|
|
|
|
ভোট রসায়ন বদলাতেই রাজনাথের মুখে ‘ক্ষমা’
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • নয়াদিল্লি
২৬ ফেব্রুয়ারি |
দাঙ্গার জন্য আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। হৃদয়ের যন্ত্রণা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বিরোধীদের দাবি মেনে কখনও ক্ষমা চাননি নরেন্দ্র মোদী। সে লক্ষ্যে এক ধাপ এগোলেন রাজনাথ সিংহ। কৌশলে। সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে বিজেপি সভাপতি বললেন, “কোথাও কোনও ভুল হয়ে থাকলে মাথা নুইয়ে ক্ষমা চেয়ে নেব।” ভোটের মুখে এই একটি মন্তব্যে এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চাইছেন রাজনাথ। আজই গাঁধীনগরে এক সভায় মোদী বলেছেন, “রাজনীতির অনেক পণ্ডিতই এখন ভোটের ফল নিয়ে হিসেবনিকেশ করছেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত, এ বারের ভোটটা অঙ্কের হিসেবে নয়, হবে রসায়নের ভিত্তিতে।” বস্তুত সংখ্যালঘু ও উদার হিন্দুদের মন জয় থেকে শুরু করে ভবিষ্যতে শরিক পাওয়ার রাস্তা সুগম করা ভোট রসায়নে এমন অনেকগুলি বদল আনার লক্ষ্যেই রাজনাথের মুখে ক্ষমা চাওয়ার কথা উঠে আসছে।
সংখ্যালঘুদের মন জয়ের চেষ্টা অনেক দিন ধরেই করে যাচ্ছেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। সম্প্রতি ক্লিনচিটও পেয়েছেন আদালত থেকে। কিন্তু বিরোধীরা বারবার দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলেই মোদীকে রাজনৈতিক ভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। মোদীকে ক্ষমা চাইতে বলছেন। বিজেপি সূত্রের মতে, ভোটের আগে সংখ্যালঘুদের পাশে পাওয়ার জন্য মোদী তেমন কোনও পদক্ষেপ করতেই পারেন। দলের সভাপতি আগেভাগেই তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখলেন।
দুই, মোদী তাঁর সব প্রচারে এই অবস্থান নিচ্ছেন যে, তাঁর উন্নয়নের মডেলে সকলেই শরিক। সেখানে হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই। গত কাল রাজধানীতে তাঁকে নিয়ে ‘মোদীত্ব’ নামে যে বই প্রকাশিত হয়েছে, তার প্রথম অধ্যায়টিতেও রয়েছে মোদীর ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনা। তা সত্ত্বেও সনিয়া ও রাহুল গাঁধী থেকে শুরু করে লালুপ্রসাদ, প্রকাশ কারাটরা যে ভাবে জোট বাঁধছেন মোদীর বিরুদ্ধে, তা মোকাবিলার দায়ও নিজের কাঁধে তুলে নিলেন দলের সভাপতি।
তিন, ভোটের পর সরকার গড়তে আরও শরিক প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু মোদীর নামে অনেক দলই বিজেপি-র কাছে ঘেঁষতে নারাজ। আসন সমঝোতা নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনায় খুশি হতে না পেরে রামবিলাস পাসোয়ান অবশ্য এখন বিজেপি-র হাত ধরতে আদালতের ক্লিনচিটকে বড় করে দেখাচ্ছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে আরও শরিককে সঙ্গে পাওয়া যায়, তার জন্য সংখ্যালঘুদের কাছে বার্তা এখন থেকেই দিয়ে রাখতে চাইছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
চার, বিজেপি খুব বেশি সংখ্যালঘু ভোট প্রত্যাশা করে না। তবু মোদী চান না, তাঁর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুরা এককাট্টা হয়ে উঠুন। এর প্রভাব পড়তে পারে নির্বাচনেও। তাই সদর্থক বার্তা দিয়ে বিজেপি সেই কট্টর মনোভাবটিও লঘু করতে চায়। যে সব হিন্দু কট্টর হিন্দুত্বকে পছন্দ করেন না, রাজনাথের বার্তা তাঁদের প্রতিও।
পাঁচ, শুধু বিজেপি নয়, আরএসএস-এর মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চও নিরন্তর সংখ্যালঘুদের মধ্যে বৈঠক করে মোদী-আতঙ্ক কাটানোর চেষ্টা করছে। এই মঞ্চের প্রধান গিরীশ জুয়াল বলেন, “গোটা দেশে আড়াই হাজারের বেশি বৈঠক করে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করছি, অন্য সব দল শুধু ভোটব্যাঙ্ক হিসেবেই দেখছে তাঁদের। অথচ গুজরাতে মোদীর উন্নয়নের সুফল পাচ্ছেন সংখ্যালঘুরাও। বিরোধীরা যে মোদী-আতঙ্ক তৈরি করছেন, তা অনেকটাই কাটানো সম্ভব হয়েছে।” রাজনাথ সেই লক্ষ্যেই আরও এক ধাপ এগোনোর চেষ্টা করলেন।
সঙ্ঘ নেতৃত্বের দাবি, আরএসএস কখনওই মুসলিম-বিরোধী নয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য নিয়ে অখণ্ড ভারতের কথাই বলা হয়। মোদীর কৌশল রচনার অন্যতম কারিগর অরুণ জেটলি বলেন, “সংখ্যালঘুদের কাছে এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত, মোদী-জমানাতেই গত দশ বছর দাঙ্গামুক্ত রয়েছে গুজরাত। আর কোনও দল দাঙ্গা ঠেকাতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী হলে মোদী দেশকে দাঙ্গামুক্ত বানাবেন। বিজেপি-তেও এখন সংখ্যালঘুরা ভোটে জিতছেন। যাঁরা অহেতুক বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, সংখ্যালঘুরা নিশ্চয়ই তাঁদের ফাঁদে পা দেবেন না।”
নিজের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা অনেক দিন ধরেই করছেন মোদী। গুজরাতে মুসলিমদের টিকিট দিয়েছেন। সম্প্রতি সলমন খানকে পাশে নিয়ে বলিয়েছেন, দাঙ্গার জন্য মোদীর ক্ষমা চাওয়ার দরকার নেই। একই লক্ষ্যে ‘সদ্ভাবনা মিশন’ করে অনশনও করেছেন তিনি। কিন্তু সেখানে ভুল কবুলের সুর থাকলেও সরাসরি ক্ষমা চাননি। উল্টে বিতর্ক বেড়েছে এক মুসলিমের হাত থেকে টুপি না পরা নিয়ে। এক সাক্ষাৎকারে মুসলিমদের সঙ্গে কুকুর ছানার তুলনা টানাতেও কম শোরগোল হয়নি। রাজনাথও বলে আসছিলেন, মোদী যখন কোনও ভুলই করেননি, তা হলে ক্ষমা চাইবেন কেন? ক্লিনচিটের পর মোদী যে সুদীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছিলেন, তাতেও কোথাও ক্ষমা শব্দটি তিনি ব্যবহার করেননি। কিন্তু ভোটের আগে বিজেপি নেতৃত্ব বুঝছেন, সংখ্যালঘুদের একটা বার্তা দেওয়া জরুরি।
তার জন্যই রাজনাথ এমন কৌশল নিলেন, যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। জানালেন, যদি ভুল হয়ে থাকে, তা হলে ক্ষমা চাইবেন। যার অর্থ, এখনও কোনও ভুল হয়নি বলেই তিনি মনে করছেন। একই সঙ্গে সুকৌশলে সংখ্যালঘুদের বার্তাও দেওয়া হল। সাংবাদিক বৈঠক করে করে দলের সংখ্যালঘু মুখ শাহনওয়াজ হুসেন আজ সে কথাটা কবুলও করে ফেলেছেন।
বিজেপি-র এই দ্বিমুখী কৌশলকে ভেস্তে দিতে এ দিনই ময়দানে নেমে পড়েছে কংগ্রেস। গত কাল দাঙ্গা রুখতে মোদী ব্যর্থ, এই অভিযোগ করতে গিয়ে সলমন খুরশিদ অপশব্দ ব্যবহার করেছিলেন। আজ তিনি ফের বলেন, “রাজনাথ সিংহ কেন মোদীর হয়ে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলছেন? আর কোন বিষয়ে মোদী বা রাজনাথকে ক্ষমা চাইতে হবে, সেটা কী তাঁরা বোঝেন না? এতটা অবোধ তো তাঁরা নন!” |
|
|
|
|
|