থাকবেন রাজ্য কমিটিতে

অবস্থা সামলাতে কারাট আসছেন রাজ্যে

হারের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রকাশ্যে অবতীর্ণ হওয়ার পরে বঙ্গ-সফরে আসছেন প্রকাশ কারাট। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী বিপর্যয় নিয়ে আলোচনা করতে আগামী ৪ ও ৫ জুন আলিমুদ্দিনে রাজ্য কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, রাজ্য কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে সচরাচর কারাটের সঙ্গে উপস্থিত থাকেন পলিটব্যুরোর আরও দুই সদস্য এস আর পিল্লাই এবং সীতারাম ইয়েচুরি। এ বার এখনও পর্যন্ত যা ঠিক আছে, তাতে কারাট আসছেন একাকী। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা হারানোর পরে এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু সেই বিপর্যয়ের ‘নৈতিক দায়’ নিয়ে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরে দাঁড়াতে চাওয়ার পরে এই প্রথম বুদ্ধ-কারাট মুখোমুখি সাক্ষাৎ ঘটার কথা।
পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলে দল ক্ষমতা হারানোর পরে সিপিএমের একটা বড় অংশ যখন তাঁকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরাতে চাইছে, সেই সময় কারাটের নিজেই আলিমুদ্দিনের বৈঠকে হাজির থাকার সিদ্ধান্ত যথেষ্ট ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে ধরা হচ্ছে সিপিএমের অন্দরমহলে। এ কে জি ভবন সূত্রের বক্তব্য, ভোটে হারের পরে রাজ্য নেতৃত্ব থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকে, নির্দিষ্ট করে বললে, খোদ কারাটের দিকে যে অভিযোগের আঙুল উঠেছে, সেই ক্ষোভ প্রশমিত করতেই তাঁর এই বঙ্গ-যাত্রা। আলিমুদ্দিনের সঙ্গে এ কে জি ভবনের যে ‘আপাত দূরত্ব’ তৈরি হয়েছে, তা মেটাতে এই যাত্রায় কারাট সেতুবন্ধনের চেষ্টাও করবেন। এক দিকে তিনি যেমন তাঁর দিকে ধেয়ে আসা যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিতে পারবেন, তেমনই হারের কারণ হিসেবে জেলা থেকে কী রিপোর্ট আসছে, তা-ও তিনি সরাসরি শুনবেন। ফলে, পশ্চিমবঙ্গে দলের সাংগঠনিক ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে পারবেন সাধারণ সম্পাদক।
একই সঙ্গে হায়দরাবাদে ১০ থেকে ১২ জুন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের আগাম প্রস্তুতিও সেরে রাখতে চাইছেন কারাট। লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবি থেকে শুরু করে বিধানসভা ভোটে হারের জন্য রাজ্য নেতৃত্বের একটি বড় অংশ এখনও পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে ইউপিএ সরকারের উপর থেকে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারকেই প্রধান কারণ বলে মনে করেন। তাঁদের হিসাবে, ওই সমর্থন প্রত্যাহারের ফলেই কংগ্রেস ও তৃণমূল জোট, বিরোধী ভোট একত্র হওয়া এবং বামেদের হার। পাশাপাশি, এক দিকে বুদ্ধবাবু যখন হারের দায় নিয়ে পলিটব্যুরো থেকে সরে দাঁড়াতে চাইছেন, সেখানে দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েও কারাট নিজের ‘ভুল’ মানতে চাননি বা ইস্তফা দিতে রাজি হননি। এতেও দলের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কারাট চাইছেন, তাঁর বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকে আঙুল উঠলে আলিমুদ্দিনে বসেই প্রয়োজনে তার জবাব দিতে। যাতে হায়দরাবাদে ‘অস্বস্তিকর’ কোনও পরিস্থিতি এড়ানো যায়।
বুদ্ধবাবু যাতে দলের শীর্ষ স্থানীয় কমিটি থেকে সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা ত্যাগ করে হায়দরাবাদে যান, তার জন্য ইতিমধ্যেই কলকাতায় ‘দৌত্য’ সেরে গিয়েছেন পলিটব্যুরোর এক সদস্য। এ বার কারাটও কলকাতায় এলে বুদ্ধবাবুর মুখোমুখি হবেন। সিপিএম সূত্রের খবর, ‘দৌত্যে’র ফলে প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত হায়দরাবাদ যেতে পারেন বুদ্ধবাবু। পলিটব্যুরোর অন্দরে এই মুহূর্তে এস আর পিল্লাই, পিনারাই বিজয়ন, এম কে পান্ধের মতো কিছু সদস্যকে বাদ দিলে যে কোনও পরিস্থিতিতে কারাটের পাশেই থাকবেন, এমন নেতার সংখ্যা খুব বেশি নয়। এমতাবস্থায় কারাটের বঙ্গ-সফরের পরে হায়দরাবাদে গিয়ে বুদ্ধবাবু কী অবস্থান নেন, সেই দিকে নজর রয়েছে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। বিধানসভা ভোটের পরে রাজ্যে না-এলেও বিমান বসু, নিরুপম সেনদের সঙ্গে অবশ্য দফায় দফায় আলোচনা করেছেন কারাট।
কারাট-শিবিরের মতে, সাধারণ সম্পাদক নিজের গদি আঁকড়ে থাকতে চাইছেন বলে দলের মধ্যে যে ‘ভুল বার্তা’ যাচ্ছে, তার অবসান দরকার। কারাট নিজে যেমন সবই তাঁর একার দায় বলে মনে করেন না, তেমনই হারের জন্য বুদ্ধবাবুকে পলিটব্যুরো থেকে সরে দাঁড়াতে হবে, এমন কোনও কথাও তিনি বলছেন না। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের রণনীতি তৈরিতে কারাটের বিশেষ ভূমিকা ছিল না। একই সঙ্গে বিধানসভা ভোটে হারের জন্যও কেন্দ্রে সমর্থন প্রত্যাহারই প্রধান কারণ, এই বিতর্কেরও অবসান প্রয়োজন। তাই হারের কারণ খুঁজতে যখন রাজ্য কমিটি বসবে, তখনই সেখানে উপস্থিত থাকতে চাইছেন কারাট। সমর্থন প্রত্যাহারের ‘রাজনৈতিক কৌশলগত লাইনে’ ভুলের অভিযোগ উঠলে কারাটের যুক্তি হবে, তার জন্য পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্যই সমান ভাবে দায়ী।
দলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, “১৯৬৭ সালে সিপিএমের নির্বাচনে লড়া শুরু করার পর থেকে এত গভীর সঙ্কট আগে হয়নি। গত বছরই সাধারণ সম্পাদক এক ব্রিটিশ ঐতিহাসিককে বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলে খারাপ ফল হবে বলে তাঁর আশঙ্কা। দুই রাজ্যে ভোটের আগেই তিনি চেষ্টা শুরু করলেন, যাতে সাধারণ সম্পাদকের কার্যকালের মেয়াদ বেঁধে দেওয়া যায়। তার মানে বিপর্যয়ের দায় সাধারণ সম্পাদক নিচ্ছেন, এই বার্তা কোনও ভাবেই তিনি দিতে চান না!”
এ কে জি ভবন সূত্রে বলা হচ্ছে, কারাটের উপরে পশ্চিমবঙ্গে দলের মধ্যে ক্ষোভ আছে, এ কথা সত্যি। কিন্তু ভোটগণনার ঠিক আগের দিন রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু কেন ‘১৯৯ আসনে জিতব’ ঘোষণা করতে গেলেন, তা নিয়েও অনেকের আপত্তি রয়েছে। কারাট-শিবিরের নেতারা বলছেন, ভোটে হার তো পরের কথা, সেই হারের বিন্দুমাত্র আঁচও কেন আগাম পাওয়া গেল না, আগে বিমানবাবুদের সেই ব্যাখ্যা দিতে হবে।
সাধারণ মানুষের থেকে এই ভাবে ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়ার জন্য রাজ্য নেতৃত্ব কারাটকে বা কেন্দ্রে সমর্থন প্রত্যাহারকে দায়ী করতে পারেন না। একই ভাবে মুখ্যমন্ত্রী-সহ বামফ্রন্ট সরকারের প্রায় বহু মন্ত্রী যে নিজেদের বিধানসভা আসনও ধরে রাখতে পারেননি, তার জন্যও কারাটকে দায়ী করা সম্ভব নয়।

এই বিপর্যয়ের মুহূর্তে তিনি যে রাজ্য নেতৃত্বের ‘পাশে’ আছেন এবং সঙ্কটের সময়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে না-জড়িয়ে সম্মিলিত ভাবে লড়াই করাই যে যুক্তিযুক্ত আলিমুদ্দিনে এসে এই ‘কৌশলী বার্তা’ দেওয়াও কারাটের উদ্দেশ্য।
Previous Story Rajya Next Story




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.