সুরের পঙ্কজ
সুরস্রষ্টা হিসাবে মহিষাসুরমর্দিনী পালা তাঁর অন্যতম
সেরা সৃষ্টি। ১৯৪৪ সালে কেএল সায়গলের সঙ্গে জুটি
বেঁধে তৈরি করলেন ‘মেরি বহেন’ সিনেমার অবিস্মরণীয়
গান। গানের সুর দেওয়ার পাশাপাশি অভিনয় করেছেন
দক্ষতার সঙ্গে। অতীতের তাঁরায় এ বার পঙ্কজকুমার মল্লিক

শুরুর সে দিন
রবীন্দ্রনাথের গানের ঐশ্বর্য ও ভঙ্গির সঙ্গে সাধারণ বাঙালির প্রাথমিক পরিচয় যাঁর হাত ধরে, তিনি পঙ্কজকুমার মল্লিক। একাধারে গায়ক, সুরকার, অভিনেতা ও শিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই হারমোনিয়ামের প্রতি প্রবল আকর্ষণ। আর সেটা তাঁর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন মেজোজামাইবাবু। বাড়িতে কলের গানে গান শোনা ছিল নিয়মিত। তখন প্রথম মহাযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। পাড়ার কাছেই থাকতেন ছোটকাকার বন্ধু শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ। মেসোপটেমিয়ার কোনও এক ব্যাঙ্কে তিনি চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার আগে কিছু দামি জিনিস ও বাড়ির চাবি পঙ্কজবাবুর মা মনমোহনীদেবীর কাছে রেখে গেলেন। এক দিন হন্যে হয়ে হারমোনিয়ামের খোঁজ করতে করতে হঠাৎ পঙ্কজের মনে পড়ে যায় শৈলেনকাকার হারমোনিয়ামের কথা। কিন্তু চাবি? মুশকিল আসান করলেন পিসিমা। চাবি হাতে পেয়ে দৌড়ে পাশের ঘোষ লেনে। বন্ধ ঘরে, অজ্ঞ আঙুলের চাপে শব্দ উঠল এলোমেলো। তবে নিরন্তর অভ্যাসে এক দিন সুর উঠল হারমোনিয়ামে।

• জন্ম: ১০ মে ১৯০৫ সাল, বৈষ্ণব পরিবারে।
• আদি নিবাস: কাটোয়া।
• বসতবাড়ি: উত্তর কলকাতায় মানিকতলার চালতাবাগান।
• পিতা: মণিমোহন মল্লিক
• মাতা: মনমোহনী মল্লিক।
• স্ত্রী: অন্নপূর্ণাদেবী

শিক্ষা ও কর্মজীবন
ম্যাট্রিকুলেশন: ১৯২২ সাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
কলেজ: বঙ্গবাসী কলেজ। তবে পারিবারিক জীবনে নানা বিপর্যয়ের জন্য কলেজ জীবন অর্ধসমাপ্ত।
কর্মস্থান: ক্যানিং স্ট্রিট।
পেশা: পাটের দালালি।

গায়ক জীবন
অল ইন্ডিয়া রেডিওয় সঙ্গীতচর্চা
পঙ্কজকুমার রবীন্দ্রনাথের গান শেখার প্রথম উৎসাহ পেলেন সালটা তখন ১৯২২। দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে প্রথম শেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘হেরি অহরহ তোমারি বিরহ ভুবনে ভুবনে রাজে হে’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান কী ভাবে আয়ত্ত করতে হয় পঙ্কজকুমার সেটি শিখেছিলেন ওই দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছেই। সঙ্গীত শিক্ষা শুরু ক্ষেত্রমোহন সঙ্গীত বিদ্যালয়ে। শিখলেন ধ্রুপদ ও রাগসঙ্গীত।

১৯২৪: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ কবিতায় সুর দেন ও রবীন্দ্রনাথকে শোনানোর সুযোগ পান।
• ১৯২৬: ভিয়েলোফোন কোম্পানি থেকে প্রথম রেকর্ড বের হয় তাঁর। রেকর্ডের এক পিঠে ছিল বাণীকুমারের লেখা ‘নেমেছে আজ নবীন বাদল’ আর অন্য পিঠে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের কথায় ‘আমারে ভালোবেসে’। সুর দিয়েছিলেন স্বয়ং পঙ্কজবাবু।
• ১৯২৯: প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ডিং- ‘প্রলয় নাচন নাচলে যখন’।
• ১৯৬১: শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ডিং- ‘হে মোর দেবতা’, ‘যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি’, ‘বাহির পথে বিবাগী হিয়া’ ও ‘বাহিরে ভুল হানবে যখন’।

সঙ্গীত পরিচালনা ও অভিনয়
১৯৩১: ‘চোরাকাঁটা’ ও ‘চাষার মেয়ে’ এই দু’টি নির্বাক চলচ্চিত্রে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা করেন। ছবি দু’টি ছিল নিউ থিয়েটার্সের। তখন নিউ থিয়েটার্সের নাম ছিল ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্র্যাফ্ট। তিনি অর্কেস্ট্রায় সুর রচনা করেন। অন্য দিকে, সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম ছবি ‘দেনাপাওনা’।
১৯৩৫: ‘ভাগ্যচক্র’ ও এরই হিন্দি ‘ধূপছাঁও’ ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক করেন।

‘ভাগ্যচক্র’, ‘মুক্তি’, (বাংলা ও হিন্দি), ‘লড়কি’, ‘সুবহ কি সিতারা’, ‘ডাক্তার’, ‘কাশীনাথ’, ‘বড়দিদি’, ‘রাইকমল’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘পরিচয়’, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, ‘চণ্ডীদাস’, ‘নর্তকী’, ‘মঞ্জিল’, ‘অধিকার’, ‘গৃহদাহ’, ‘ডাকু মনসুর’ (হিন্দি), ‘বড়দিদি’, ‘রূপকথা’, (হিন্দি), ‘জীবনমরণ’, ‘রাইকমল’, ‘মীনাক্ষী’, ‘লৌহকপাট’, ‘আহ্বান’, বিগলিত করুণা জাহ্নবী ‘যমুনা’, ‘জলজলা’-সহ প্রায় ৬৫টি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেন পঙ্কজবাবু। প্রথম ছবি ‘মুক্তি’। ছবির পরিচালক ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। ছবিতে ব্যবহার করেছেন ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’, ‘আমি কান পেতে রই’, ‘আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে’, ‘তার বিদায়বেলার মালাখানি আমার গলে রে’ এই গানগুলি।


অভিনীত ছবি
বাংলা ছবি: ‘মুক্তি’, ‘ডাক্তার’ (পরে এটি আনন্দআশ্রম নামে হয়), ‘দেশেরমাটি’, ‘অধিকার’, ‘নর্তকী’, ‘আলোছায়া’ ইত্যাদি।
হিন্দি ছবি: ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘আঁধি’, ‘ধরতিমাতা’।
নায়ক পঙ্কজের সঙ্গে নায়িকার ভূমিকায় শ্রীমতী পান্না, ভারতীদেবী, মলিনাদেবী প্রমুখ।
যে সব পরিচালকের ছবিতে অভিনয় ও সঙ্গীতে সুরারোপ করেছেন- প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, দেবকী বসু, সৌরেন সেন, প্রমথেশ বড়ুয়া, নীতিন বসু, অমর মল্লিক, ফণী মজুমদার, সুবোধ মিত্র, প্রফুল্ল রায়, কার্তিক চট্টোপাদ্যায়, দীনেশ দাশ, বোলানাথ, মধু বসু, ইন্দর সেন, তপন সিংহ, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, হীরেন নাগ, পল জিলস, জ্ঞান মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।


বেতারে কাজ

সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও অন্যান্যদের সঙ্গে
১৯২৭ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত রেডিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ ৪৭ বছর বেতার কেন্দ্রে সঙ্গীতশিক্ষার আসর চালিয়ে গিয়েছিলেন।

১৯২৭: ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’, ও ‘একদা তুমি প্রিয়ে’-এই দু’টি গানের মাধ্যমে রেডিওতে প্রথম আত্মপ্রকাশ।
১৯২৯: সেপ্টেম্বর মাসে বেতারে ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ পরিচালনার দায়িত্ব পান পঙ্কজবাবু। এর মাত্র মাস ছয়েক আগে কলকাতা রেডিওর জন্ম। এই সময় যাঁরা রেডিওতে যুক্ত ছিলেন সবার উপরে নৃপেন মজুমদার, সঙ্গীত বিভাগে ছিলেন পঙ্কজবাবু ও রাইচাঁদ বড়াল, বার্তা বিভাগে ছিলেন রাজেন সেন, গল্পদাদুর আসর পরিচালনা করতেন যোগেন বসু, কয়েকদিন পরে গীতিকার বাণীকুমার ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যোগ দিলেন।
১৯৩২: বেতারে সম্প্রচারিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটির সুরস্রষ্টা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

পঙ্কজকুমার ও কাননদেবী
গান্ধর্বীর সম্বর্ধনায়
পঙ্কজকুমার মল্লিক সম্পর্কে প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী কাননদেবী বলেছিলেন, ‘‘রবীন্দ্রসঙ্গীত আমি আগেও শিখেছি এবং গেয়েছি। সে গাওয়া ছিল অতি সন্তর্পণে রেল লাইনের উপর দিয়ে হাঁটার মতো। সহজ ভাবে প্রাণ ঢেলে দরদ দিয়ে কী ভাবে গান করতে হয় পঙ্কজবাবুর কাছে তা শিখেছি।’’
প্রসঙ্গত কুন্দনলাল সায়গলকে যে রবীন্দ্রসঙ্গীতটি প্রথম শিখিয়েছিলেন পঙ্কজবাবু সেটি ‘প্রথম যুগের উদয় দিগঙ্গনে প্রথম দিনের ঊষা’।

বিশিষ্টদের স্মৃতিচারণায় পঙ্কজকুমার মল্লিক
অরুণলেখা গুপ্ত মানুষ ও শিল্পী এই দু’ভাবে বাবাকে পেয়েছি। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। একবারে ছোটবেলায় সেই ভাবে তো বোধ থাকে না। তাই তখন বাবাকে সেই ভাবে পেতাম না। বাবা ছিলেন ঘোর সংসারী। আবার বাবার যে আলাদা একটা জগৎ ছিল সেটাও চিহ্নিত করতে পারতাম না। একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম শিল্পী জীবনের পাশাপাশি বাবা আমাদের যৌথ সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমি বাবার শিল্পী জীবন সম্বন্ধে বুঝতে পারলাম। বাবার তিরিশ-চল্লিশের শিল্পীসত্তার চূড়ান্ত পর্যায় আমার দেখা সম্ভব হয়নি। আমার জন্ম মধ্য চল্লিশের দশক। আমি দেখেছি রেডিও, স্টুডিও চত্বরে সঙ্গীত পরিচালনা, গান গাওয়া। আর দেখেছি সঙ্গীতের প্রতি কি নিপুণ ভাবে নিজেকে একাত্ম করে ফেলতেন।

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ধুতি-পাঞ্জাবিতে আপাদমস্তক মানুষটি অত্যন্ত ভদ্রলোক। সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক ও শিক্ষক মানুষটির সান্নিধ্যে আসি ১৯৫০-এর আগে। ওঁর পাণ্ডিত্যের কোনও তুলনা হয় না। তবে ১৯৫০-এ মহিষাসুরমর্দিনীর সময় থেকে যেন আরও কাছে চলে আসি। দিন পনেরো ধরে যে মহড়া চলত সেখানে দেখেছি শিল্পীদের কী ভাবে ভালবাসতেন। সেই আমাদের ভাল লাগার দিন ছিল। হিন্দি গানের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন সারা ভারতবর্ষে। আমি ওঁর সঙ্গীত পরিচালনায় ‘জলজলে’ চলচ্চিত্রে গান গেয়েছিলাম। ১৯৬১তে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে গুজরাতে একটি অনুষ্ঠানে মুম্বই, কলকাতা, মাদ্রাজ-সহ নানা জায়গা থেকে আসা শিল্পীদের একটা সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে দেখেছিলাম পঙ্কজদার জন্য একটা পুরো দিন ধার্য করা হয়েছে। এত জনপ্রিয় মানুষ আমি জীবনে খুব কম দেখেছি।

সুমিত্রা সেন প্রথম জীবনে নানা ধরনের গান করেছি রেডিওতে। পঙ্কজদাও তখন রেডিওতে ছিলেন। উনি আমার গান শুনেছিলেন। বিভিন্ন পুজোতে উনি স্ক্রিপ্ট করে আমাদের গান গাওয়াতেন। এই ভাবে আমি ওঁর নজরে আসি। পঙ্কজদা মানেই তো ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র কথা এসে পড়ে। কে কে না গেয়েছি এখানে। কারও নাম আলাদা করে বলছি না। কিন্তু সেই প্রভাতী অনুষ্ঠানের মাসখানেক আগে থেকে যে মহড়া শুরু হত, সেখানে কারও ক্ষমতা ছিল না, না আসার বা তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার। ভয় ও শ্রদ্ধা ছিল সমান ভাবে। উনিও আমাদের সমান ভাবে যত্ন নিয়ে গান শেখাতেন। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় যাঁরা গান গেয়েছেন শ্রীমতী সুপ্রভা ঘোষ (সরকার), শ্রীমতী পারুল চৌধুরী, শ্রীমতী শৈলদেবী, শ্রীমতী ইলা ঘোষ (মিত্র), শ্রীমতী সুধা মুখোপাধ্যায়, শ্রী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্রীমতী উৎপলা সেন, শ্রী তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমতী রাধারাণি, শ্রীমতী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমতী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমতী গীতা দত্ত, শ্রী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখ।

পঙ্কজকুমারের পুরস্কার প্রাপ্তি
• ১৯৩২: সারস্বত মহামণ্ডল তাঁকে ‘সুরসাগর’ উপাধি দেন।
১৯৪১: ‘ডাক্তার’ ছবির সুবাদে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে বিএফজেএ পুরস্কার। (নায়িকা ভারতীদেবী)
১৯৬৪: সঙ্গীত রত্নাকর
১৯৭০: পদ্মশ্রী
১৯৭৩: দাদাসাহেব ফালকে

তথ্য: পাপিয়া মিত্র
 
 

 
 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.