দরদাম-ডিসকাউন্ট, রাস্তার উপরেই চলছে মাদক-বাজার
হাইওয়ের ধারে শক্তিগড়ের ল্যাংচা বা জয়নগরের মোয়ার সার-সার দোকানের পাশে যেন দাঁড়িয়ে আছি!
সম্ভাব্য খদ্দের ভেবে প্রায় হাত ধরে পীড়াপীড়ি চলছে কারবারিদের। এখানে দোকান বলতে বড় রাস্তার ধারে দরমা ঘেরা ছোট-ছোট খুপরি। সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিতেই বিক্রেতাদের দ্বিধাহীন আমন্ত্রণ, “এ দিকে দাদা। এই যে, এ দিকে আসুন!”
ঘুটিয়ারি শরিফের মাকালতলায় মাদকের খোলা বাজারে আপনি স্বাগত! কে বলবে, কলকাতার ধর্মতলা থেকে মেরে-কেটে ৪০ কিলোমিটার দূরে রয়েছি। ঘুটিয়ারি শরিফ স্টেশনে নেমে মাজারের পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক এগিয়েই মাকালতলা। গ্রামের হাজার দশেক মানুষের একটা বড় অংশই নির্ভরশীল মাদক-ব্যবসার উপরে। লালবাজারের গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, কলকাতার ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের
হস্টেলে সুলভ মাদকের অনেকটাই মফস্সলের এই ঠেক থেকেই আসে। মাদকসেবনে এসএসকেএম হাসপাতালের ইনটার্নের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পরেও মাকালতলা কিন্তু আছে মাকালতলাতেই।
মাদকের কারখানা। —নিজস্ব চিত্র
কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড়ের বালাই নেই। সকাল থেকে হাঁকডাক পেড়েই চলছে কারবার। আধ কিলোমিটার জুড়ে জমজমাট মাদক-ঠেক। চম্পাহাটি-নুঙ্গির নিষিদ্ধ বাজির বাজারের সঙ্গেও দৃশ্যটার মিল আছে। তবে বেশি মিল, জয়নগরের মোয়া বা শক্তিগড়ের ল্যাংচা-কারবারের সঙ্গেই।
বিক্রেতারা অকপটে জানাচ্ছেন, হেরোইন, ব্রাউন সুগার, চরস সব মিলবে। পাইকারি দরে শহুরে চোরাই ঠেকের জন্য ‘মাল’ সংগ্রহ কিংবা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কেনাকাটি, সব চলছে। তাৎক্ষণিক পরিষেবারও সুবন্দোবস্ত। পাশাপাশি দোকানে বিক্রেতাদের রেষারেষি, ডিসকাউন্ট, লোভনীয় অফার সব রয়েছে। ঘড়ির কাঁটা তখন সবে বেলা ন’টার ঘরে। মাকালতলায় ঢুকতেই দোকান থেকে বেরিয়ে পথ আগলে দাঁড়ানো যুবকের নাছোড় আবদার, “দাদা আমার মাল একদম আসল। ডিসকাউন্টও পাবেন। ১০০ পুরিয়া নিলে পাঁচ পুরিয়া ফ্রি!”
মাদকের খুচরো কারবারি বলে পরিচয় দিয়ে দোকানের ভিতরে বসা গেল। আলিম (নাম পরিবর্তিত) নামের মাদক-বিক্রেতা যুবককে বললাম, “বড়বাজারে ব্যবসা করি। এখন ‘স্যাম্পেল’ নিতে এসেছি। কলকাতায় গিয়ে যাচাই করে তবেই ফের আসব! মাল এক নম্বরি হলে কোটি টাকার ব্যবসা করব।” আলিমের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ কথার মধ্যেই চলে এল দু’টি পুরিয়া। আলিম বলেন, “চিন্তা নেই দাদা, কেউ কিচ্ছু করবে না।”
আলিমের সঙ্গী হয়ে এর পরে মাদক-বাজারের অলি-গলিতে সফর। কোনও কোনও দোকানে কেনার পরে মাদকের ধোঁয়া নাকে নেওয়ারও ব্যবস্থা। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদকসেবনও চলছে। তবে এই ঠেকগুলো পিচরাস্তা থেকে একট ভেতরে, খালের ধারে। বাঁশের জঙ্গল পেরিয়ে এমন এক ঠেকে ঢুকতেই দেখি, ওই সকালেই জমাটি মৌতাত। ধোঁয়ার কুণ্ডলি। ঝাঁঝালো গন্ধ। তার মধ্যেই দেখি, বার্ড ফ্লু-র মুরগির মতো চোখ উল্টে কাঁপছে সিড়িঙ্গে চেহারার ক’জন মাদকাসক্ত। তাঁদের দিকে তাকিয়ে আলিম বলে, “এ বার ওঠ্! তোদের টাইম শেষ!” আলিমের ব্যাখ্যা, মাদক কেনার পরে আর পাঁচ টাকা দিলেই ঠেকে বসে নেশা করতে পারবেন! ঝুটঝামেলা নেই।
প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রীতিমতো মাদকের মেলা বসে ঘুটিয়ারি শরিফ মাজার থেকে সামান্য দূরের এই খালধারে। তখন ডিসকাউন্টে মাদক কেনার অফার থাকে। নেশায় বুঁদ হয়ে রাতে মাঠেই পড়ে থাকে অনেকে। আলিম হাসতে-হাসতেই বলে, “কলকাতার কলেজের ছেলেপুলে থেকে সরকারি কর্মী সব ধরনের লোকই আসে এখানে!”
রাস্তার পাশে কয়েকটি কারখানাও চোখে পড়ল। তবে সেগুলির লোহার বড় বড় দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। স্থানীয় লোকজন বললেন, মাকালতলা গ্রামে বাড়ির মেয়েরাও পুরিয়া তৈরিতে হাত লাগান। কী ভাবে তৈরি হয় পুরিয়া? হেরোইনের গুঁড়োয় একটা ছুঁচ ঢোকানো হয়। সেই ছুঁচের গায়ে যতটা হেরোইন উঠে আসে, তা রাংতা কাগজে ঝেড়ে ফেলে তৈরি হয় এক একটি পুরিয়া। একটি পুরিয়া তৈরির মজুরি তিন টাকা।
মুর্শিদাবাদে লালগোলার মাদক-ঠেকেরই আগে বেশি নাম-ডাক ছিল। সেখান থেকে হেরোইন নিয়ে এসে মাকালতলায় বিক্রি-বাট্টা চলত। গত দু’বছরে উঠে এসেছে মাকালতলা। বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে হেরোইন, ব্রাউন সুগার, চরস আমদানি ছাড়াও পশ্চিম ভারত বা পাকিস্তান থেকে আনা মাদক, পোস্তর খোলও সড়কপথে ঘুঁটিয়ারি শরিফ পৌঁছয়। দিনে অন্তত কোটি টাকার কারবার।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের এক কর্তার অবশ্য দাবি, “মাদক পাচার ঠেকাতে মাঝেমধ্যেই অভিযান হয়, ধরপাকড় চলে।” কিন্তু এলাকায় পুলিশি টহলদারি কই? সদুত্তর
মেলেনি পুলিশকর্তার কাছে। স্থানীয় নারায়ণতলা পঞ্চায়েতের প্রধান সালাউদ্দিন সর্দার বলেন, “মাদক-বিরোধী প্রচার, সভাও করা হয়। প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।” কিন্তু পুলিশের একাংশই মেনে নেন, টাকার জোরে প্রভাবশালী মাদক কারবারিরাই শেষ কথা বলে।
মাকালতলা থেকে বেরনোর আগে ভরসা দেয় আলিম, “নিশ্চিন্তে থাকুন! সব দায়-দায়িত্ব আমাদের।”





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.