|
|
|
|
বিয়ের আগেই ঘরছাড়া
এটাই কি এই প্রজন্মের ট্রেন্ড? খোঁজ নিলেন অরিজিৎ চক্রবর্তী |
কবীর থাপারকে মনে আছে? হ্যাঁ, ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যয় দিওয়ানি’ ছবিতে যে ঠিক করে রেখেছিল গ্র্যাজুয়েশনের পর আর বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকবে না। কিংবা ‘ওয়েক আপ সিড’য়ের সিড-কে? যে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে সেই শহরেই আলাদা থাকা শুরু করেছিল।
এই শহরেও কিন্তু সিডের অভাব নেই। না, না, বাবা-মায়ের সঙ্গে মনোমালিন্যের ফলে যে তাঁরা একা থাকছেন, তা নয়। নিজের ইচ্ছাতেই শুরু করেছেন একা থাকা।
কিন্তু একা থাকার অসুবিধা তো কম নয়! নিজেই বানাতে হবে ব্রেকফাস্ট। মানে পোড়া টোস্ট, দফারফা করা স্ক্র্যাম্বলড্ এগ। কখনও আগের দিনের পড়ে থাকা পিৎজা। মায়ের হাতের সদ্য ফ্রুট জুস জুটবে না। আর ঘুম ভাঙতে দেরি হলে তো কথাই নেই, বাদ দিতে হবে ব্রেকফাস্ট। অফিসেই কোনও মতে সারতে হবে ‘ব্রাঞ্চ’। রবিবারে মায়ের ‘স্পেশাল’ লুচি-তরকারি! সেটাও ছেঁটে ফেলতে হবে।
কিন্তু কেন? কেন এমন স্বেচ্ছানির্বাসন? পশ্চিমী কায়দা? নাকি স্রেফ একা থাকার স্বাধীনতা উদযাপন?
“আমি কিন্তু শুধু পশ্চিমী প্রভাবের কথা বলব না। সমাজতত্ত্বে একটা কথা আছে ‘সামাজিকীকরণ’। সেটাই কোথাও পাল্টে গিয়েছে। এই প্রজন্ম তো জন্মাচ্ছেই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে। ফলে স্বাভাবিক ভাবে একসঙ্গে থাকার প্রযোজনীয়তা অনুভব করছে না। বাবা-মাও সেই অনুভুতিটা শেখানোর চেষ্টা করছেন না। দু’জনে ব্যস্ত নিজের নিজের কাজে। ফলে সামাজিক সম্পর্কের সুফল সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারছে না। সেটাই ব্যুমেরাং হয়ে ফেরত আসছে। জেন ওয়াই শুধু নিজের প্রয়োজনীয়তাকেই সব থেকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। আপসের রাস্তায় না গিয়ে একা থাকার পথটাই বেছে নিচ্ছে,” বলছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ড. অংশুমান সরকার। এ সব বলতে বলতে তিনি এটাও মনে করিয়ে দিলেন যে, “এ সবই হচ্ছে সামাজিক বিবর্তনের একটা ধাপ। আবার এই মানসিক অবস্থানটাও হয়তো বদলে যাবে। অন্য একটা আকার পাবে।”
স্বাধীনতা, স্বাধীনতা আর...
বিয়ের পর মেয়েরা তো স্বাভাবিক ভাবেই অন্য বাড়িতে চলে যায়। অনেক সময় ছেলেরাও। কিন্তু এটা তো সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। এখানে শাশুড়ি-বৌমার ঝামেলা নেই। মন কষাকষি নেই। তবুও একটা বয়সে পৌঁছে পৃথিবীকে যে নিজের নিয়মে শাসন করতে ইচ্ছে হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। সেই ইচ্ছেটাই কি তবে একা থাকার দিকে ঠেলে দিচ্ছে এই প্রজন্মকে? অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ কুড়ি বছর বয়স থেকেই একা থাকছেন। একা থাকা, বিশেষ করে কোনও মেয়ের ক্ষেত্রে, তো অনেক সমস্যা। তবু কেন এই সিদ্ধান্ত? “একটা বয়সে তো নিজের প্রায়োরিটিটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। নিজের স্পেসের প্রয়োজনীয়তা সব থেকে বড় হয়ে যায়। সে সময় কখন বাড়ি ফিরছি, কে বাড়ি আসছে এই প্রশ্নগুলো শুনতে একদম ইচ্ছে করে না,” বলছিলেন সায়নী। এই প্রশ্নগুলো শুনবেন না বলেই একা থাকার সিদ্ধান্ত। নিজে রান্না করতে পারেন না। তাই প্রথম দু’বছর বাইরেই খেয়েছেন। নিয়মিত বাইরে খাওয়ায় শরীর খারাপ হয়েছে। তবু মনে হয়েছে একলা থাকাই তাঁর অভ্যেস। |
‘ওয়েক আপ সিড’য়ে রণবীর |
যাবেই যখন চলে
একা থাকা মানে, বাবা-মায়ের ‘কার্ফু টাইম’য়ের ধার ধারতে হবে না। হাল্কা করে অফিস কেটে বন্ধুদের সঙ্গে ছোট্ট জ্যাম সেশন করলেও, কারওকে জবাবদিহি করতে হবে না। শুধু কোক-পিৎজার খরচটা নিজের পকেট থেকেই যাবে। কিন্তু নো চিকচিক, নো ঝিকঝিক। তবে একা থাকার জন্য রোজগারটাও ভাল হতে হবে। সেটা যদি সম্ভব না হয়? তখন কিন্তু ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’ বলতে হবে। তবে ছেলে-মেয়ের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা বাবা-মায়ের পক্ষে মেনে নেওয়া কি সহজ? “না, একেবারেই সহজ নয়। কিন্তু কী করব? প্রত্যেকেরই তো নিজের নিজের স্পেসের প্রয়োজন হয়। ছেলে যদি সেটা ফিল করে, আলাদা থাকতেই পারে। আর এখন কাজের ক্ষেত্রটাও তো বেড়ে গিয়েছে। প্রাইভেসি না হোক কাজের জন্য তো যেতেই হতে পারে,” বলছিলেন সুপর্ণা রায় চৌধুরী। তাঁর ছেলে অয়ন তিন বছর সল্ট লেকে আলাদা থাকার পর এখন হায়দরাবাদে থাকছেন। এবং একাই।
ব্যুমেরাং প্রজন্ম
আমেরিকা-ইউরোপে কিন্তু ছবিটা একটু অন্য। জেন ওয়াই-য়ের অনেকেই আবার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকা শুরু করছেন। কারণটা অবশ্যই অর্থনৈতিক। খানিকটা শ্লেষের স্বরেই সমাজতত্ত্ববিদরা তাদের নাম দিয়েছেন ‘ব্যুমেরাং প্রজন্ম’। পশ্চিমী দেশে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে গেলে, একা থাকাই দস্তুর। আগের দশকগুলোতে এ ছবির কোনও বদল হয়নি। কিন্তু এখন অনেকেই আবার ফিরে আসছেন বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতে। বুমেরাং যেমন ফিরে আসে, তেমন জেন ওয়াই আবার ব্যাক টু বাবা-মায়ের বাড়ি। গত বছরের শুরু থেকে এই একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুমন্ত্র ঘোষ। ম্যানেজমেন্ট ট্রেনির মাইনেতে একা থাকতে অনেক সময় ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ হয়েছে। বলছিলেন, “এক বছরে অনেকবার মনে হয়েছে ফিরে যেতে। কোনও রবিবার বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে মনে হয়েছে, ‘থাক, অনেক হয়েছে, আবার ফিরে আসি’।” তবু ফেরেননি।
এ শহরে না হলে...
যে শহরে বাবা-মা আছেন, সে শহরেই ছেলে-মেয়ের আলাদা থাকা নিশ্চয়ই সমাজ সহজে নিতে পারে না। একা থাকা মানেই দেদার ফুর্তি আর চূড়ান্ত উশৃঙ্খলতার ইঙ্গিত। তবু কলকাতার কলেজপড়ুয়ারাও হোস্টেলে থেকে পড়ার জন্য ঝুলোঝুলি করছেন। কলেজে পড়ার সময়ই কৃষ্ণা রায় ঠিক করেছিলেন, মাস্টার্স আর বাড়ি থেকে নয়। “কলকাতায় পড়লে তো সেই বাড়িতেই থাকতে হবে। তাই দিল্লিতে অ্যাডমিশন নিই। একা থাকায় ক্লাব হপিং-মস্তি ঠিক আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে কাজের যে অভিজ্ঞতাটা পাওয়া যায়, সেটা বাড়ি থাকলে কিছুতেই হবে না। রাত দু’টোয় বাড়ি ফেরা বাবা-মা অ্যালাও করবে না। ওরা তো বুঝবে না মাইনে না থাকলেও ইন্টার্নশিপটা কতটা জরুরি,” বললেন কৃষ্ণা। এখন দিনে ক্লাস করার সঙ্গে বন্ধুরা মিলে রাতে ইন্টার্নশিপটাও করে নিচ্ছেন। তাঁদের ব্যাচের অনেকেই এখন বেঙ্গালুরু কী দিল্লি। কারণটা একই।
প্রেমের জন্য বাড়িছাড়া
সেই আদিগন্ত কাল থেকে তো কত লোককে বাড়ি ছাড়া করেছে প্রেম। এই প্রজন্ম যখন একা থাকার কথা বলছে, তখন কি অভিভাবকদের মনে প্রশ্ন উঠছে না, হয়তো প্রেমের জন্যই অন্য আস্তানার হদিস খুঁজছে ছেলে-মেয়েরা? কিংবা কোনও ‘লিভ ইন রিলেশনশিপ’য়ের আমিষ গন্ধ রয়েছে এই নিরামিষ ‘একলা’ থাকার মধ্যে! বছর সাতাশের অনুরাগ মণ্ডল শেষ দু’বছর একাই থাকেন। কিন্তু তাঁর মায়ের মনে এমন কথা আসেনি, যদিও একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না এমন সম্ভাবনা। “হতেই পারে। বাবা-মায়ের বাড়িতে তো লিভ ইন চলতে পারে না। তাই এমনটা ভাবতেই পারে। তবে মনে হয় না, আমার ছেলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এ রকম। ওর সঙ্গে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। এমন হলে আমাকে বলতই।”
মা তো জানেই না আমার কাজটা কী
বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে, চাকরি মানে সরকারি। আর অফিস টাইম মানে দশটা-পাঁচটা। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর কলকাতাও তো বদলে গিয়েছে। হাজারো নতুন পেশার হাতছানি জেন ওয়াইয়ের কাছে। যে পেশায় কোনও ধরাবাঁধা অফিসটাইমও নেই। কিন্তু সে সব সম্বন্ধে কতটা ওয়াকিবহাল অভিভাবকরা? তেমনটাই বলছিলেন রজত সরকার। ইভেন্ট অর্গানাইজার হিসেবে কাজ করা রজতের বাবা-মা দু’জনেই স্কুলশিক্ষক। “আমার মা এখনও বোঝে না আমি কী করি। জিজ্ঞেস করত, ‘কী এমন কাজ করি যা সন্ধেয় শুরু হয়?’ দু’বছর বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আরে এটা তো আমার প্যাশন। আমার প্রোফেশন। আমার তো রাত দু’টোয় বাড়ি ফিরতে অসুবিধা নেই। কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত মায়ের জেগে বসে থাকা, নিজেরই ভাল লাগত না। তাই এখন যাদবপুরে একা থাকি। মাকে স্কাইপ শিখিয়ে দিয়েছি। ওতেই কথা হয়,” বলছিলেন তিনি।
স্কাইপে মা-বাবার সঙ্গে কথা এক শহরে বসে। মাঝে মাঝে রবিবার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করা এক শহরে। আলাদা বাড়িতে থেকেও মাঝে মাঝে বাবা-মাকে নিয়ে মোকাম্বো কী মেন ল্যান্ড চায়নায় লাঞ্চ।
একা থাকা, আবার সেই সঙ্গে ইচ্ছে হলেই দোকা হয়ে যাওয়া।
তবু জেন ওয়াই জীবনের এই নতুন নকশাকে এখনও সর্বজনগ্রাহ্য অভ্যেস বলা যাবে না। তবে প্রস্তুতি পর্ব তো বটেই।
কে বলতে পারে, ২০২৫ কী নিয়ে অপেক্ষা করছে! |
|
|
|
|
|