সদস্যপদেই ‘ত্রুটি’

বাম গণ-সংগঠনের কর্মীরা ভোট দিয়েছেন তৃণমূলে

দু’বছর আগে লোকসভা-বিপর্যয়ের পরেও তাঁরা বামেদের ছেড়ে যাননি। গত বছর পুরভোটে দ্বিতীয় বার বাম-বিপর্যয়ের পরেও সদস্যপদ নবীকরণ করেছেন। নিয়মিত চাঁদা দিয়েছেন। গিয়েছেন মিছিলে। কিন্তু খাতায় কলমে ‘বামপন্থী’ থাকলেও তাঁদের মন যে ঘুরে গিয়েছিল তৃণমূলের দিকে, বিধানসভা ভোটে হারের পর বামনেতারা তা বুঝতে পারছেন।
অথচ গণ-সংগঠনের ওই লক্ষ লক্ষ সদস্যের উপর নির্ভর করেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-বিমান বসুরা বার বার প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হবে! পরিসংখ্যান বলছে, কেবলমাত্র গণ-সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা বামফ্রন্টকে ভোট দিলেও তারা জিতে যেত! পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাম নেতারা এখন বলছেন, যে পদ্ধতিতে গণ-সংগঠনের সদস্যপদ দেওয়া হয়, সেটাই ‘ত্রুটিপূর্ণ’।
সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা ভোটে বামেরা ভোট পেয়েছে ১ কোটি ৯৫ লক্ষ। আর কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ভোট পেয়েছে ২ কোটি ৩১ লক্ষ। কিন্তু শুধু তাদের গণ-সংগঠনের সদস্যরাই বামেদের ভোট দিলে কম করে তিন কোটি ভোট পেত বামেরা! সদস্যসংখ্যার হিসাব তা-ই বলছে। খাতায় কলমে যাঁরা বিভিন্ন বামপন্থী গণ-সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, ছ’মাস আগেও যাঁরা চাঁদা দিয়ে সদস্যপদ নবীকরণ করেছেন, তাঁরা কেন বামেদের ভোট দিলেন না? সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকে যেমন এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, তেমনই আলোচনা হবে শরিক সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপির রাজ্য কমিটির বৈঠকেও।
রাজ্যে সবচেয়ে বড় গণ-সংগঠন সিপিএমের কৃষক সভা। তাদের সদস্য সংখ্যা দেড় কোটি। তার পরে বড় সংগঠন সিপিএমের ডিওয়াইএফের। সদস্য সংখ্যা ৮৫ লক্ষ। সিপিএমের মহিলা সমিতির সদস্য ৬০ লক্ষ। সিটুর ১৭ লক্ষ। এসএফআইয়ের সদস্য ১৩ লক্ষ। প্রতিটি শরিকদলেরও শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র সংগঠন আছে। ফরওয়ার্ড ব্লকের অগ্রগামী কিষাণ সভার সদস্য ১০ লক্ষ। আরএসপি-র শ্রমিক সংগঠন ইউটিইউসি-র সদস্য সাড়ে ৫ লক্ষ। সিপিআইয়ের শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি-র সদস্য সাড়ে ৩ লক্ষ। এ ছাড়া রয়েছে সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন, শিক্ষকদের সংগঠন ইত্যাদি। সব মিলিয়ে আরও ১৫-২০ লক্ষ মানুষ বামপন্থী গণ সংগঠনগুলির সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তাঁদের অনেকেই যে বামেদের ভোট দেননি, তা ভোটের ফলাফলেই বামেদের কাছে স্পষ্ট।
কৃষক সভার রাজ্য সম্পাদক তরুণ রায়ের স্বীকারোক্তি, “গরিব খেতমজুর, কৃষক এবং আদিবাসীদের একাংশ যে এ ভাবে আমাদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছেন, আমরা তা বুঝতে পারিনি। ডিসেম্বরে সংগঠনের সদস্যপদ নবীকরণ করেও তাঁরা ভোট দিয়েছেন আমাদের বিরুদ্ধে।” কেন এমন হল, তার ব্যাখ্যায় তরুণবাবু জবাব, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, আমাদের রাজনীতি তাঁরা গ্রহণ করেননি। বিরোধীদের কথায় বেশি ভরসা রেখেছেন।” লোকসভা ভোটেই বোঝা গিয়েছিল, ‘ভয়ে-ভক্তি’তে গ্রামের মানুষের একাংশ শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে থাকলেও তাঁরা বামেদের পরিত্যাগ করেছিলেন। ডিওয়াইএফআই-এর রাজ্য সভাপতি প্রতিম ঘোষের কথায়, “যুবদের বড় অংশ লোকসভাতেও আমাদের ভোট দেয়নি। এ বারও দেয়নি।
আসলে আমাদের রাজনীতি তারা গ্রহণ করেনি।”
সেই সূত্রেই প্রতিমবাবু কার্যত স্বীকার করেছেন, সদস্যপদ সংগ্রহের মধ্যেই ‘ত্রুটি’ আছে। তিনি বলেন, “আমাদের কিছু দাবি ও নীতি আছে। যিনি সেগুলো মানেন, তিনিই এক টাকা দিয়ে সংগঠনের সদস্য হতে পারেন। এ ভাবেই বহু মানুষ সদস্য হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা ভোট দেননি।” সিপিএমের মহিলা সমিতির নেত্রী তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামলী গুপ্তও বলেন, “যাঁরা মহিলা সমিতি করেন, তাঁরা যে সকলে বামেদের ভোট দেননি, তা তো স্পষ্ট! ভোট দিলে এই ফল হয় না। কোথাও একটা বড় ধরনের ত্রুটি হয়েছে। তা সংশোধন করাই এখন বড় কাজ।”
আরএসপি-র শ্রমিক সংগঠন ইউটিইউসি-র রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ, ফব-র অগ্রগামী কিষাণ সভার রাজ্য সম্পাদক হাফিজ আলি সৈরানি, সিপিআইয়ের শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি দেবাশিস দত্তরাও মনে করেন, সদস্য করার পদ্ধতিতেই ত্রুটি রয়েছে। দেবাশিসবাবু এবং হাফিজ স্পষ্টই বলেছেন, “গণ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে গিয়ে আমরা রাজনীতি ভুলে গিয়েছি! গণ সংগঠনের বহু লোক আমাদের মিছিলে এসেছেন। কিন্তু পরিবর্তনের স্লোগান তাঁদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।”
এক ধাপ এগিয়ে অশোকবাবুর বক্তব্য, “গণ সংগঠনের সদস্যদের একাংশ নানা সুযোগসুবিধা পাওয়ার জন্য সব সময়েই শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে থাকতে চায়। সেই সূত্রেই বাম সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন বামপন্থী গণ সংগঠনের সদস্য হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের অনেকেরই মন পড়েছিল উল্টো দিকে। ভোটের ফলেই তা স্পষ্ট।” অশোকবাবুর আশঙ্কা, এ বার বিভিন্ন বামপন্থী গণ সংগঠনে ভাঙন ধরবে। সেই শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে থাকার সুযোগ পেতেই তাদের একাংশ তৃণমূলের দিকে ঝুঁকবে। ১৯৭৭-এ বামেরা ক্ষমতায় আসার পরেও এ ভাবেই কংগ্রেসের বিভিন্ন গণ সংগঠন ভেঙে বহু মানুষ সিপিএমে এসেছিলেন।
প্রয়াত জ্যোতি বসু লোকসভা-বিপর্যয়ের পরে ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ দাওয়াই হিসাবে গণ সংগঠনের উপরেই সব চেয়ে বেশি জোর দিতে বলেছিলেন। পরবর্তী কালে সিপিএমের প্রতিটি রাজ্য কমিটির বৈঠকেও গণ সংগঠনের উপরে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা যে কাজে আসেনি, ভোটের ফলেই তা স্পষ্ট। সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, “কে বামেদের ভোট দিয়েছেন, কে দেননি সব কিছু নিয়েই পর্যালোচনা হবে। তারপরেই প্রকৃত সত্য বোঝা যাবে।”

বাম

গণসংগঠনের সদস্য

কৃষক সভা ১.৫ কোটি
ডিওয়াইএফআই ৮৫ লক্ষ
মহিলা সমিতি ৬০ লক্ষ
সিটু ১৭ লক্ষ
এসএফআই ১৩ লক্ষ
অগ্রগামী কিষাণ সভা ১০ লক্ষ
ইউটিইউসি ৫.৫ লক্ষ
এআইটিইউসি ৩.৫ লক্ষ
অন্য সংগঠন ১৫-২০ লক্ষ

খাতায় কলমে বাম ফ্রন্টের ভোট সাড়ে তিন কোটির বেশি

বাম ফ্রন্ট পেয়েছে ১ কোটি ৯৫ লক্ষ

Previous Story Rajya Next Story




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.