|
|
|
|
দশ দিনে বন্ধ শতাধিক বেআইনি কাঠকল |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
রাজ্যে পালাবদলের পরে বেআইনি অস্ত্র-উদ্ধারের যেমন হিড়িক পড়েছে, তেমনই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা জুড়ে প্রচুর সংখ্যক বেআইনি কাঠকলেরও হদিস মিলতে শুরু করেছে। এত দিন অবাধেই কাঠকলগুলি চলেছে। রমরম করে চলেছে চোরাই কাঠের কারবার। স্থানীয় মানুষের যেমন তা অজানা ছিল না, তেমনই বন-দফতরেরও অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। তবু, বেআইনি কারবার চলছিল অবাধেই। অভিযোগ, সিপিএম নেতাদের মদতেই দীর্ঘ দিন ধরে চলেছে কাঠের চোরা-কারবার। অনেক দাপুটে সিপিএম নেতা বেনামে চালিয়েছেন কাঠকল। আর সে কারণেই বন-দফতরও সব দেখেও না-দেখার ভান করেছে। শাসক পরিবর্তন হতেই নড়েচড়ে বসেছে দফতর। আর তাতেই বনজ-সম্পদ লুঠের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কাঠ নিয়ে বড়সড় এক কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এসে পড়েছে।
বন-দফতরের সাম্প্রতিক অভিযানে গত দশ দিনে একশোরও বেশি অবৈধ কাঠকল (স-মিল) চিহ্নিত হয়েছে জেলায়। পরে সেগুলি ‘সিল’ও করে দেওয়া হয়েছে। বন-দফতরের দাবি, সংশ্লিষ্ট মিলে গিয়ে কারও হদিস পাননি বনকর্মীরা। খোঁজ করেও মালিকদের সন্ধান মেলেনি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না-পেয়েই একশোরও বেশি মিল ‘সিল’ করে দেওয়া হয়েছে। দফতর সূত্রের আরও ইঙ্গিত, জঙ্গলমহলে অশান্তির সুযোগ নিয়ে গত দু’বছরে চোরাই কাঠের ব্যবসা আগের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় ফুলেফেঁপে উঠেছিল। |
|
গড়বেতার একটি কাঠকলে অভিযান। নিজস্ব চিত্র। |
এত দিন ধরে অবৈধ কারবার চললেও বন দফতর কী করছিলসেই স্বাভাবিক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অবশ্য বন-দফতরের কর্তাদের খানিকটা অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছেই। দফতরের এক আধিকারিকের সাফাই, “আগেও বেশ কয়েকটি স-মিলের মালিককে সতর্ক করা হয়েছিল। ওঁরা বলেছিলেন, মিল বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু তা হয়নি।” পাশাপাশি তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, “স্বাধীন ভাবে কাজ করতে না-পারলে অনেক কিছুই সম্ভব হয় না। সেই স্বাধীনতা পাওয়া গিয়েছে বলেই দশ দিনের অভিযানে দশ বছরের কাজ হয়েছে।” বন দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যে পালাবদলের পরেই অবৈধ কাঠ উদ্ধারের তৎপরতা শুরু হয়। প্রয়োজনীয় নির্দেশ আসে উপরমহল থেকেই। আগে কাঠ উদ্ধার করতে গেলে নানা বাধার মুখে পড়তে হত বন-কর্মীদের। কোনও কোনও মহল থেকে চাপ আসত। কিন্তু গত দশ দিনে এমন ঘটনা ঘটেনি। অবৈধ কাঠ উদ্ধারে বরং সহযোগিতাই মিলেছে।
২৩ মে থেকে জেলা জুড়ে বিশেষ অভিযানে নামেন বন-কর্মীরা। অবৈধ কাঠকল বা স-মিলের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতেই তল্লাশি শুরু হয়। এই অভিযানে শুধু মেদিনীপুর বন-বিভাগের অন্তর্গত এলাকাতেই ৪৬টি অবৈধ স-মিলের খোঁজ মিলেছে। সেগুলি ‘সিল’ও করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে চন্দ্রকোনা রোডে রয়েছে ৩০টি স-মিল, আড়াবাড়িতে ৬টি, নয়াবসতে একটি, মেদিনীপুরে ৭টি, ভাদুতলায় একটি, গোদাপিয়াশালে একটি। সেই সঙ্গে উদ্ধার হয়েছে প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা মূল্যের ‘চোরাই’ কাঠ। প্রায় একই ছবি খড়্গপুর বন-বিভাগের অন্তর্গত এলাকাতেও। এখানে সব মিলিয়ে ৪২টি স-মিল ‘সিল’ করা হয়েছে। নয়াগ্রামে ২৭টি, বেলদায় ১১টি এবং কলাইকুণ্ডায় ৪টি। রূপনারায়ণ বন-বিভাগ সব মিলিয়ে ১৭টি মিল ‘সিল’ করেছে। এর মধ্যে গড়বেতায় রয়েছে ৪টি, আমলাগোড়ায় ৬টি, গোয়ালতোড়ে ৩টি, মহালিসাইতে ৩টি, হুমগড়ে একটি। উদ্ধার হয়েছে প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা মূল্যের ‘চোরাই’ কাঠ। মে মাস জুড়ে অভিযান চালিয়ে ঝাড়গ্রাম বন-বিভাগও ১১টি অবৈধ মিল ‘সিল’ করেছে।
এত অবৈধ স-মিলের উপস্থিতি কাঠ পাচারের উদ্বেগজনক ছবিটাই স্পষ্ট করে দিচ্ছে বলে স্বীকার করছেন বন-দফতরের পদস্থ কর্তারা। তবে তাঁদের বক্তব্য, এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। গ্রামবাসীরাই এগিয়ে এসে কাঠ পাচার রুখছেন। বন-সুরক্ষা কমিটির সদস্যরাও নজরদারি বাড়িয়েছেন। মেদিনীপুরের ডিএফও আশিস সামন্তের বক্তব্য, “অবৈধ কাঠের খোঁজে অভিযান চলবে। আগেও বেশ কয়েকটি মিল মালিককে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু কেউই কথা শোনেননি। এখন নির্দিষ্ট খবর এলেই বন-কর্মীরা সেখানে হানা দিচ্ছেন।” রূপনারায়ণ বিভাগের ডিএফও রবীন্দ্রনাথ সাহাও বলেন, “কাঠ পাচার রুখতে আগেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হয়েছে। এখন নজরদারি আরও বেড়েছে।” জানা গিয়েছে, এখন প্রতিদিনই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ডিএফও-দের রিপোর্ট পাঠাতে হচ্ছে। কোন এলাকা থেকে কত কাঠ উদ্ধার হচ্ছে, তার সবিস্তার উল্লেখ থাকছে সেই রিপোর্টে। |
|
|
|
|
|