ঘুপচি ঘরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘাড় গুঁজে কাজ করতে অভ্যস্ত বাঙালি স্বর্ণশিল্পীদের জন্য আধুনিক পরিকাঠামো শেষমেশ হল ঠিকই। তবে বাংলায় নয়, তামিলনাড়ুর হোসুরে। অনেক আগে, সেই বাম আমলে, এ ধরনের আধুনিক, উন্নত পরিকাঠামো গড়ার কথা ভেবেছিল পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু তা পড়ে রইল ঠান্ডা ঘরেই। বরং বহু পরে ভাবা শুরু করেও আগে তা করে দেখাল দক্ষিণী রাজ্যটি।
হোসুরে গয়নার কারিগরদের কাজ করার জন্য ঝাঁ-চকচকে, আধুনিক পরিকাঠামো গড়েছে টাটা গোষ্ঠীর সংস্থা টাইটান, তানিস্ক ব্র্যান্ডের দৌলতে যারা দেশের গয়না শিল্পে প্রথম সারির সংস্থা। এখানে স্বর্ণশিল্পীদের অধিকাংশই বাঙালি। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এ কথা ঠিকই যে, এই পরিকাঠামো একান্ত ভাবেই বেসরকারি উদ্যোগে গড়া। কিন্তু জমি পাওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রশাসনিক অনুমোদন সব কিছু দ্রুত না-হলে প্রকল্প শেষ করা যে-কোনও বেসরকারি সংস্থার পক্ষে শক্ত। এ ক্ষেত্রে তামিলনাড়ু সরকার নিশ্চয়ই তা জুগিয়েছে। অথচ অনেক আগে (বাম আমলে) এ রাজ্যে বেলঘরিয়ায় বন্ধ হয়ে যাওয়া মোহিনী মিলের ৭৬ বিঘা জমিতে এ ধরনের পরিকাঠামো গড়ার প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু তা আবার নাকচও হয়ে গিয়েছিল বাম আমলেই। তৃণমূল সরকার এসেও তা নিয়ে উদ্যোগী হয়নি। উদ্যোগ দেখা যায়নি দেশে সোনার গয়না তৈরির ‘মক্কা’ মুম্বইয়েও। |
টাইটানের নতুন কারিগর কেন্দ্র। |
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, পশ্চিমবঙ্গে ওই প্রকল্প দিনের আলো দেখলে তৈরি হত প্রায় ৪০০০ কারখানা। থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত থাকত স্বর্ণশিল্পীদের। বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক টগর চন্দ্র পোদ্দারের দাবি, সেখানে কাজের সুযোগ পেতেন প্রায় ৩০ হাজার স্বর্ণশিল্পী। যদিও তিনি এবং পশ্চিমবঙ্গ স্বর্ণশিল্প বাঁচাও কমিটির কার্যকরী সভাপতি বাবলু দে মনে করেন, কারিগরদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও আধুনিক প্রযুক্তি জরুরি ঠিকই। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি বড় সংস্থা ছাড়া আর কারও পক্ষে এ ধরনের পরিকাঠামো গড়া মুশকিল। এ বিষয়ে তাঁদের যুক্তি, কলকাতায় অধিকাংশ স্বর্ণশিল্পীই স্বনিযুক্তির মাধ্যমে একাধিক সংস্থার জন্য গয়না তৈরিতে যুক্ত। তা হলে তাঁদের জন্য পরিকাঠামো গড়বে কে? তবে সরকারি প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এই ব্যবসা এখনও হস্তশিল্পের মর্যাদা না-পাওয়ায় ক্ষুব্ধ তাঁরা। ক্ষুব্ধ আইটিআই-তে আধুনিক প্রশিক্ষণ চালু না-হওয়াতেও।
দেশে দক্ষ বাঙালি গয়না কারিগরের সংখ্যা কয়েক কোটি। পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের বেশিরভাগকেই কাজ করতে হয় ছোট ঘরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। সেখানেই কাজের মাঝে খাওয়া, রাতের ঘুমও। গ্যাসের গন্ধে স্বাস্থ্যহানি। ফলে অনেকের কাজে যবনিকা পড়ে যায় মাঝবয়সেই। প্রায় একই ছবি মুম্বইয়েও। শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতার খাতিরে নয়, নিখাদ ব্যবসার বাধ্যবাধকতা থেকেও এই ছবিটা বদলাতে চেয়েছিল টাইটান। সংস্থার এমডি ভাস্কর ভট্ট এবং সিইও সি কে বেঙ্কটরামনের মতে, দক্ষ মানবসম্পদ জুগিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কথা এই শিল্পকেই আগে ভাবতে হবে। সে কথা মাথায় রেখেই নজির হিসেবে এই পরিকাঠামো গড়ায় উদ্যোগী হয়েছিলেন তাঁরা। যাতে বাকিরাও এগিয়ে আসে।
হোসুরে নিজস্ব কারখানায় ছাড়াও একাধিক সহযোগী সংস্থাকে দিয়ে গয়না তৈরি করায় টাইটান। সেখানে এমন ৪টি সহযোগী সংস্থার স্বর্ণশিল্পীদের জন্য ৪টি কারিগর কেন্দ্র গড়েছে তারা। এক একটিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। মাটিতে নয়, সেখানে উঁচু ডেস্কে বসে কাজ করবেন স্বর্ণশিল্পীরা। থাকবে আধুনিক যন্ত্রপাতি, থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত। মিলবে বাঙালি খাবারও। কর্তাদের দাবি, এই পরিবেশে স্বর্ণশিল্পীদের উৎপাদনশীলতা ও আয়, দুই-ই বাড়বে। একই সঙ্গে তাঁদের দাবি, চিরাচরিত ব্যবস্থায় গয়না তৈরি করতে গ্রাম-প্রতি প্রায় ১% সোনা নষ্ট হয়। কিন্তু এই আধুনিক পরিকাঠামোয় তা হবে মাত্র ০.২%। অপচয় কমলে শিল্প ও শিল্পী উভয়েই উপকৃত হবেন।
এই কারিগর কেন্দ্র গড়ার ঠিক আগে সংস্থা তৈরি করেছিল আধুনিক পরিকাঠামো সমৃদ্ধ কারিগর পার্ক। তার দৌলতেও নিজেদের আয় কয়েক গুণ বাড়ার কথা জানালেন সেখানে কর্মরত সুকুমার সেনাপতি, নব বর, প্রফুল্ল মাঝির মতো এ রাজ্য থেকে যাওয়া স্বর্ণশিল্পীরা। পরিচিত স্বর্ণশিল্পীদের হাত ধরে সেখানে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দেওয়া তারকেশ্বরের হেমন্ত পোড়েল, রঞ্জিৎ রায়রাও আয় বৃদ্ধির বিষয়ে আশাবাদী।
কলকাতার সহযোগী সংস্থাগুলিও যাতে কাজের পরিবেশে উন্নতি আনে, সেই লক্ষ্যে সম্প্রতি একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল টাইটান। আগামী দিনে এ রাজ্যেও কারিগর কেন্দ্রের মতো পরিকাঠামো গড়তে আগ্রহী তারা। হাওড়ার অঙ্কুরহাটিতে ৬ একর জমিতে জেম অ্যান্ড জুয়েলারি পার্ক তৈরি করছে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম। সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, সেখানেই জায়গা নেওয়ার কথা ভাবছে সংস্থাটি।
অবশ্য বাবলুবাবুর মতে, এই পরিকাঠামো গড়ার দায় কেন্দ্র-রাজ্য উভয়েরই। তাঁর দাবি, শিল্পগুচ্ছের (ক্লাস্টার) মাধ্যমে পরিকাঠামো গড়ে স্বনিযুক্ত শিল্পীদের অল্প ঋণে তা বরাদ্দ করতে হবে। এ জন্য খাস কলকাতায় দু’টি সরকারি জমি চিহ্নিত করে তাঁরা রাজ্যের কাছে সেই প্রস্তাব দিয়েছেন। ভবিষ্যতে জেলাতেও একই ব্যবস্থা গড়া দরকার বলে তাঁর অভিমত। |