আপনার কলমে...
১৬ ভাদ্র ১৪১৯ শনিবার ১ সেপ্টেম্বর ২০১২


পাথর ভাঙা রং ও ঘাসে ঢাকা শহরের গল্প
ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে এক এক জনের এক এক রকম। কেউ বেড়াতে চায় নিজের রাজ্যে বা দেশে, কারও আবার সে সব ছাড়িয়ে আকাঙ্ক্ষিত জায়গা বিস্তৃত হয় বিশ্বময়। আমি ওই শেষের দলেই পড়ি। যদিও বিদেশ ভ্রমণের এই সুপ্ত বাসনা আমার অনেক দিনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। সেখানকার অনেক বন্ধুই পরে বিদেশ ফেরত বা বিদেশেই স্থায়ী ভাবে রয়ে গিয়েছে। আমি যেন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আর এক দিন ছেলে দেবাশিস ও পুত্রবধূ সোমালির ইচ্ছেয় সেই সুপ্ত বাসনা পূরণের পালাও এসে গেল।

ওরা দু’জনেই ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে কাজ করে। দু’পক্ষের ইচ্ছের জোরে জুনের শেষে আমরা পাড়ি দিলাম মার্কিন মুলুকে। ওই সময়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন দেখা। জুলাই মাসের ২ থেকে ৪ তারিখে সম্মেলন হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার সান হোসে শহরে। সংগঠকদের মধ্যে দেবাশিসও ছিল। উদ্বোধনী নৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল সোমালি। তিন দিন ব্যাপি অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রবাসী ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালিরা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ছয়-সাত হাজার বাঙালি এই আনন্দযজ্ঞের শরিক হয়েছিল। বাঙালি কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের আন্তরিক অংশগ্রহণে নাচ, গান, নাটক ও আলোচনায় ভরপুর হয়ে উঠেছিল এই উত্সব। বিদেশের মাটিতে বাঙালি হিসেবে গর্বে মন ভরে গেল।

বঙ্গ সম্মেলনের আনন্দ উত্সব মিটে যাওয়ার পর আমাদের ঘুরে বেড়ানোর পালা এল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের ভ্রমণ-তালিকায় প্রথমেই ছিল নেভাদা আর অ্যারিজোনা রাজ্যের বিশ্বখ্যাত লাস ভেগাস আর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। প্রকৃতি বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলেই সৃষ্টির এমন কিছু সাক্ষর রেখেছে যেখানে পৌঁছে মাথা নত হয়ে যায় মুগ্ধতায়। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এমনই এক সৃষ্টি। আর এখান থেকে শ’দেড়েক মাইল দূরে রয়েছে হুভার ড্যাম— মানব সভ্যতা ও প্রকৃতির সে এক অদ্ভুত মিশেল। এই অঞ্চলের ‘দুঃখের নদী’ কলোরাডোকে বেঁধে জলবিদ্যুত্ তৈরিতে আমেরিকা বিশ্বে অন্যতম হয়ে উঠেছে এই ‘হুভার ড্যাম’-এর কল্যাণেই। এখান থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে লাস ভেগাস।

মহাগিরিখাতের বর্ণময় রূপ
বিমানে সান হোসে থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস হয়ে লাস ভেগাস পৌঁছতে আমাদের ঘণ্টা দুই লেগেছিল। চোখে ধাঁধা লাগায় ১৯৪০ সালে ‘উদ্বোধন’ হওয়া লাস ভেগাসের ম্যাকারন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এখানে নেমে ঠিক করলাম, আগে অপরূপ প্রকৃতি দেখব। তাই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যাওয়ার জন্য ভাড়া করা হল গাড়ি। মিনিয়াপোলিস থেকে আমার এক ভাইপো লাস ভেগাসে এসে আমাদের সঙ্গী হল। এর পর পাঁচ জনের যাত্রা শুরু ক্যানিয়ন অভিমুখে। লাস ভেগাস নেভাদা রাজ্যে, আর আমাদের যেতে হবে অ্যারিজোনায়। নেভাদার মরু অঞ্চলের জনমানবহীন রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলাম প্রায় ৫০-৬০ মাইল। দু’ধারে চমত্কার ছোট বড় গাছ। সে দিন ছিল লক্ষ্মীপূর্ণিমা— আকাশে পূর্ণ চাঁদ। এমন পরিবেশে চাঁদ বুঝি আরও বড়, জ্যোত্স্নায় ধুয়ে যাচ্ছে যেন আমাদের পথ। রাস্তায় এক জায়গায় দেখলাম প্রচুর ধোঁয়া, গাছের মাথাগুলিতে মনে হচ্ছিল অসংখ্য মশাল জ্বালানো। গাড়িচালকের কাছে শুনলাম, ‘ফরেস্ট ফায়ার’। দাবানল শব্দটির সঙ্গে পরিচয় থাকলেও বাস্তবে সে যে কেমন তা তো দেখিনি কখনও! বিস্ময় নিয়েই পার হয়ে এলাম সে রাস্তা।

গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। ‘জিপিএস’ রাস্তা দেখিয়ে হোটেলের সামনে দাঁড় করাল আমাদের। অ্যারিজোনা রাজ্যের এই মহাগিরিখাত (২৭৭ মাইল লম্বা, ৪ থেকে ১৮ মাইল পর্যন্ত চওড়া ও ১ মাইল গভীর) স্পেনের এক দল ভ্রমণার্থীর নজরে আসে ১৫৪০ সালে। ইউরোপীয়রা আসার আগে গিরিখাতে বাস করত আদিবাসী আমেরিকানরা। অনেক শাখানদী সঙ্গে নিয়ে কলোরাডো নদী বয়ে চলেছে পর্বতের ভেতর দিয়ে, ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত। এখানে প্রায় দু’শো কোটি বছর ধরে চলমান এই জলরাশির ঘাত-প্রতিঘাতে সাউথ রিম ও নর্থ রিম নামের খাড়া গিরিখাত সৃষ্টি হয়েছে। পাথর ভেঙে তৈরি হয়েছে নানা রং ও আকারের নতুন নতুন স্তর। বছরে ৫০ লাখ মানুষ আসেন প্রাকৃতিক এই রূপের আকর্ষণে। পর্যটকদের ৯০ শতাংশই আসেন সাউথ রিম–এর দিকে। এই রিম ধরে হেঁটে বা খচ্চরে চেপে নামা যায় পাহাড়ের তলদেশে। যাওয়া যায় খাদের অপর প্রান্তেও— নর্থ রিমে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বেশ কয়েক বার এখানে এসেছিলেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। প্রকৃতির এই ‘দান’কে সংরক্ষণ করে আমেরিকার প্রথম ‘জাতীয় উদ্যান’ হিসেবে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য ‘উপহার’-এর পরিকল্পনাও তাঁর।

সূর্য্যোদয়
সূর্যোদয় এখানকার বড় আকর্ষণ। পর দিন তাই অন্ধকার থাকতেই পৌঁছে গেলাম। কিন্তু আমাদের আগেই, অরুণোদয়ের জন্য ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন অনেকেই। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। নীচে পাথরের স্তর, বিভিন্ন আকারের, মনে হচ্ছিল সে সব মন্দির আর প্রাসাদ। নামকরণও তেমন— শিব, ব্রহ্মা, বুদ্ধ মন্দির। পুবাকাশ ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আমরা— বিভিন্ন দেশের লোক। মনে হচ্ছে প্রতিদিন একই নিয়মে উঠতে উঠতে ক্লান্ত দিবাকর বুঝি বিশ্রাম নিচ্ছেন। পরশুরামের ‘মহাপুরুষ’ গল্পের সাধুবাবাকে স্মরণ করে সূর্যকে বলেছিলাম, ‘উঠ্ উঠ্।’ অবশেষে ‘সোনার থালা’ মুখ দেখাল। আলো ফুটে তৈরি হল অপূর্ব এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। ঠান্ডা হাওয়া ঝড়ের মতো বইছে ঠিকই, কিন্তু থামাতে পারছে না উচ্ছ্বসিত দর্শকদের। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ধারেই কাচের বড় বড় ঘর। দর্শকরা সেখান থেকে টেলিস্কোপে দেখছেন কলোরাডো নদী, অনেক দূর পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে সাজানো পাথর আর ও-পারের নর্থ রিমকে। সাউথ রিমে অনেকগুলো ‘সাইট সিইং স্পট’ রয়েছে। সেই সব স্পটে পৌঁছতে রয়েছে দশ মিনিট অন্তর বাস পরিষেবা। বাস থেকে পর্যটকরা নেমে পড়তে পারেন ইচ্ছানুযায়ী যে কোনও স্পটে। এ সব জায়গা থেকে নানা ভাবে দেখা যায় গিরিখাতের অপার সৌন্দর্য। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে, কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিয়েছেন পরিষেবার দিকেও। খাদের ধারে ‘ফেন্সিং’, বসার ব্যবস্থা, খাওয়ার জায়গা— দর্শকদের সুবিধার্থে আছে সব কিছুই। আশপাশের মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণ, নীলগাই। ঘণ্টা পাঁচেক ছিলাম এই গিরিখাতের পাশে। উপভোগ করেছি প্রত্যেকটা মুহূর্ত।

গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে ঘণ্টা পাঁচেকের দূরত্বে লাস ভেগাস। যাওয়া আসার একই রাস্তা— জনহীন, তবে দু’ধারে ছোট বড় গাছ। পথেই পৃথিবীর উচ্চতম হুভার ড্যাম, যাওয়ার সময় নেমে দেখিনি, ফেরার পথে কিছুটা ধারণা নিয়ে গেলাম। কলোরাডো নদীর উপর ১৯৩৫ সালে তৈরি করা হয় এই বাঁধ। আমেরিকার এই অঞ্চল-সহ লাস ভেগাসের বর্তমান ‘উজ্জ্বল’ অবস্থার পিছনে এই বাঁধেরই অবদান। সন্ধে হয়ে আসছিল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে আলোর মালায় সজ্জিত তারাময় এক শহর, রাতের লাস্যময়ী রানি— লাস ভেগাস। কেউ বলে আনন্দনগরী, কারও চোখে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ ক্ষেত্র। দেবাশিস ও সোমালি আগে এসেছে এখানে। ওদের মুখেই শুনেছি এই শহরের কথা। এ বার নিজের চোখে সেই সব কথা ঝালিয়ে নেওয়ার পালা।
বড় বড় ঘাসে ঢাকা নেভাদা রাজ্যের জলময় এই অঞ্চল ১৮২৯ সালে আবিষ্কৃত হলেও শহরটির পত্তন হয় ১৯০৫ সালে। স্পেনীয়তে ‘লাস ভেগাস’ মানে ‘ঘাসে ঢাকা জায়গা’, সেখান থেকেই জায়গার নাম। ১৯০৫ সালে ৮০০ নাগরিক নিয়ে যে শহরের পত্তন, আজ সেই সংখ্যাটি বেড়ে প্রায় ৬ লাখে পৌঁছেছে। ২০০৫ সালে লাস ভেগাস পালন করে তার ‘জন্ম’ শতবার্ষিকী। জমজমাট এই শহরের প্রধান আকর্ষণ ক্যাসিনোয় আইনসম্মত ‘জুয়া খেলা’। এই বৈধতা মিলেছিল ১৯৬০ সালে। লাস ভেগাসকে বলা হয় প্রমোদ জগতের রাজধানী। শহরের বুকে ৪ মাইল লম্বা ‘লাস ভেগাস স্ট্রিপ’— যার দু’ধার হোটেল, ক্যাসিনো-সহ অন্যান্য বিনোদনের উপকরণে সজ্জিত। প্রতিটি হোটেলেই প্রচুর রেস্তোরাঁ, পুল, স্পা, জিমনেসিয়াম আরও কত কী! তবে, ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকা এ শহরের আনন্দ উপভোগে কিন্তু কোনও অশালীনতা জড়িয়ে নেই। ক্যাসিনোতে বসে ভাগ্য পরীক্ষা করলাম সবাই, এবং হারলাম। প্রবীণ নাগরিকদের বিশেষ সুবিধা মেলে ‘খেলা’য়, সে সুযোগ নিয়েও পাল্টাতে পারলাম না ভাগ্য!

হোটেলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম। একটা থেকে আর একটায় যাওয়ার জন্য রয়েছে ফুটপাথ, করিডর, এমনকী মোনোরেলও! চোখ ধাঁধানো জিনিসে ঠাসা এখানকার মলগুলি। ‘সিজার্স প্যালেস’ তেমনই এক হোটেল, যেখানে ঢোকার পর মনে হল উপরের নীল আকাশ প্রাক্ সন্ধ্যা মুহূর্তের। অথচ বাইরে তখন বেশ রাত! দুপুর হলেও নাকি একই অনুভূতি হত! এখানে রয়েছে নানা ধরনের রোমান মূর্তি, বিরাট অ্যাকোয়েরিয়াম আর কোলোসিয়াম— যেখানে অভিনীত হচ্ছিল একাঙ্ক নাটক। হোটেল ‘বেলাজিও’র পরিবেশ কল্পনারও বাইরে। হোটেলের সামনে সিকি মাইল জুড়ে লেকের উপর সঙ্গীতের তালে তালে নৃত্যরত জলের ফোয়ারা— মিউজিক্যাল ফাউন্টেন। মাঝ রাত পর্যন্ত নাচে ফোয়ারাগুলি। এট্রিয়াম— ক্যাসিনো সমৃদ্ধ এই হোটেলে রয়েছে ফুল ফলের ঘনঘটা। হোটেল প্যারিস-লাস ভেগাস-এ রয়েছে ৪৫০ ফুট উচ্চতার ‘আইফেল টাওয়ার’। প্যারিসেই আছি কি! বোঝা মুশকিল! ভেনেসিয়ান হোটেলের বৈশিষ্ট্য তার গন্ডোলা। এখানেও একই চিত্র— দিনরাত গুলিয়ে যায়। এখানে আছে ‘মাদাম তুসো মিউজিয়াম’। পৃথিবীখ্যাত কারও মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার পর ‘ক্যামেরার স্ক্রিনে’ সে ছবি দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না, যাঁর সঙ্গে ছবি তুললাম, মূর্তি তিনি, না আমি! এমজিএম গ্র্যান্ড, যার সামনেই দাঁড়ানো ২০টি লিমুজিন গাড়ি, বৈভব ও বৈচিত্র্যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। জীবন্ত সিংহ ঘুরে বেড়াচ্ছে দেড় ইঞ্চি মোটা, স্বচ্ছ কাচের ঘরে। মনে হয় হাত স্পর্শ করছে পশুরাজের শরীর। এ ছাড়াও রয়েছে হোটেল এক্সক্যালিবর, ম্যান্ডালে বে, মন্টে কার্লো, নিউ ইয়র্ক নিউ ইয়র্ক, ট্রপিকানা ইত্যাদি। লাস ভেগাসের আরও অনেক কিছুই মনের স্মৃতিতে ধরা থাকল, যা কোনও দিন ভোলার নয়!

ক্যাসিনো

এক কথায়: প্রকৃতির এই ‘দান’কে সংরক্ষণ করে আমেরিকার প্রথম ‘জাতীয় উদ্যান’
হিসেবে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য ‘উপহার’-এর পরিকল্পনা সত্যিই অনবদ্য।
 
কোনও বিষয়ে নিজস্ব মতামত লেখালেখির অভ্যেস ছোটবেলা থেকেই। কর্মজগত থেকে অবসর গ্রহণের পর মিলল সেই প্যাশনকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো আরও সময়। বর্তমানে একটি ব্রিটিশ সংবাদপত্রের ভারতীয় সংবাদদাতা। কাজের সুবাদেই প্রায় সারা ভারত ঘোরা। বাংলা উপন্যাস পড়ার ‘পোকা’ হলেও সমসাময়িক বিষয়ের সঙ্গে পর্যটনকেন্দ্র নিয়ে লেখালেখি করাটাও একটা নেশা।

ছবি: লেখক

 

রোজের আনন্দবাজার এ বারের সংখ্যা সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর স্বাদবদল চিঠি পুরনো সংস্করণ