রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
সাক্ষী পতঙ্গ

হাইওয়ের ধারে লাশ

৪ জুন। ক্লান্ত বিকেল ঘেঁষা এক নির্জন সন্ধ্যায় আমেরিকার এক হাইওয়ে। আলো পড়ে আসছে। আলো এ দিকে বেশ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে আসে। সার্জেন্ট বাইক নিয়ে সোজা হাইওয়ের রাস্তা ধরলেন। রাস্তায় এই সময় এমনিই লোক কমে আসে। দূর থেকে মনে হচ্ছে কালভার্টে কিছু যেন একটা পড়ে। এগিয়ে গিয়ে দেখলেন রাস্তার ধারে এক তরুণীর প্রায় বিবস্ত্র শরীর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আমেরিকার এই অঞ্চলের তিনি দুঁদে অফিসার। কাছে গিয়ে থমকে গেলেন। নৃশংস ভাবে আঘাত করা হয়েছে মাথায় আর ঘাড়ে। প্রতিহিংসার ভয়ানক রূপ। এ কী! মেয়েটিকে তো তিনি বেশ চেনেন। মেয়েটি স্থানীয় একটি পাবের কলগার্ল!
এক দিন পর এল অটোপ্সি রিপোর্ট। জানা গেল, মৃত্যুর কারণ কোনও এক ভারী ধারাল অস্ত্রের সাহায্যে বেশ অনেকগুলি আঘাত। তরুণীর ভাই ঠিক চার দিন আগেই তাঁর কাছে মিসিং ডায়েরি করিয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় পাবে তাকে গত ৩১ মে শেষ বার এক আর্মি অফিসারের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল। পাব থেকে গভীর রাতে সে ওই অফিসারের সঙ্গেই বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ সব কিছুই আঙুল তুলছে ওই আর্মি অফিসারের দিকেই। কিন্তু কোথাও একটা জট পেকে যাচ্ছে। কোনও তথ্য ঠিক কেন বলছে না মৃত্যু ৩১ মে হয়েছিল? কয়েক ঘণ্টা এ দিক ও দিক হলেই প্রমাণ হয়ে যাবে ওই আর্মি অফিসার নির্দোষ। অতএব একদম ঠিক সময় চাই।
আবার শুরু হল তদন্ত। ক্রাইম সিনের সব ছবি তোলা আছে। মৃতদেহের ক্ষতের পাশে অনেক অনেক ম্যাগট (মাছির লার্ভা), জীবন্ত মাছি ব্লো ফ্লাই আর অন্য কিছু স্থানীয় পতঙ্গ ঘোরাফেরা করছিল। কিছু ফ্লাই সংগ্রহ করে আনা হয়েছে ফরেনসিক ল্যাবে। কিছু ফ্লাই জীবন্ত রাখা হয়েছে কালচার করে দেখার জন্য। আর কিছু তরল প্রিজারভেটিভ-এ রেখে দেওয়া হয়েছে। ক্রাইম সিনের যে সব ছবি তোলা আছে, সেগুলি এই তথ্য সমর্থন করছে।
আবার অটোপ্সি হল। সারা দিনের আবহাওয়া, সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, বৃষ্টির পরিমাণ, মেঘাচ্ছাদন জানা হল আবহাওয়া দফতর থেকে। হ্যাঁ, এ সব তথ্য বুনে ফেলা গেল নিপুণ ভাবে। এন্টোমোলজিস্ট পূর্ণাঙ্গ মাছির অবয়ব, আকৃতি, প্রকৃতি দেখে ও আবহাওয়ার খবর নিয়ে জানালেন, মাছির প্রথম কলোনির আবির্ভাব হয়েছে দেহটি খুঁজে পাওয়ার চার দিন আগে, মানে ৩১ মে। সে সময় তাপমান ২২ ডিগ্রির মতো ছিল। এই তাপমাত্রায় স্থানীয় মাছিটি এসে বাসা বাঁধে ও বংশবৃদ্ধি করতে পারে। পূর্ণাঙ্গ মাছির বয়স আর ছবি থেকে এই তথ্যের সমর্থন পাওয়া গেল। আবহাওয়া দফতর থেকে জানা গেল, ২২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ছিল সে-দিন। সময়, রাত একটার আশে পাশে। ধরা পড়লেন আর্মি অফিসার পতঙ্গের হাতে। কবুল করলেন অপরাধের কথা।

ব্লো ফাই
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার বসতি, আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটি, খাদ্যাভাস সব কিছুর ওপর নির্ভর করে সেখানকার মাছির প্রকৃতি। যেমন, আমেরিকার উত্তরে ব্লু-বটল ব্লো ফ্লাইস (Calliphora vicina) শীত কালে বেশি পাওয়া যায়। তেমনই গ্রিন বটল ব্লো ফ্লাইস (Phaenicia sericata) গরম কালে মৃতদেহের চার পাশে ঘোরাফেরা করে। আর একটি গ্রিন বটল ফ্লাই-এর (Lucilia illustris) অভ্যাস হল উজ্জ্বল রোদে খোলা জায়গায় মৃতদেহে বাসা বাঁধা, তবে তাদের প্রজনন হয়। আবার ব্ল্যাক ব্লো-ফ্লাই (Phormia regina) আলো মোটেই পছন্দ করে না। সুতরাং ফরেনসিক এন্টোমোলজিস্ট যদি রোদে পড়ে থাকা মৃতদেহের গায়ে ব্ল্যাক ব্লো-ফ্লাই-এর লার্ভা লেপ্টে থাকতে দেখেন, চোখ বন্ধ করে তিনি বলে দেবেন খুনের কিছু পরে মৃতদেহ স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এবং সেই লার্ভার খুব সূক্ষ্ম বিচার করে তার জায়গা ও সময়ও বলে দেওয়া সম্ভব।
যে কোনও খুনের তদন্তে মৃত্যুর ঠিক সময় ও জায়গা জানাটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। ঠিক এই দুটোর ওপর ভিত্তি করে পুরো তদন্ত বা রিকন্সট্রাকশন দাঁড়িয়ে থাকে। পতঙ্গ আর তার লার্ভা এ ব্যাপারে অনেকখানি সাহায্য করে। যেমন খুনের পর কতখানি সময় কেটে গিয়েছে বা খুন করে ঘটনাস্থল থেকে দেহটি আদৌ সরানো হয়েছে কি না ইত্যাদি। পতঙ্গকে ভিত্তি করে ক্রিমিনোলজির এই বিশ্লেষণকে ফরেনসিক এন্টোমোলজি বলে।
১২৩৫ সালে সুং চুজ নামে এক গোয়েন্দা একটি বই লেখেন, যার নাম ছিল ‘The Washing Away of Wrongs’। সেখানে প্রথম এ রকম একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে পতঙ্গের সাহায্যে খুনের কিনারা হয়েছিল। চিনের একটি ছোট কৃষিপ্রধান গ্রামে এক জন মাঝবয়সি কৃষককে হত্যা করা হয় কাস্তে দিয়ে। গ্রামটি কৃষিপ্রধান, তাই প্রায় সবার ঘরেই কাস্তে ছিল। এ বার? গ্রামের যিনি প্রধান বিচারক, তিনি যার যার নিজের কাস্তে হাতে নিয়ে প্রথমে গ্রামের সবাইকে এক জায়গায় লাইন করে দাঁড়াতে বললেন। তিনি একটু থমকালেন, দেখলেন আর সোজা যে খুন করেছে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঠিক কী করেছিলেন তিনি? যেখানে রক্তের সামান্য গন্ধ থাকে, সেখানে গ্রিন বটল ফ্লাই ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসে, সে যতই রক্ত ভাল ভাবে ধুয়ে ফেলা হোক। শুধু আততায়ী কাস্তেতেই ছিল সেই গন্ধ।


গভীর কুয়োর রহস্য
সুদূর দক্ষিণ ইন্ডিয়ানার ঘটনা। এক গভীর উন্মুক্ত কুয়োয় এক তরুণীকে হত্যা করে মৃতদেহ ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তার পর পাথর, পাতা, ফাটা টায়ার ইত্যাদি দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই কুয়োটা ভরে ফেলা হয়েছিল। এত দক্ষতার সঙ্গে কাজটি অপরাধীরা করেছিল যে, ওই কুয়োর ওপরে কয়েক হাজার মাছি না ঘুরলে প্রত্যন্ত এক জঙ্গলের ভিতরে ওই কুয়োটা কারও নজরেই আসত না। মৃতদেহে পচন ধরেছিল। কুয়ো অনেক গভীর হওয়ায় কোনও গন্ধ পর্যন্ত বাইরে এসে পৌঁছয়নি। কিন্তু মাছিদের আকৃষ্ট করার জন্য ওই অল্প গন্ধই যথেষ্ট ছিল। অসংখ্য মাছির জন্য এখানেও শেষ অবধি ধরা পড়ে যায় অপরাধীরা।

বুকের ডাইনে বুলেট
খুব বেশি দিনের ঘটনা নয়। ইংল্যান্ডের এক শপিং কমপ্লেক্সের পার্কিং লটে এক সুবেশী সুন্দরী তরুণীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল। তরুণীর ডান দিকের স্তনে নাইন এম এম বুলেটের একটি গভীর ক্ষত। আর মাথার নীচে ঘন জমে ওঠা কালো রক্ত। সকাল ৬টা। প্রথম কাজে যোগ দিতে আসা কর্মীরা দেখতে পেলেন মৃতদেহ। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তে ক্রাইম সিনের কাছাকাছি কোনও পতঙ্গের প্রমাণ পেলেন না তদন্তকারী দল। মৃতদেহ সরিয়ে নেওয়া হল। যত বেলা বাড়তে লাগল, দেখা গেল আস্তে আস্তে বুলেটের ক্ষত ঘিরে বেড়ে উঠছে গ্রিন বটল ফ্লাই (Phaenicia sericata)। ঘন ডিমের কলোনি জমে উঠতে লাগল ক্ষতস্থানে। এখানেও সেই আগের দিনের আবহাওয়া ও পূর্ণ বয়স্ক ব্লো ফ্লাইয়ের আচরণ ও আকৃতি বিচার করে এন্টোমোলজিস্ট বলে দিলেন, তরুণীকে আততায়ী রাতের গভীর অন্ধকারে হত্যা করেছে। জানা গেল, তরুণী মধ্যরাত অবধি জীবিত ছিলেন। সেই সময়ে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই কেসটিও সমাধান করা হয়।

ডিম ফুটে প্রমাণ
মৃতদেহ বা ক্ষতস্থান থেকে ব্লো ফ্লাই ডিম পাওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এই ডিম বা ডিম্বানু থেকে এন্টোমোলজিস্ট ঠিক পোস্টমর্টেম ইন্টারভ্যাল (PMI) বলে দিতে পারেন। ব্লো ফ্লাইয়ের ডিম ২-৩ মিমি লম্বা, সাদাটে ধরনের হয়ে থাকে। সাধারণত গরম কালে মৃতদেহের উন্মুক্ত অংশে বাসা বাঁধে। শীত কালে এদের অনেক কম সংখ্যায় দেখা যায়। ব্লো ফ্লাই ডিম সাধারণ ভাবে ১-৩ দিনের মধ্যে ফোটে। তবে প্রকৃতি আর আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে। ডিমের ছেদন ও সূক্ষ্ম ভাবে তার প্রকৃতি দেখে, ডিম পাড়ার সময় ও বাসা বাঁধার সময় মানে খুন হওয়ার সময় একেবারে নিখুঁত বলে দেওয়া সম্ভব।

৩৬ ঘণ্টা আগে
শীতের একদম শেষে এক জন তরুণ আমেরিকানের দেহ পাওয়া গেল আমেরিকার দক্ষিণ পশ্চিমে বালিপ্রধান এক অঞ্চলে। মৃতের দেহে বুকে আর পিঠে গুলি বিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। মৃতের বাঁ নাক দিয়ে রক্তপাতে ঢেকে গিয়েছিল বাঁ চোখ। পচন তখনও শুরু হয়নি। চোখের তলা থেকে সংগ্রহ করা হল দানা দানা মাংস। ছোট দানাদার বস্তুগুলো ফরেনসিক ল্যাব থেকে জানানো হল, ব্লো ফ্লাইয়ের ডিমের কলোনি। ডিম পাড়া শুরু হয়ে গেছিল, হ্যাচিংও শুরু হয়ে গেছিল।
ম্যাগটগুলি ছিল এক ধরনের মাছির। (Cochliomyia macellaria the secondary screw worm)। এই ধরনের মাছির জীবনচক্র ও আবহাওয়া সংক্রান্ত খবর মিলিয়ে যা পাওয়া গেল মৃতদেহটি পাওয়ার ২৪-৩৬ ঘণ্টা আগে ডিম পেড়েছে। মৃত্যুর ৩৬ ঘণ্টা আগে ওই তরুণ এক বন্ধুর বাড়ি যান। নিঃসন্দেহ হয়ে তাকে জেরা করা শুরু করলে, বন্ধু দোষ স্বীকার করেন মৃতদেহ পাওয়ার ঠিক ৩৬ ঘণ্টা আগে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।
ম্যাগটস খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। এই বৃদ্ধি ১-৩ সপ্তাহ নেয়। এটা অবশ্য তাদের প্রজাতি আর আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে। লাভার্গুলো একসঙ্গে মৃতদেহের উপর থাকে আর তাদের দেহ থেকে যে উৎসেচক বের হয়, তাতে মৃতের মাংস পেশির তন্তু (Soft tissues) ক্ষয় হয়ে যায়।

আঠারো তথ্য
নভেম্বর মাসে ওয়াশিংটনের কাছে এক জন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর মৃতদেহ দেখতে পান এক বাইক চালক। মহিলার শরীর হাইওয়ে থেকে প্রায় ৫০ ফুট দূরে বেশ গাছপালা ঘেরা এক অঞ্চলে পড়ে ছিল অর্ধ নগ্ন অবস্থায়। শরীর ঠান্ডা কিন্তু রাইগর মর্টিজ ছিল না। আততায়ীর আঘাত ছিল গলায় আর বুকে। ছুরির গভীর ক্ষত। রক্ত ক্ষরণে মৃত্যু। পোস্টমর্টেম থেকে জানা গেল, মৃতদেহ থেকে বড় বড় ম্যাগটস উড়ে বেড়াচ্ছে এবং চলে যাচ্ছে। এটি বিশেষত পূর্ণ বয়স্ক ব্লো ফ্লাইয়ের লার্ভার বিশেষ আচরণ। জানা গেল, মেয়েটি ২১ বছর বয়সি, দুই সন্তান আর বাবা মা’র সঙ্গে কাছেই এক অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকত। আঠারো দিন আগে তার বাবা থানায় মিসিং ডায়েরি করেছিলেন। তাকে শেষ জীবিত অবস্থায় ২৬ অক্টোবর সকালে এক কুখ্যাত সমাজ বিরোধীর সঙ্গে দেখা গেছে। তার এই পুরুষ সঙ্গী কিছু দিন আগেই ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধে জেলে ছিল। কিছু লোক জানাল যে, তারা সেই বুধবার সকালে অ্যাপার্টমেন্টের কাছে তীক্ষ্ন মেয়েলি গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। কিন্তু জট পাকল অন্য জায়গায়। মৃতদেহ যে পাওয়া গেছে অনেক দূরে! সাসপেক্টের ঘরে বিছানার চাদরে মেয়েটির চুল এবং রক্ত পাওয়া গেল। আর কিছু পেলেন না তদন্তকারী দল। কিছু দূরে জঙ্গলের কাছে মেয়েটির এক জোড়া জুতো পাওয়া গেল। আততায়ীর গাড়ির কার্পেটে পড়ে থাকা রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলা হয়েছিল ভাল ভাবে। কিন্তু লেগেছিল মেয়েটির স্কার্টের সুতো। সমস্ত তথ্য বুঝিয়ে দিচ্ছিল খুনি কে। কেস বিনির্মাণ ও ধোপে টেকানোর জন্য কিন্তু কিন্তু ঠিক সময় ও স্থান বের করা অবশ্যই দরকার। ২-৮ দিনের ভিতর মৃতদেহের পচনের অবস্থার ওপর ভর করে নানা রকম আসতে লাগল পি এম আই। এই তথ্যের ওপর ভর করে কিছুতেই আঠারো দিন আগে যার সঙ্গে দেখা গেছে তাকে ধরা সম্ভব না। কোনও ম্যাগটই কালচার করে জীবিত অবস্থায় রাখা যায়নি, যদিও ছবিতে দেখা গিয়েছে অসংখ্য ম্যাগট। সাইজ আর প্রকৃতি সহ অটোপ্সি রিপোর্টে তার উল্লেখ আছে। সংগ্রহ করা হল আবহাওয়ার বিগত আঠারো দিনের সব তথ্য। যেমন, তাপমান, বৃষ্টি, হাওয়ার গতিবেগ, আদ্রতা ইত্যাদি। ক্রাইম সিনের ছবিতে দেখা গেল যে-দিন মৃতদেহ পাওয়া গেছে সে-দিন যে লার্ভা ছিল সবচেয়ে বড়, সে তার তৃতীয় ইন্সটারে প্রবেশ করেছে। সেটি একটি ক্যালিফোরা ভিসিনার লার্ভা (Calliphora vicina)। সেই সময়ের তাপমান বিশ্লেষণ করে এন্টামোলজিস্ট জানালেন, ডিম থেকে এই অবস্থায় আসতে ক্যালিফোরার কত দিন লাগতে পারে। যেহেতু সে-সময় পরিবেশের তাপমান ১০ ডিগ্রির কম ছিল, সেই জন্য ভীষণ কম সংখ্যক লার্ভা বেঁচে ছিল তাই দেহের ভিতর তাপমানও বাড়তে পারেনি বিশেষ। তাই যতটা পচন ধরা উচিত ছিল, ততটা ধরেনি। সব দেখে এন্টোমোলজিস্ট জানালেন, পি এম আই সাধারণের থেকে বেশি, মানে ২-৮ দিন নয়, ১৫ দিন হবে। তাও থেকে গেল তিন দিনের ফারাক। আততায়ীকে ধরা হল। জেরার মুখে জানা গেল, ১৮ দিন আগে, বুধবার সকালে সে-ই হত্যা করেছে তরুণীকে। কিন্তু সে গদি, গাছের পাতা ও বিভিন্ন জিনিস দিয়ে মৃতদেহ খুব ভাল ভাবে ঢেকে রেখেছিল। ঘটনাচক্রে তাই ব্লো ফ্লাই আসতে পারেনি। তিন দিন পর সে মৃতদেহ ফেলে দিয়ে আসে। পরে মৃতদেহটি দেখতে পাওয়া যায়। এ থেকে জানা গেল, খুনের দিন থেকে প্রায় তিন দিন অবধি যে সব জিনিস দিয়ে ঢাকা ছিল দেহটি, তাতে ক্যালিফোরা বাসা বাঁধতে পারেনি। তাই ১৫ দিন পি এম আই ঠিক ছিল।

তাপমান যখন শূন্য
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক জন শ্বেতাঙ্গের দেহ পাওয়া গেল ইন্ডিয়ানার এক সেতুর নীচ থেকে। দেহে বিশেষ পচন ধরেনি ও আঘাতের চিহ্ন নেই। সামান্য চামড়া খুলে আসছে হাত ও দেহের উপর অংশ থেকে। মুখের বাঁ দিকে খুলি দেখা যাচ্ছিল। ক্যালিফোরা ভমিট্রিয়া-র (Calliphora vomitoria) লার্ভা পাওয়া গেল মুখের উন্মুক্ত ক্ষত ও সাইনাস থেকে। এ থেকে মোটামুটি ধারণা করা গেল যে, দেহটি হাওয়ার স্পর্শে খুব বেশি দিন আসেনি। মৃত্যুর ঠিক সময় বের করার জন্য এ সময়কার তাপমান জানা খুব প্রয়োজন ছিল। অক্টোবর মাসে ইন্ডিয়ানায় তাপমান শূন্যের কাছাকাছি থাকে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে গড় তাপমাত্রার উপর থাকে। আবহাওয়ার তথ্য থেকে জানা গেল, মৃতদেহে যে ম্যাগটগুলির আকৃতি পাওয়া গেছে, এই তাপমাত্রায় আসতে কম করেও ৪৮ দিন লেগে যাবে। খোঁজ নিয়ে তদন্তকারী অফিসাররা জানতে পারলেন, মানসিক হাসপাতাল থেকে ৫৪ দিন আগে এক যুবক পালিয়ে গেছে। দেহটি তার শনাক্ত করা গেল। হাইপোথারমিয়ায় অক্টোবর মাসের রাতে তার মৃত্যু হয়েছে, এটি খুনের ঘটনা নয়।

মেঝের নীচে কবর
দক্ষিণ-পূর্ব আমেরিকায় নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি পুলিশ একটি এক কামরার ঘরের ভিতর খুঁড়ে রাখা নোংরা কবর থেকে পুরোপুরি পচন ধরে যাওয়া এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর দেহ খুঁজে পেল। পুরো পচন ধরে যাওয়ায় দেহের থেকে সাধারণত যেগুলি তথ্যগুলি পাওয়া যায়, সে ভাবে কোনও তথ্যই পাওয়া গেল না এ ক্ষেত্রে । মৃত্যুর কারণ, মাথায় একটি মাত্র বুলেটের ক্ষত। দেহের পুরো অটোপ্সি আর কবরের ওই জায়গার মাটির থেকে পাওয়া গেল ক্যালিফোরা ভিসিনা-র (Calliphora vicina) লার্ভা। আর সিন্থেসিয়োমিয়া-র পিউপা (Synthesiomyia nudiseta), সাধারণ মাছির লার্ভাও পাওয়া গেল। জীবিত ফ্লাই যেগুলি পাওয়া গেল আর লার্ভার কালচার এবং সমস্ত তথ্য থেকে এন্টোমোলজিস্ট জানালেন, মৃতদেহ পাওয়ার ২৮ দিন আগে মাছির কলোনির প্রথম আগমন ঘটেছে, মানে মৃত্যুর সময়ও সেটাই। এই তথ্যের উপর ভর করে শুধু খুনি ধরা পড়ল। এবং জানায়, দেহটি পাওয়ার ২৮ দিন আগে সে খুন করে বেসমেন্টে দেহটি পুঁতে রাখে। এই কেসের ক্ষেত্রে এন্টোমোলজিক্যাল সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া প্রায় আর কিছুই প্রমাণ ছিল না।

সন্ধে ৬টার আগে
এক জন হাঙ্গেরিয়ান ফেরি স্কিপারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল এক জন পোস্টমাস্টারকে খুনের অভিযোগে। পোস্টমাস্টারের মৃতদেহটি পাওয়া গেছিল সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায়, জাহাজের ওপর। ফেরি স্কিপার সে-দিন সন্ধ্যা ৬টায় কাজে যোগ দেন। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যে পাওয়া গেল দেহটি। স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহ তার দিকে। ওই সময় আর কেউ সেখানে ছিল না। পরের দিন বিকেল ৪টেতে পোস্ট মর্টেম করা হল ও রিপোর্টে লেখা ছিল যে, হলুদ রঙের ফ্লাইয়ের ডিম আর অসংখ্য সদ্য জন্মানো ১-২ মিমি লম্বা লার্ভা মৃতদেহে বাসা বেঁধে ছিল। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের দিকে নজরই দেওয়া হল না। শুধু মাত্র পারিপার্শ্বিক তথ্যের ভিত্তিতে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে গেল। ৮ বছর পর কেসটি পুনরায় খোলা হল। সেই সময় ডা. মিহালি দেখলেন, যে ধরনের ফ্লাই মৃতদেহে পাওয়া গেছে, সেটি সন্ধ্যা ৬টার পর সেপ্টেম্বরে হাঙ্গেরিতে সক্রিয় থাকে না। তার নিজের কিছু পরীক্ষা থেকে আরও দেখালেন যে, ২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমানে হলুদ ডিম (Lucilia caesar (L)) যেগুলি পাওয়া গেছে, সেগুলি ১৩ ঘণ্টার আগে ফোটে না। আরও যেগুলির ডিম পাওয়া গেছে (L. sericata (Meigen), Phormia terranovae Robineau-Desvoidy) সেগুলির কোনওটাই ১২-১৪ ঘণ্টার আগে ফোটা সম্ভব না। এই তথ্যগুলো যদি জোড়া লাগানো যায়, তা হলে বলা যায়, যে-দিন অটোপ্সি হয়েছে সে-দিন কোনও ভাবেই ডিম থেকে লার্ভা বেরনোর সময় পায়নি, এবং অবশ্যই ডিমগুলো পাড়া আগের দিন ৬টার আগে। ৬টার পর আর তাদের সক্রিয়তা থাকে না। আর ফেরি স্কিপার কাজেই এসেছেন ৬টার পর। তাই তিনি কোনও ভাবেই খুন করতে পারেন না। মিহালির ওভিপজিশন সংক্রান্ত তথ্য মিলিয়ে দেখা হল এবং ফেরি স্কিপার মুক্তি পেলেন।

মৃতদেহে মাছি বসেনি
ফরেনসিক এন্টোমোলজি এক শক্তিশালী হাতিয়ার। এ ব্যাপারে বার্নার্ড গ্রিনবার্গের (১৯৮৫) অবদান উল্লেখযোগ্য। একটি ঘটনার কথা গ্রিনবার্গ বলে গিয়েছিলেন যেখানে ফ্লাইয়ের না থাকাটাই প্রমাণ হিসেবে লেগেছিল।
যখন দেহটি প্রথম দেখা গেল, মৃতদেহের ঠিক পাশে একটা জানলা খোলা ছিল। খানিক তদন্তকারী দলকে ভুল বোঝানোর জন্যই যেন। যেন মনে হয় খুনি গত রাতে জানলা দিয়ে এসেছিল এবং খুন করে পালিয়ে গেছে জানলা দিয়ে। কিন্তু ওই ঘরটি বাতানুকূল এবং বাইরেটা গরম থাকা সত্ত্বেও তখনও যথেষ্ট ঠান্ডা ছিল। রাত থেকে জানলা খোলা থাকলে ঘরের তাপমান অনেক বেশি হত বা বাইরের সমান থাকত। এ ছাড়া রাতে খুন হয়ে দেহটি পড়ে থাকলে ফ্লাইয়ের কলোনি থাকার কথা। ঘটনা যেটা হয়েছিল, সেটা হল আততায়ী খুবই পরিচিত ছিল ও তার কাছে চাবি ছিল ঘরের। মৃতদেহ আবিষ্কারের মাত্র অল্প সময় আগে সে জানলাগুলো খুলে দিয়ে যায়। খুব অল্প সময় জানলা খোলা ছিল বলে ফ্লাই দেহের কাছে এলেও কোনও ফ্লাইয়ের কলোনি মৃতদেহে পাওয়া যায়নি। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আততায়ীকে ধরা অনেক সহজ হয়।
আসলে খুনি কোনও তথ্য বা ক্লু ছেড়ে না গেলেও মৃতদেহ ছেড়ে যেতেই হয়। আর সেখানেই এন্টোমোলজির সাফল্য। কিন্তু খুনের প্রথম এক মাসেই এই সাফল্য বেশি আসে। খুন হওয়ার ঠিক পরের মুহূর্তে আসা শুরু করে বিভিন্ন ফ্লাই। একেবারে ঠিক সময় না বলতে পারলেও খুব কাছাকাছি সময় বলে দেওয়া সম্ভব লার্ভার আকৃতি দেখে।
আর একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা আমরা পাই, সেটা খুনের স্থান বা দেহ স্থানান্তরিত করা হয়েছে কি না। অনেক সময়ই সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করার জন্য আততায়ী তা করে থাকে। কিন্তু যেখানে খুন করা হয়েছে বেশির ভাগ সময়ই সেখানকার চরিত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে কিছু না কিছু ফ্লাই থেকে যায়, যা থেকে এক জন বিশেষজ্ঞ ঠিক খুন হওয়ার স্থান বলে দিতে পারেন। ফ্লাইয়ের চরিত্র সেখানকার উচ্চতা, তাপমাত্রা, আবহাওয়ার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে।
এমনকী খুন ঘরের ভিতরে না বাইরে খোলা জায়গায় হয়েছে, তাও বলা সম্ভব। বিশেষত যেখানে মৃতদেহে পচন ধরে গেছে এন্টোমোলজিস্ট মৃত্যুর কারণ নিয়েও কিছুটা সাহায্য করে থাকেন।
প্রকৃতি সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে যায় এ ভাবেই।

ছবি: সুমন চৌধুরী
কৃতজ্ঞতা: সুচিতা সিন্হা, বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব বটানি, লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ

First Page Rabibasariyo Golpo



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.