার পথ ধরে। বিকাশ বোঝে এখন তার হাঁটার স্পিড বেড়ে গিয়েছে।
ফেরার পথে বকুলতলায় দেখা গগন পাত্রর সঙ্গে। টাইম বুথ ক্লার্ক। সমবয়সী। বিকাশকে দেখে সে অবাক স্বরে বলল, তুই বাজার করে ফিরছিস? আশ্চর্য তো!
হাতে বাজারের ব্যাগটা নাচিয়ে বিকাশ ভাবল মাংসের কথাটা আলগোছে শুনিয়ে দেয়। কিন্তু ওর বলা ‘আশ্চর্য তো’ কথাটা বেসুরো লাগায় পাল্টা প্রশ্ন করল, মাইনে না পাওয়া শ্রমিকের বাজার করাটাও তবে আশ্চর্যের?
গগন ঢোঁক গিলে বলল, না, তা নয়, তোর তিন তলার পরিমল আজ অমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল কিনা, তাই বলছিলাম...
বিকাশ আঁতকে উঠল পরিমল? কী করেছে?
ওমা! জানিস না! সুইসাইড করেছে। রাঁচি মোড়ের একটা গাছে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়েছে। ইস্, কী দৃশ্য! তিনটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ঘরে। তাদের কথাটা এক বার ভাবলি না?
বিকাশ অস্ফুটে দু’বার ‘পরিমল পরিমল’ বলেই দ্রুত হাঁটতে থাকে। মনে পড়ে কাল রাতে কী নিয়ে যেন পরিমলের সঙ্গে তার বউয়ের তুমুল ঝগড়া হচ্ছিল। ভোররাতে দেখা ঝুলন্ত মানুষটা যে তারই প্রতিবেশী, এটা ভেবে তার দুঃখ হল, অস্বস্তিও। অস্বস্তির কারণ মাত্র দু’দিন আগে পরিমল তার কাছে দুশো টাকা ধার চেয়েছিল। যে বিকাশের নিজেরই সংসার চলে না, বাজারে একগলা ধার, পাওনাদারের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়, সে ওই ধারের কথা শুনে বিচ্ছিরি একটা গাল দিয়ে বলেছিল, আর লোক পেলি না? আমার অবস্থা জানিস? রোজ রাতে মনে হয় ফ্যানে দড়ি লটকে ঝুলে পড়ি...
বিকাশের অস্বস্তি ক্রমে দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়। তবে কি পরিমল তারই নির্দেশিত পথটা বেছে নিল? তবে তো ওর মৃত্যুর জন্য সেও আংশিক ভাবে দায়ী। ইস্, কী ভুল সে করেছে! ধার দেওয়ার ক্ষমতা নেই, সেটা অন্য কথা। কিন্তু ওই রকম একটা বাজে কথা কেন যে সে বলতে গেল! ছিঃ...
পরিমলের ডেডবডি হাসপাতালে। সেখান থেকে মহকুমা হাসপাতালে যাবে। পোস্টমের্টেম হবে। তার ফ্ল্যাটে ঠাসা ভিড়। বিকাশ থলেটা সুচেতার হাতে দিয়ে চাপা স্বরে বলল, মুরগির মাংস। একটু
বেলা করে রেঁধো। পরিমলের ফ্ল্যাটের ভিড়টা কাটুক।
সুচেতার চোখ ছলছলে।
বিকাশ বুঝতে পারল না ঠিক ভাবে, কেন তার চোখে জল! এত দিনকার প্রতিবেশীর মৃত্যু? নাকি অত সাধের হারমোনিয়ামটা বিক্রি করে ফেরা! সে দ্রুত পরিমলের ঘরে ঢুকল। ওর বউটা কেঁদেই চলেছে। বড় ছেলেটা জানলার গরাদ ধরে দূরের কারখানা গেটের দিকে তাকিয়ে। ও কেন ওই দিকে চেয়ে আছে? তবে কি পনেরো বছরের একটা ছেলেও বুঝতে পারছে রুগ্ণ শিল্পের তকমা পাওয়া একটা ধস্ত-কারখানা আর সাত মাস মাইনে না পাওয়া শ্রমিক-কর্মচারী, দুটোই গঙ্গায় তলিয়ে যাওয়া পাড় একটা মৃত্যু আর একটা মৃত্যু ত্বরান্বিত করে?
তখনই পরিমলের বউটা মুখ তুলে সমবেত প্রতিবেশীদের দিকে চেয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, বলতে থাকে, কত লোকের কাছে সাহায্য চেয়েছিল, কেউ দিলে না, দুশো টাকাও কেউ দিলে না, কত বন্ধু, কত চেনাজানা কেউ দিলে না...
বিকাশ একটু পেছিয়ে আসে। এক এক করে প্রতিবেশীরা চলে যায়। এর পর আর সান্ত্বনা দেওয়া যায় না। বিকাশ মৃদু স্বরে বলে, সবাই তো এক নৌকোর যাত্রী...
সুকেশ, অরিন্দম, সহদেব, বিনয়রা ঘাড় নেড়ে সমর্থন জানায়।
ঘণ্টাখানেক পরে পরিমলের ঘর ফাঁকা। শুধু বউটার ডুকরে ওঠা কান্না আর ঘ্যাঁঙানি।
বেলা বাড়ছে। বিকাশ তার ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে দেয়। এমনকী রান্নাঘরের জানলাও।
সুচেতা মাংস কষাতে-কষাতে বলে, ছোট ঘর, হাওয়া বাতাস নেই, জানলা বন্ধ করছ কেন?
বিকাশ চাপা গলায় বলে উঠল, গন্ধ আটকানোর চেষ্টা... অন্তত আজকের দিনটা...
কথাটা বলেই বিকাশের লজ্জা লাগল। না... এতটা স্বার্থপর তো সে নয়। একটা বিড়ি ধরিয়ে সে চেয়ারে বসে রইল। নির্জীব। মাংস কষানোর ভুটভুট শব্দ উঠছিল। তার মনে পড়ে পরিমল দুশো টাকার জন্য কেঁদে ফেলেছিল।
|
|
রাত |
তাসের আসর বসেছে কমিউনিটি সেন্টারে। এক কালে এখানে টেবিল টেনিস বোর্ড ছিল। ক্যারাম ছিল। ওপরে শেড ছিল। পাশে ছোট্ট একটা লাইব্রেরি। এখন কিছুমাত্র নেই। ওপরের করোগেটেড টিন, অ্যাঙ্গেল সব চুরি হয়ে গিয়েছে। দেয়াল খুঁড়ে জানলাদরজা সব নিয়ে গিয়েছে। এখন শুধু ভাঙা চাতাল। ভূতের মুখের মতো অন্ধকার। সেখানেই তাস খেলা হয় মোমবাতি জ্বেলে। এও বিনোদন, বন্ধ-কারখানা শ্রমিকের।
ব্রজ সরকার ও তার ছেলে লাল্টু বড় একটা দরজা দু’দিকে ধরে নিয়ে আসছে। ওদের দেখে গগন বলল, কী হে ব্রজদা, ওটা আবার কোথায় লাগাবে? ব্রজর যুবক পুত্র লাল্টু চুল ঝটকান মেরে বলল, ইস্কুলের একটা দরজা খুলে নিয়ে এলাম। ওহ্... কম রাস্তা! পাইখানার পাল্লা পচে ভেঙে গেছে। এই দরজাটা সেট করে দিলে দিব্যি হবে।
বাপ-ব্যাটা দু’দিকে হাত লাগিয়ে ইস্কুলের দরজা বয়ে নিয়ে চলল।
তাসের আড্ডায় পরিমলের মৃত্যু-প্রসঙ্গ। সুকেশ বলল, এর চেয়ে হঠকারি কাজ আর কিছু হয় না। ওর চেয়েও কষ্টে আছে অনেকে। কেন, বসন্ত তোপদার? তিনটে অত বড় বড় মেয়ে নিয়ে বেঁচে নেই?
সহদেব খিঁচিয়ে উঠল, তোপদারের কথা ছাড়, বড় দুটো মেয়ে তো লাইনে নেমে গেছে... জঘন্য ব্যাপার। ওর ঘরে কারা রাত্তিরে আসে জানিস? পাড়াটার একদম বদনাম করে দিল।
হরেন দাস বলল, রূপনারায়ণপুর বাজারে পানের দোকান বসিয়ে বড় ছেলেটাকে লাগিয়ে দিয়েছি। মোটামুটি মন্দ চলে না। আসলে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই প্রধান। এর পর তো আরও খারাপ দিন আসবে। তখন? সবাই কি গণআত্মহত্যা করবে?
ভূপতি বিড়ি ধরিয়ে বলল, সেটা ঠিক। কিন্তু যে ভাবে আছি সেটাকে ঠিক বেঁচে থাকাও বলে না। সবাই কুকুরের মতো বেঁচে থাকতে নাও চাইতে পারে...
সরু মোমবাতি গলতে গলতে নিভে গেছে। খেলা শেষ। বোধ হয় কথাও। একটা অন্ধকার আরও একটা ভয়ংকর অন্ধকারকে বুঝি মনে পড়ায়।
তখনই একটা স্কুটারের আলো দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। সুকেশ বলল, বোধ হয় অমৃতেন্দুদা...
তার কথা শেষ হতে না হতেই অমৃতেন্দু পালের স্কুটারটা থামল কমিউনিটি সেন্টারের সামনে। ট্রেড ইউনিয়নের নেতা। হোক না সাত মাস মাইনে না হওয়া রুগ্ণ শিল্পের নেতা, তার ব্যস্ততার শেষ নেই। সম্ভবত শিল্পসংস্থা যত রুগ্ণ হয়, নেতারা তত বলবান হয়।
বাজখাঁই স্বরে হেঁকে উঠল অমৃতেন্দু, শ্মশানে পরিমলের ডেডবডির সৎকারের ব্যবস্থা করে ইউনিয়ন অফিস হয়ে ফিরছি। তা তোরা এমন ঝিমক্যালার মতো অন্ধকারে বসে আছিস যে! শোন, শোষিত মানুষকে চিরকাল লড়াই করেই বাঁচতে হয়। আমাদের লাগাতার লড়াইয়ের জন্যই সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট থেকে একটা সারভাইভাল প্যাকেজ এসেছে। আগামী পনেরো তারিখের মধ্যেই সবার সব বকেয়া মাইনে দিয়ে দেবে। তার পর ভারী শিল্প মন্ত্রকের এক প্রতিনিধি দল আসবে কারখানা পরিদর্শনে। সম্ভবত কারখানাটাকে আবার বাঁচিয়ে তোলার নতুন একটা চেষ্টা শুরু হল। কলকাতার কর্পোরেট হাউসে দিল্লি থেকে ফ্যাক্স এসেছে। নে, এ বারে আলো জ্বাল। আনন্দ কর। কাল সকাল থেকে আমরা পাড়ায় পাড়ায় মাইকিং করব। আবির খেলব।
অমৃতেন্দু থামতেই সহদেব লাফিয়ে উঠল, সাত মাসের মাইনে একসঙ্গে? উরি বাবা, সে তো অনেক টাকা...
তার পর অন্যান্যদের সমবেত উল্লাসে-উচ্ছ্বাসে কথায় কথায় জট বেঁধে গেল।
মাঝখানে এক বার সুবোধ সাহা বলার চেষ্টা করল, ইস্, বেচারা পরিমল, খবরটা এক দিন আগে পেলেও...
তার কথা চাপা পড়ে গেল অন্যদের অজস্র জিজ্ঞাসায়। বোধ হয় পরিমলের মৃত্যু প্রসঙ্গটাই উধাও হয়ে গেল কলোনি থেকে। মাঠ ভেঙে রাস্তা ক্রশ করে টলতে টলতে আসছে বিষ্ণু রজক। পাঁড় মাতাল। এক কালের গ্রেড ওয়ান মেশিনিস্ট। অমৃতেন্দুকে ঘিরে রীতিমত ছোটখাটো একটা ভিড়। বিষ্ণু থমকে দাঁড়িয়ে বলল, পেন্নাম নেতাবাবু...
বিনয় বিড়িতে লম্বা টান মেরে বলল, কী রে, ক’বোতল গিলেছিস? তুই এ বারে বড়লোক হয়ে যাবি রে... সাত মাসের মাইনে পাবি একসঙ্গে...
সবাই ভাবল আনন্দে বিষ্ণু মাটিতে গড়াগড়ি খাবে বা চিৎকারে পাড়া মাথায় করবে। কিন্তু সে কিছুই করল না। চুপ। তার পর অমৃতেন্দুর খুব কাছে এসে চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল।
ইস্... কী বিচ্ছিরি গন্ধ! যা ভাগ... কী দেখছিস? ঠেলা মেরে সরিয়ে দিল বিষ্ণুকে।
বাঁশপাতার মতো অল্প দুলে বিষ্ণু বলল, কী আর দেখব! কারখানার সোনার দিন দেখলাম, শ্মশান-কারখানা দেখলাম, এখন দেখছি গিরগিটির দিন...
কথাটা শেষ হওয়া মাত্র এক চড়। অমৃতেন্দু নোংরা মোছার মতোই হাত মুছল নীল রুমালে। অন্যরা আর সময় নষ্ট না করে মনে মনে ডি এ, বেসিক-এর যোগফলকে সাত দিয়ে গুণ করতে করতে ছুটে গেল যে যার ঘরে। তার পরই পাওয়ার কাট। অন্ধকার কলোনি। গত কয়েক বছর ডি ভি সি-র বিদ্যুতের বিশাল অঙ্কের দেনা না মেটানোয় এই ব্যবস্থা। রাত দশটা থেকে সকাল ছ’টা অবধি অন্ধকার।
দিনটা অবশ্য দেয়। হিউমেনিটেরিয়ান গ্রাউন্ডে।
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|