দূর থেকে দ্রিম দ্রিম শব্দটা ভেসে আসছিল। মাদলের নয়, ধামসারও নয়। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের এক সকালে বীরভূমের নানুরের দেবানন্দপুর গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছিলাম আমরা কয়েক জন। ঘোরার সময়ে ওই শব্দটা কানে গিয়ে পৌঁছনো ইস্তক তার উৎসে পৌঁছনোর জন্য মনের ভিতর থেকে তাগাদা আসছিল। কিছুটা এগিয়ে বুঝলাম ধামসা মাদলের সঙ্গে যে কাড়া বাজে, শব্দটা তারই। সঙ্গে শোনা গেল ঘুঙুরের শব্দ। কেউ যেন গান গাইছে। সঙ্গত করছে কাড়ানাকাড়া এবং ঘুঙুর।
গ্রামের অন্য প্রান্তে পৌঁছে রহস্যটা ফাঁস হল। রংবেরঙের পালক সাঁটা টুপি পরা এক মাঝবয়সী সাঁওতাল পুরুষ গান গাইছিলেন। এক হাতে ধরা একটি পাকানো লাঠি। সেই লাঠির উপরে একটা গোলাকার প্ল্যাটফর্ম। তাতে গোলাকার ভাবে সাজানো বেশ কয়েকটি কাঠের পুতুল। রংবেরঙের ওই পুতুল-মেয়েরা সার দিয়ে একে অন্যের কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। কেউ আবার ঢেঁকি ভাঙছেন। পুরুষেরা মাঠে লাঙল দিচ্ছেন। গায়ক গান গাইছেন। পাশে এক জন কাড়া বাজিয়ে সঙ্গত দিচ্ছেন। গানের তালে পুতুলরা একসঙ্গে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। |
গোলাকার কাঠের প্ল্যাটফর্মের নীচটা কাপড় দিয়ে ঘেরা। গায়কের হাতটা ওই কাপড়ের নীচে ঢোকানো। আসলে প্রতিটি পুতুলের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে তার। সেই সব তার প্ল্যাটফর্মের নীচে একাধিক লিভারের সঙ্গে যুক্ত। লিভারের থেকে বেরিয়েছে একাধিক তার। তার বাঁধা রয়েছে গায়কের আঙুলের সঙ্গে। গানের তালে তালে কাপড়ের ভিতরে থাকা হাতের আঙুলগুলি নাড়াচ্ছেন গায়ক। তাতেই নানা ভঙ্গিমায় নাচছে পুতুল। অনেক ধরনের পুতুলনাচের কথা পড়েছি। কিন্তু এই নাচটা অপরিচিতই ঠেকল চোখে। পুতুলগুলির নাম চদরবদর। খোঁজ নিয়ে জানলাম সাঁওতাল আদিবাসীরা গ্রামে গ্রামে সামাজিক বার্তা পৌঁছে দিতে এই চদরবদর পুতুলের সাহায্য নিতেন। সেই ঐতিহ্য এখনও চলছে।
ঝাড়খণ্ডের দুমকা আর এ বাংলার বীরভূম, বর্ধমান ও বাঁকুড়ার হাতে গোনা ক’জন শিল্পী এখনও চদরবদর পুতুল নিয়ে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়ান আর খরা বন্যার মোকাবিলা কী ভাবে করতে হয়, বাল্য বিবাহ কেন খারাপ, সে বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। বীরভূমের সুকল মারডি যে গানটা গাইছিলেন তার কিছু কথা বুঝতে পারছিলাম: নদীর ধার, ধান, বান, তেঁতুল, আম, বৃষ্টি, চোখের জল... পুরোটা বোঝাতে এগিয়ে এলেন সুকল হেমব্রম। দেবানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান। গানের মর্মার্থ, এ বার আম এবং তেঁতুল খুব ভাল হয়েছে, অর্থাৎ এ বার ভাল বর্ষা হবে। নদীর ধারে তাই ভুলেও ধান রুইবে না। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হবে, নদীর বানে ভেসে যাবে সব ফসল। তখন চোখের জল শেষ হবে না।
অন্য পুতুলনাচের থেকে চদরবদরের আর এক পার্থক্যও রয়েছে। এই নাচ দেখানোর জন্য কোনও মঞ্চ তৈরি করতে হয় না। অনেক লোকেরও দরকার নেই। দু’জন থাকলেই গোটা নাচটা সবাইকে দেখানো যায়। এ সব ক্ষেত্রে গীত রচনা করেন কে? সুকল যে গান গাইছিলেন তা লেখা তাঁর প্রতিবেশী সোম মারডি-র। সোম গান লেখেন, তাতে সুর দেন। জনপ্রিয় লোকগাথার সুরই সাধারণত ব্যবহার করা হয়। তা মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করে। সুকল তাঁর পুতুল নিয়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গান। পুতুলগুলি নাচে। নাচগানের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে যায় নানা ধরনের সামাজিক বার্তা। হাটে বাজারে মেলায় সুকলকে দেখা যায় হামেশাই।
সুকলের ঝুলিতে বিয়ের গানও আছে। অনেকটা ধামাইল গানের মতো। তাই মাঝেমধ্যেই বিয়ের আসরে ডাক পড়ে। মাথায় পালক আর প্লাস্টিকের ফুল গোঁজা পাগড়ি পরে, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে বাঁশের সঙ্গে লাগানো পুতুলের প্ল্যাটফর্ম নিয়ে সুকল বেরিয়ে পড়েন। বিয়েবাড়িতে আসা মানুষজন গান শোনেন। পুতুলনাচ দেখেন। খুশি হয়ে পুরস্কারও দেন কেউ কেউ। সুকল বলেন, ‘চাষবাস করতে আর সায় পাই না মন থেকে, পুতুলগুলিই আমার প্রাণ।’
কী কী লাগে গোটা পরিকাঠামোটা তৈরি করতে? সুকল বলেন, ‘আমরা তো বাড়িতেই পুতুলগুলি বানাই। আমার গানে কথা যেমন থাকে, তার সঙ্গে মিলিয়েই তৈরি হয় পুতুল। পুতুলের পোশাক। তাদের অঙ্গভঙ্গি কেমন হবে, সেই হিসেবে লোহার ছোট রড, তার সংগ্রহ করতে হয়। বাড়ির সবাই হাত মিলিয়ে তৈরি করি পুতুল ও তার প্ল্যাটফর্ম।” পুতুল তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয় কাঠ আর বাঁশ। পুতুলগুলি সাধারণত পাঁচ থেকে ন’ইঞ্চি লম্বা হয়। তবে একটি পুতুলের উচ্চতা হয় তুলনায় বড়। সেটিই কথক ঠাকুর। গানের মাধ্যমে পুরো গল্পটি যেন সে-ই বলছে। অন্যেরা গল্পের কাহিনি মাফিক এ দিক ও দিক নড়ছে।
চদরবদর ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীপ্রধান এলাকার পুরনো সংস্কৃতির অঙ্গ হলেও ১৯৮৫ সালের আগে এলাকার বাইরে তার কথা বিশেষ জানা ছিল না। শান্তিনিকেতনের কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্র রবিকান্ত দ্বিবেদী দুমকায় গিয়ে এক রকম হঠাৎ করেই চদরবদর পুতুল নাচ দেখেন। মূলত তাঁর উদ্যোগেই দুমকার ওই শিল্পীদের দিয়ে সাঁওতালদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয় কলাভবনে। ছয় যুবক প্রশিক্ষণ পেয়ে এখন মানুষের কাছে সামাজিক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। অন্যদেরও শেখাচ্ছেন।
এই পুতুলনাচ কত দিনের পুরনো? রবিকান্ত দ্বিবেদীর মতো গবেষকরা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্য বিশেষ নেই। যেটুকু যা জানা গিয়েছে, শিল্পীদের কাছ থেকেই। যেমন আমরা দ্বারস্থ হয়েছিলাম সোমরা মুর্মুর।
তবে ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কের লেখা সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামে সাঁওতাল পরগনা জুড়ে চদরবদর পুতুলের একটা বড় ভূমিকা ছিল। পুতুল-নাচিয়েরা গ্রামেগঞ্জে সিধো-কান্হোর বীরগাথা গান গেয়ে প্রচার করতেন। পুতুল তৈরি হত ইংরেজ শাসক, সাঁওতাল জনগোষ্ঠী, সিধো ও কান্হোর আদলে। ধীরেন্দ্রনাথবাবু লিখেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে সাঁওতালদের অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে চদরবদর পুতুলের ভূমিকার কথা ব্রিটিশ শাসকরাও জানতেন।
প্রবীণ গবেষক পশুপতি মাহাতো বলেন, আদিবাসী মানুষের কাছে ১ মাঘ হল নতুন বছরের শুরু। ওই দিনটায় মাঠে প্রতীকী চাষ শুরু করেন আদিবাসী মানুষেরা। ওই দিনটি উদযাপনের আগে মানুষকে আনন্দ দিতে বিভিন্ন এলাকায় চদরবদর নাচের প্রথা চালু আছে।
চদবদর পুতুল নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে নানা প্রয়াস চলছে, তার কথা সুকল মারডি জানেন না। কলকাতায় এক প্রদর্শনীতে সম্প্রতি সুকলকে স্টেজে তুলে দেওয়া হয়েছিল। সামনে মাইক। সুকল গান শেষ না করেই নেমে এলেন। বললেন, ‘আমরা মাঠে ঘাটে জঙ্গলে এই গান গাই, পুতুলের নাচ দেখাই। ওই পরিবেশ ছাড়া গলায় সুরই আসে না।’ |