বুদ্ধবাবুর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিকে অবশ্য বিশেষ আমল দিতে চায়নি তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি বুঝতে পারছি না, এত অধৈর্য কেন? সবে তো ১০ দিন হল ক্ষমতায় এসেছি! আমার তো ওদের জন্য করুণা হয়!” শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এক ধাপ এগিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘উত্তেজনা ছড়ানো’র অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, “কেন রাসমণি রোডে অঙ্গভঙ্গি করে উত্তেজনা ছড়াচ্ছেন? আমরা যে কোনও মূল্যে বাংলার শান্তি, মৈত্রী, সংহতি রাখব। কুৎসা, আজেবাজে ভাষণ দিয়ে কিছু হবে না!”
বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পরে বুদ্ধবাবু কেবল পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন তা-ই নয়, তিনি প্রকাশ্যে গত ১৮ দিনে একটি কথাও বলেননি। দিনের অধিকাংশ সময় আলিমুদ্দিনে থাকলেও কার্যত মুখে কুলুপ এঁটে থাকতেন। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু যতই পলিটব্যুরো থেকে বুদ্ধবাবুর ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছাকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিন, যাঁকে সামনে রেখে বামফ্রন্ট ভোটে লড়ল, কেন তিনি একটি কথাও বলছেন না, তা নিয়ে সিপিএমেই প্রশ্ন উঠছিল। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় দলীয় কর্মীরা খুন হওয়ার পরেও কেন তিনি চুপ করে আছেন, তা নিয়েও জেলার নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি-ভেজা রানি রাসমণি অ্যাভেনিউয়ে এ দিন এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এলেন বুদ্ধবাবু। তাঁর মৌনব্রত ভঙ্গের সাক্ষী রইলেন কয়েক হাজার বামপন্থী কর্মী, বিমানবাবু, নিরুপম সেন, মহম্মদ সেলিম, আরএসপি-র ক্ষিতি গোস্বামী, ফরওয়ার্ড ব্লকের নরেন দে, সিপিআইয়ের স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। একদিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বিধানসভায় বাম সদস্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে গিয়ে আধঘণ্টা ‘সময় কাটিয়েছেন’। কিন্তু বুদ্ধবাবু যে বুদ্ধবাবুতেই আছেন, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ আক্রমণাত্মক ভঙ্গি তা স্পষ্ট করে দিল!
কী করলেন বুদ্ধবাবু? তৃণমূলের লোকদের সঙ্গে গিয়ে সিপিএমের পার্টি অফিস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ‘গল্প’ সাজানোর জন্য পুলিশ-প্রশাসনকে ‘হুঁশিয়ারি’ দিলেন। জানিয়ে দিলেন, বামেদের দলীয় কার্যালয় দখল বা বামপন্থীদের গ্রামছাড়া করার ঘটনা মেনে নেওয়া হবে না। বললেন, “নির্বাচনে পরাজিত হলেও রাজ্যের অর্ধেকের বেশি পঞ্চায়েত এখনও বামেদের দখলে। বামপন্থীরা ১ কোটি ৯৫ লক্ষ ভোট পেয়েছেন। গ্রামে গ্রামে এখনও লালঝান্ডা উড়ছে! লালঝান্ডার সম্মান রক্ষা করতে হবে!” করতালিও পেলেন বিপুল।
সমাবেশে এ দিন প্রধান বক্তা ছিলেন বুদ্ধবাবুই। কিছুক্ষণ তিনি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই বক্তৃতা করেন। প্রথমে এক বার ছাতা সরিয়ে দিলেও পরে তাঁর মাথায় এক জন ছাতা ধরেন। গোটা ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গেল, পরাজয়ের পরেও দলের প্রধান ‘আকর্ষণ’ এখনও বুদ্ধবাবু। দীর্ঘ ৩৪ বছর বাদে এ ভাবেই পরাজিত মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে রেখেই বিরোধী ভূমিকায় রাস্তায় নামল বামফ্রন্ট।
পেট্রোপণ্য-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও রাজ্য জুড়ে বাম কর্মীদের উপরে আক্রমণের প্রতিবাদে এ দিনের সমাবেশে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী তিন জেলা থেকে কর্মীদের জমায়েত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও ভিড় তেমন হয়নি। বাস বা ম্যাটাডোরে বাম কর্মীদের আসার চেনা ছবিও ছিল না। তবে বুদ্ধবাবু-বিমানবাবুর ‘কড়া মেজাজ’ বৃষ্টিতেও কর্মীদের কিছুটা চাঙ্গা করে তোলে। বিমানবাবু বলেন, “তৃণমূলের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পুলিশ সিপিএমের দলীয় কার্যালয়ে তল্লাশি করার কে? দরকারে পুলিশ একা যাক!” আর বুদ্ধবাবুর মতে, পুলিশের সঙ্গে তৃণমূলের লোকেরা গিয়ে যে ভাবে অস্ত্র উদ্ধার করছে, কোনও রাজনৈতিক দল সে কাজ করতে পারে না। রাজ্য জুড়ে যে ভাবে বাম কর্মীদের উপরে হামলা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে বামেরা ৩ জুন মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছে ডেপুটেশন দেবে। তা জানিয়েও বিমানবাবু বলেন, “রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের এই দাপাদাপি আমরা মানতে পারি না! তাই এই অবস্থার পরিবর্তন চাই!” |