অমিত মিত্রের বাজেট আর তা নিয়ে নানান চাপান-উতোর শুনতে শুনতে নেপোলিয়নের কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক দুশো বছর আগে সম্রাট নির্বাসিত হয়েছিলেন এলবায়। এলবা একটা দ্বীপ। ইতালির টাসকানির তীররেখা থেকে সমুদ্রপথে কুড়ি কিলোমিটার। আজকের হিসাবে ত্রিশ হাজার লোকের বাস। ১৮১৪ সালে সেখানে নেপোলিয়নের নির্বাসন হল, কর আদায়ের অধিকার সহ। কিন্তু ওইটুকু দ্বীপের মানুষের কর দেওয়ার ক্ষমতা কতটুকু! সে টাকায় সম্রাটের দিন চলবে না। অবসরভাতারও ব্যবস্থা হয়েছিল বটে, কিন্তু বছর ঘুরে গেলেও মিত্রশক্তির কাছ থেকে একটা পয়সাও রাজকোষাগারে এল না। নেপোলিয়নের ঈগল তাই আবার উড়ল ইউরোপের আকাশে। এটা ঠিকই, যথেষ্ট রাজস্ব এবং ভাতা মিললেও যে নেপোলিয়ন হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু আর্থিক চাপে প্রত্যাঘাতটা ত্বরান্বিত হয়েছিল।
অমিত মিত্র বা তাঁর মুখ্যমন্ত্রী কেউই ঠিক নেপোলিয়ন নন। যুগও বদলেছে। ঘোড়ার পিঠে উঠে ‘চল দিল্লি’ ডাক দেওয়া আজ সম্ভব নয়। কিন্তু যথেষ্ট কর এবং ভাতা নেই বলে পশ্চিমবঙ্গের সরকার কেন্দ্রের বিরুদ্ধে উষ্মা পোষণ করলে সেটা মোটেই অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক বলা যাবে না। দেশের কর ব্যবস্থা পরিচালনা সরকারের অন্যতম দায়। আমাদের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কোন রাজ্য রাজকোষের কতটা দায় নিল আর তার ফলে সে কী পেল তা নিয়ে যে তরজা চলবে তা তো স্বাভাবিকই। এটাও মানতে হবে যে, স্বাধীনতার পর থেকে, কিছুটা রাজনৈতিক কারণেই, পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীয় কোষাগারের বদান্যতায় নানাভাবে বঞ্চিতই থেকেছে। এই নিয়ে আগে বামফ্রন্ট আর আজ তৃণমূল প্রতিবাদে সরব। অন্য দিকে, যোজনা খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ অন্য রাজ্যের তুলনায় এই রাজ্যে কতটা দক্ষ ভাবে খরচ করা হয়েছে, সেটাও বড় বিতর্কের জায়গা হিসাবে থেকেই গিয়েছে। |
রাজনীতির খেলায় হোক বা অন্য কারণে, আরও দু’একটি রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গের কোষাগার বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ফলে চাপে থেকেছে। যেমন ১৯৯৮-৯৯ সালে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের দায় নিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত। ক্ষুদ্র সঞ্চয় সরকারের কাছে ঋণ। ঋণ বলেই সরকার আমাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ওপর সুদ দেয়। সুতরাং ক্ষুদ্র সঞ্চয় বাড়লে সরকারের সুদ মেটানোর দায়ও বাড়ে। এখন, ১৯৯৮-৯৯ সালে কেন্দ্রের রাজকোষ ঘাটতি পাহাড়প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের খাতায় ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন ব্যবস্থা চালু করে, যাতে রাজ্যের ঘাড়ে ক্ষুদ্র সঞ্চয় বাবদ ঋণের দায় বাড়ে। ১৯৯০-৯১ সালে ক্ষুদ্র সঞ্চয় বাবদ দায় ছিল কেন্দ্রের বাজেটের মোট ঋণের দায়ের ৫ শতাংশের মতো। ১৯৯৮-৯৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশে। নতুন বিন্যাসে এক বছরে বাদেই, ২০০০-০১ সালে, কেন্দ্রের এই দায় কমে দাঁড়াল ৭ শতাংশ।
পাশাপাশি, রাজ্যের খাতায় ক্ষুদ্র সঞ্চয় বাবদ ঋণের দায় বাড়ল। ১৯৯০-৯১ সালে যা ছিল ২৮.৬ শতাংশ, ২০০০-০১ সালে তা দাঁড়াল ৩৭.৪ শতাংশ। যে রাজ্যে ক্ষুদ্র সঞ্চয় সংগ্রহ বেশি, স্বভাবতই সেই রাজ্যের বেশি ক্ষতি হল। আর এই সারণিতে যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ অগ্রগণ্য, তাই পশ্চিমবঙ্গের ঋণের বোঝাও অনেক বাড়ল।
ঋণের বোঝা বাড়লে তা সামলানোর সদুপায় একটাই: আয় বাড়ানো। কিন্তু রাজ্যে যথেষ্ট বড় শিল্প না হলে আয় বাড়বে কী ভাবে? নেপোলিয়নের এলবা ছিল মূলত মৎস্যজীবীদের দ্বীপ। তিনি একই পেশার উপর কর বসিয়ে কতটাই বা এগোতে পারতেন? পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও মূলত একই কথা প্রযোজ্য। অসীম দাশগুপ্তই হোন আর অমিত মিত্রই হোন, ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ক্ষেত্রে কর বসিয়ে রাজ্যের ভাঁড়ারে কতটুকু রসদ আনতে পারেন?
এখানেই আসে কর ব্যবস্থার কথা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের (এ ডি বি) হিসাবে রাজ্যের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কর আদায়ের সুযোগই হারিয়ে যায় লালফিতের ফাঁসে। রাজ্যের বর্তমান অর্থমন্ত্রী একেই অস্ত্র করে এগোনোর রাস্তা খুঁজেছেন এই বাজেটে। দেশের বাজারের দুরবস্থা সত্ত্বেও তাঁর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ করতে এই ফাঁকটাকেই ধরেছেন তিনি। নতুন কর বসিয়ে টাকার ব্যবস্থা করার সুযোগ সীমিত। নতুন বড় শিল্পেরও দেখা নেই। তাই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরাসরি করদাতাদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার রাস্তাটাই বেছে নিয়েছেন অমিতবাবু।
কিন্তু খরচের লাগাম তাঁর হাতে নেই। আয়ের টাকা তাঁকে ভাগ করে দিতে হয় প্রশাসনিক ও দলীয় স্বার্থে। এখানেই আসে নৈতিক ও প্রশাসনিক প্রশ্ন। সরকারের টাকা ব্যবহার হওয়া উচিত প্রধানত উন্নয়নের স্বার্থে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এক টাকা আয় হলে ৯০ পয়সার মতো খরচ হয়ে যায় প্রশাসনিক খরচ ও ঋণ শোধের দায়ে। ফলে উন্নয়নের সংস্থানে টান পড়ে।
পাশাপাশি আর একটা ব্যাপার ঘটেছে এ বারের বাজেটে। যোজনা খাতে কেন্দ্রীয় অনুদানের টাকা কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিতে খরচের ব্যাপারে রাজ্যের ওপর কড়া রাশ ছিল। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে খরচ করার স্বাধিকার রাজ্যের ছিল না। এটা ছিল কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগের আর একটা জায়গা। পালানিয়াপ্পন চিদম্বরম তাঁর এ যাত্রার শেষ বাজেটে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গ্রামোন্নয়ন খাতে যোজনা বরাদ্দ খরচের এই অধিকার রাজ্যের হাতে তুলে দিয়েছেন। ভারতের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা এক বড় পদক্ষেপ। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, এটা পরবর্তী সরকারকে সমস্যায় ফেলার কৌশলও হতে পারে। মনে পড়ে, অসীম দাশগুপ্তের শেষ বাজেটে ফিসকাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট পশ্চিমবঙ্গে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্তেও এমন কৌশল দেখা হয়েছিল। খরচের উপর রাশ টেনে রাজকোষ ঘাটতিকে সামলানোর উদ্দেশ্যে ২০০৩ সালে কেন্দ্র এই আইন চালু করে। যে রাজ্য এই আইন চালু করবে, অনুদানের ক্ষেত্রে তাদের কিছু সুবিধা মিলবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার এই আইন চালু করতে চায়নি, অসীমবাবুদের যুক্তি ছিল রাজ্যের সরকারি বাজেটের কঠিন অবস্থায় এই আইন চালু করলে রাজকোষ সামলানো যাবে না। অথচ শেষ বাজেটে এই আইন চালু করে যান তাঁরা। স্বভাবতই অভিযোগ উঠেছিল, পরের সরকারের খরচ করার হাত-পা বেঁধে দিতেই এই সিদ্ধান্ত। এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। চিদম্বরমের ক্ষেত্রেও একই কথা। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে খরচের অধিকার রাজ্যের হাতে ছেড়ে দিলে রাজ্যের ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে, রাজনৈতিক কারণে বদান্যতা দেখানোর সুযোগ কমে যাবে, কেন্দ্রের খরচ করার সুযোগও সংকুচিত হবে, এই কারণেই তিনি পরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের পথে কাঁটা বিছিয়ে দিলেন অভিযোগটা শুনতে অপ্রিয় নিশ্চয়ই, কিন্তু অপ্রিয় মানেই যে মিথ্যা, এমন কথা তো শাস্ত্রে লেখেনি।
কিন্তু যে উদ্দেশ্যেই হোক, এটা ঘটনা যে, চিদম্বরম তাঁর শেষ বাজেটে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের রাশ হাল্কা করে দিয়েছেন। তাই রাজ্যের এখন কর্তব্য সেই পড়ে-পাওয়া স্বাধিকারের সদ্ব্যবহার করা। খাতায় কলমে নয়, বাস্তবে সেই রাস্তা করা যাতে গাড়ি চলবে, গ্রামের সেই সেতু যা মানুষ ব্যবহার করতে পারবেন, সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র যেখানে চিকিৎসা হবে বা সেই বিদ্যালয় যেখানে পড়াশোনা হবে। আর তা করতে যদি কিছু খরচ বাদ দিতে হয় তা করতে হবে সাধারণ রাজনৈতিক স্বার্থ ভুলে।
নেপোলিয়ন ছিলেন পরাভূত শক্তি, নিজের অধিকার রক্ষায় তাঁকে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল। কিন্তু বিপুল জনসমর্থনপুষ্ট এই সরকারের তো সে দায় নেই। সর্বভারতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে অন্যতম শক্তি হওয়া যদি লক্ষ্য হয়, তা ঘর এড়িয়ে করলে হবে না। চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে। |