রাজ্যে বার্ড ফ্লু’র অন্যতম আঁতুড়ঘর বলা হয় মাড়গ্রামকে। ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি মাড়গ্রামেই প্রথম দেখা গিয়েছিল বার্ড ফ্লু। জেলার ১৯টি ব্লকের মধ্যে ১৭টি ব্লককে বার্ড ফ্লু কবলিত বলে ঘোষণা করে প্রশাসন। ২০০৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বীরভূম জেলায় চলে ‘কালিং’। বার্ড ফ্লু আক্রান্ত হিসেবে নিধন করা হয় প্রায় ১২ লক্ষ পাখিকে। বহুসংখ্যক সরকারি কর্মীকে এই কাজে যোগ দিতে হওয়ায় জেলায় বাধাপ্রাপ্ত হয় বিভিন্ন দফতরের যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজ। পরবর্তীকালে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রশাসন বীরভূম জেলাকে বার্ড ফ্লু মুক্ত বলে ঘোষণা করে।
২০০৮ থেকে ২০১১ এই তিন বছরের ব্যবধানে মাড়গ্রামেরই বাসিন্দা নুরে আলম চৌধুরী রাজ্যের প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রীর নিজের বিধানসভা কেন্দ্র মুরারইতেই কর্মী সমস্যায় ভুগছে প্রাণী সম্পদ দফতর।
মুরারই ১ ও ২ ব্লকে প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের মোট কার্যালয় আছে ১৬টি। মুরারই ১ ব্লকে রয়েছে ৭টি এবং ২ ব্লকে রয়েছে ৯টি কার্যালয়। তার মধ্যে মুরারই ১ ব্লকের চাতরা পঞ্চায়েতে এবং মুরারই ২ ব্লকের রুদ্রনগর ও পাইকর ১ পঞ্চায়েতে প্রাণী সহায়ক নিযুক্ত আছেন। ফলে মুরারই ১ ব্লকের বাকি ছ’টি এবং এবং মুরারই ২ ব্লকের বাকি ৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত ভবনে প্রাণী সম্পদ দফতর কর্মীর অভাবে তালাবন্ধ থাকে। জেলার ১৬৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৬৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতেই এ রকম অবস্থা। বেশিরভাগ পঞ্চায়েতই রামপুরহাট মহকুমার অন্তর্গত।
জেলা প্রাণীসম্পদ বিকাশ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার ১৯টি ব্লকের মধ্যে সিউড়ি ১ ও ২ ব্লক, মহম্মদবাজার, রাজনগর, দুবরাজপুর, সাঁইথিয়া বোলপুর-সহ মোট ৮টি ব্লকে ফিল্ড সুপার ভাইজার নিযুক্ত রয়েছেন। বাকি ১১টি ব্লকে ফিল্ড সুপারভাইজারের পদ খালি। এ ক্ষেত্রেও রামপুরহাট মহকুমার অবস্থা খুবই খারাপ। প্রাণী সম্পদ দফতরের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, রামপুরহাট মহকুমা যেহেতু জেলা সদর সিউড়ি থেকে একটু দূরে এবং এখানে গ্রামাঞ্চল বেশি, তাই এই মহকুমায় লোক নিয়োগ হলেও কেউ আসতে চান না। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে যে সমস্ত প্রাণী সহায়করা কাজ করেন তাদেরই প্রোমোশান দিয়ে ফিল্ড সুপারভাইজার পদে নিয়োগ করার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই এই সমস্ত পদ খালি। তাই দফতরের কাজ চালানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক অসুবিধা হচ্ছে।
প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের ব্লক স্তরে যে সব অফিস রয়েছে, সেগুলির একটিতেও নেই কেরাণি। তাই দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিককেই সামলাতে হয় সমস্ত কাজ। স্বাভাবিকভাবেই ব্যাহত হয় অন্যান্য কাজকর্ম। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলায় যে সমস্ত পঞ্চায়েতে প্রাণী সহায়ক নেই সেখানে কোনও টিকাকরণ শিবিরও করা সম্ভব নয়। তাছাড়া, পালিত প্রাণীদের প্রাথমিক চিকিৎসা পেতেও বঞ্চিত হন তাদের মালিকেরা।
প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের বীরভূম জেলা সহ অধিকর্তা নারায়ণ দাস ভৌমিক বলেন, “জেলাতে দীর্ঘদিন যাবত প্রাণী সহায়ক পদ এবং ফিল্ড সুপারভাইজার পদে লোক নিয়োগ হয় নি। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি।” তাঁর কথায়, “বার্ড ফ্লুর সময় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাণী সম্পদ বিকাশের কর্মীদের নিয়ে এসে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছিল। তবে বর্তমানে কর্মীসমস্যায় দফতরের কাজ চালানো সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছে।” তিনি জানান, জেলার প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্বলিত বিস্তারিত রিপোর্ট সম্প্রতি জেলারই বাসিন্দা মন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
ওই রিপোর্টে পূর্ববর্তী বিভিন্ন প্রকল্পের সাফল্যের খতিয়ান ছাড়াও টিকার অপ্রতুলতা, সিউড়ি ও কোটাপুরে দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কারখানা বন্ধ থাকা-সহ বিভিন্ন সমস্যার কথাও উল্লেখ রয়েছে বলে জানান নারায়ণবাবু।
রাজ্যের প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের মন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরী সম্প্রতি নিজের মাড়গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। এলাকা ঘুরে তিনি বাসিন্দাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, “জেলাতে দফতরের কী পরিস্থিতি তা আমি অবশ্যই খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়াও দফতরে একটি টেলিফোন সহায়তা কেন্দ্র খোলা হবে। এতে প্রাণী-পালকরা যে কোনও সময় বিনামূল্যে তাঁদের যাবতীয় অসুবিধার কথা জানাতে পারবেন। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন প্রাণী বন্ধু, প্রাণী সহায়তা, বা প্রাণী সম্পদ বিভাগের কর্মীরা।” জেলার দু’টি দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কারখানা খোলার ব্যাপারেও তিনি উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন। তবে সর্বোপরি, দ্রুত সমস্যা মিটিয়ে দফতরে কর্মসংস্কৃতি ফেরানোটাই প্রাথমিক লক্ষ্য বলে জানান মন্ত্রী। সমস্যা সমাধানে তাই ‘ঘরের ছেলে’র মুখ চেয়ে রয়েছেন জেলার বাসিন্দারা। |