|
|
|
|
ফুটপাথে শিবির |
কর্মীদের চেয়ারে মন্ত্রী, নথিভুক্ত হাজার শ্রমিক |
প্রসূন আচার্য ²কলকাতা |
শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টা। উল্টোডাঙার মোড়ে ফুটপাথে রীতিমতো রঙিন ছাতা খাটিয়ে বসেছেন রাজ্য শ্রম দফতরের অফিসাররা। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, ‘গৃহনির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। আসুন। আপনারা নাম নথিভুক্ত করুন’।
সবে মাত্র কলকাতা জাগছে। দু’একজন করে উৎসাহী ভিড় করছেন। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘ব্যাপারটা কী?” কেউ জিজ্ঞাসা করছেন, “কী পাব? মাসে কত টাকা
দিতে হবে?”
শ্রম দফতরের কর্মীরা বোঝাচ্ছেন, “প্রতি মাসে ২০ টাকা দিয়ে নাম নথিভুক্ত করলে পেনশন, দুর্ঘটনাভাতা, চিকিৎসাভাতা, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য টাকা, সাইকেল কেনা এমনকী, চশমা কেনার জন্যও টাকা পাওয়া যাবে। মহিলা নির্মাণকর্মীরা পাবেন ৩ হাজার টাকা মাতৃত্বকালীন সহায়তা।”
শুনে পালপাড়ার নিখিল দাস, ক্ষুদিরামপুরের কবিতা দাসরা অবাক, “বাব্বা এত কিছু! সত্যিই পাব তো?” নিখিল-কবিতারা উল্টোডাঙার আশপাশেই থাকেন। রাজমিস্ত্রি ও জোগাড়ের কাজ করেন। কোড নম্বর দিয়ে তাঁদের হাতে ফর্ম তুলে দিলেন অফিসাররা। তারপরে বললেন, “তিন কপি ছবি আর ২০ টাকা নিয়ে এ মাসের ২১ তারিখ আসবেন। খাতা খুলে দেওয়া হবে।”
শপথ নেওয়ার ১৫ দিনের মাথায় নির্মাণশ্রমিকদের ‘সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প’ সফল করতে আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় নামল নতুন সরকার। শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু এলেন ৭ টা বাজার আগেই। তাঁকে টেবিল ছেড়ে দিতে তৎপর হলেন সরকারি কর্মীরা। তাঁদের নিরস্ত করে পূর্ণেন্দুবাবু কিছুক্ষণ রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রইলেন। |
 |
ঠিকা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলছেন শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু (বাঁ দিকে)। শুক্রবার অর্কপ্রভ ঘোষের তোলা ছবি। |
একের পর এক লোকাল ট্রেন এসে থামছে উল্টোডাঙা স্টেশনে। ভিড় বাড়ছে গ্রাম ও শহরতলি থেকে আসা নির্মাণশ্রমিকদেরও। প্রতিদিনই তাঁরা কাজের সন্ধানে উল্টোডাঙায় জড়ো হন। ক্রমশ তাঁদের মধ্যে বার্তা রটে গেল, সরকারি খাতায় নাম তুললে সুযোগসুবিধা পাওয়া যাবে। টেবিলের সামনে ভিড় বাড়তে লাগল। শ্রমিকদের বলা হল লাইনে দাঁড়াতে।
তখনও দাঁড়িয়েই ছিলেন মন্ত্রী। সরকারি কর্মীদের অনুরোধে বাধ্য হয়ে তাঁদের চেয়ার-টেবিলেই বসলেন। মন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হল একটি ছোট পুস্পস্তবকও। ঘোষকের হাত থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে মন্ত্রী বললেন, “আমরা ঠিক করেছি, রাজ্যের প্রত্যেক নির্মাণকর্মী যাতে এই সুযোগসুবিধা পান, তার জন্য নিয়মিত এমন শিবির করা হবে। শুধু কলকাতাতেই নয়, শিবির হবে জেলাতেও। প্রয়োজনে এ জন্য কর্মীও নিয়োগ করা হবে।”
শ্রমিকদের ফর্ম বিলি করছিলেন শ্রম দফতরের অফিসার সুমিতা মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “আমরা আগেও শিবির করেছি। সেক্ষেত্রে কোনও ইউনিয়ন ডেকেছে। গিয়েছি। তবে, এ ভাবে সাত সকালে রাস্তায় বসে কখনও শিবির করিনি। এমন উৎসাহও কখনও দেখিনি!” বারাসতের হরিলাল মণ্ডল, আমডাঙার আখতার আলি, বসিরহাটের যমুনা বিশ্বাসরা বহু বছর রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন। ফর্ম নিয়ে তাঁরা জানালেন, এতদিন কেউ তাঁদের এই সব সুযোগসুবিধার কথা বলেনি। সরকারি কর্মীরা তাঁদের পরামর্শ দিচ্ছিলেন, ফর্ম নিয়ে সকলে যেন বাড়ির কাছে ব্যাঙ্ক বা শ্রম দফতরের অফিসে নাম নথিভুক্ত করেন। তা হলে
যেখানেই তাঁরা কাজ করুন, কোনও অসুবিধা হবে না। পরে টাকা জমা দিলেও খাতা চালু থাকবে।
ষষ্ঠ বামফ্রন্টের আমলে, ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু হয়। শ্রম দফতরের আওতাধীন ‘ওয়েস্টবেঙ্গল বিল্ডিং অ্যান্ড আদার্স কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কাস ওয়েলফেয়ার বোর্ড’ শ্রমিকদের এই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প দেখে। বোর্ডের সদস্য পতিতপাবন দাসের কথায়, “নির্মাণশিল্পের মোট খরচের ১% সরকারকে সেস দিতে হয়। সেই টাকাতেই এই প্রকল্প চলে। এ পর্যন্ত রাজ্যে প্রায় ২ লক্ষ ৭৪ হাজার নির্মাণ শ্রমিক এই প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করেছেন। সরকারের ঘরে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত জমা ছিল ২১৮ কোটি টাকা। বা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৫ কোটি। সুতরাং টাকার কোনও অসুবিধা নেই।”
কত শতাংশ শ্রমিক নিয়মিত টাকা জমা করছেন? পতিতবাবুর জবাব, “৫৫% থেকে ৬০%।” তিনি জানান, রাজ্যের আনুমানিক নির্মাণ শ্রমিক রয়েছে ১০ লক্ষ। নতুন সরকারের লক্ষ্য তাঁদের সকলকে দ্রুত প্রকল্পের আওতায় আনা। কিন্তু বামজমানার সাড়ে ৫ বছরে কেন মাত্র ২৫% শ্রমিক প্রকল্পের আওতাভুক্ত হলেন? প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রীদের উদ্যোগের অভাব ছিল? নাকি তাঁরা সে ভাবে কাজে নামেননি? জবাবে হাসলেন পতিতবাবু।
শিবিরে ভিড় বাড়ে। চলে আসেন আইএনটিটিইউসি-র নেত্রী দোলা সেনও। ভিড় করেন স্থানীয় কয়েক জন আইএনটিটিইউসি নেতা-কর্মী। দোলা কিন্তু শিবিরের সামনে এলেন না। তাঁর কথায়, ‘সরকারি অনুষ্ঠান। তা সরকারি কর্মীরাই করুন। আমরা পিছন থেকে সাহায্য করব।” শ্রমিকদের উৎসাহ দেখে পূর্ণেন্দুবাবুর ঘোষণা, “পরদিন শুধু নির্মাণ শ্রমিক নয়, পরিবহন শ্রমিক ও অন্য অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্যও শিবির হবে।” ততক্ষণে শ্রম দফতরের অফিসাররা বলতে শুরু করেছেন, আগামী মঙ্গলবার শিবির হবে বেহালার জোকায়। তবে কাজের এই গতি থাকলে এই প্রকল্প সফল হতে বাধ্য!
ঘণ্টাদুয়েক পর চলে গেলেন মন্ত্রী। শিবির তারপরেও চলল প্রায় পৌনে ১০টা পর্যন্ত। ফর্ম নিলেন প্রায় এক হাজার শ্রমিক। |
|
|
 |
|
|