প্রবন্ধ ১...
জাগিয়ে রেখেছেন উত্তরণের সম্ভাবনা
মুখ্যত, তাঁহার শিল্পকর্মে রেখার মাধুর্য, ড্রয়িং-এর অব্যর্থ ব্যঞ্জনা এবং কোথায় ড্রয়িং-ভাঙন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই তিন এখন যদিচ এক হয় নাই এবং এখনও রঙীন হয় নাই।
—কমলকুমার মজুমদার,
‘যোগেন চৌধুরীর চিত্রকলা’, ১৯৬৩


অর্ধ শতক আগে যে প্রদর্শনী উপলক্ষে কমলকুমার মজুমদার এই মন্তব্য করেন, সেটি ছিল অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ যোগেন চৌধুরীর প্রথম একক। আঁকতে আঁকতে কেটে গেল ছয় দশক, বয়স সদ্য পেরোল পঁচাত্তরের গণ্ডি। তাঁর সূচনাপর্ব থেকে সাম্প্রতিক কাজের ধারাবাহিক চিত্র-ইতিহাস এই মুহূর্তে সিমা গ্যালারিতে। কমলকুমারের ভাষায়, অনেক রাত্রি দাহ করার ফল।
অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে জন্ম যোগেন চৌধুরীর, দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে আসতে হল কলকাতার কলোনিতে। শিকড় কিন্তু থেকে গিয়েছিল অনেক গভীরে। গ্রামের আটচালায় থিয়েটারের ড্রপসিনে বাবা কালীয়দমনের ছবি এঁকেছিলেন, শখ করে দুর্গাপ্রতিমাও গড়তেন তিনি। প্রতিমার টানা টানা চোখ, কিংবা এক পাশ থেকে দেখা বাংলার পটের চোখ আজও তাঁর চিত্রিত অবয়বে যাবতীয় ব্যঙ্গ বিদ্রুপ বেদনা বিপর্যয় প্রতিবাদের মধ্যে অপলকে চেয়ে থাকে। তবে শুরুটা স্বাভাবিক ভাবেই মসৃণ ছিল না। সময়টাই তো ছিল টালমাটাল। আর্ট কলেজে পড়া নিয়েও সংশয় ছিল কোথাও। কলেজে খুব ভাল পরিবেশ, শৈলী-শিক্ষাও চমৎকার। কিন্তু শিল্প-বীক্ষা কোথায়? তাঁর ড্রইং শুরু থেকেই খুব জোরালো,প্রচুর স্কেচ করছেন, শিয়ালদহ স্টেশনে উদ্বাস্তুদের ভিড়, ছবি আঁকছেন তাঁদের। বিপর্যয়ের ছবি, অন্ধকারের ছবি। বাড়িতে তীব্র দারিদ্র, রাতে আলোর অভাব। নিউজপ্রিন্টে চারকোলে ছবি আঁকা, কালোর ভাগ তাতে বড্ড বেশি। অন্ধকার আর অস্থিরতা। নিরন্তর পথ খোঁজা চলছে, কী আঁকব কেন আঁকব। মানবশরীর অবশ্য তখন থেকেই গুরুত্ব পাচ্ছে ছবির পুরো জমিটা জুড়ে, কখনও বা শরীরের অংশবিশেষ। পৃথুল অবয়ব কিছুটা কিম্ভূত, গ্রটেস্ক-এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে এই পর্বেই, বিদেশ যাওয়ার আগে থেকেই।
দম্পতি। কলকাতা, ১৯৬৫।
দ্বিধা ছিল বিদেশ যাওয়া নিয়েও। ১৯৬৫-’৬৮ যোগেন চৌধুরী কাটালেন মূলত প্যারিস, শেষে লন্ডনে। অনেক দেখলেন, শিখলেন নানা কিছু। কিন্তু খুব ভাল লাগল না। কলোনি-জীবন থেকে সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশ, স্বদেশের রোদেজলে যে ভাবে বেড়ে উঠতে চাইছিলেন, গোছাতে-ছড়াতে চাইছিলেন নিজেকে, কোথাও থমকে গেল সেটা। প্যারিসকে মনে হল ‘শিল্পের চুল্লীতে ঝলসানো নগর/ তোমার মধ্যে এককণা আগ্নেয় ধাতুর সাক্ষাৎ আমি পাই নাই আজও।’ তবু চিত্রশৈলীর ভাঙাগড়া পেরিয়ে নিজস্ব চিত্রভাষা অর্জনের পথে এগনোর রাস্তাটা স্পষ্ট হচ্ছিল এই সময়ের ছবিতেই। অসুন্দর বেঢপ শরীর, বসে থাকা, শুয়ে থাকা, নগ্ন বা আংশিক আবৃত এর পর ঘুরে ফিরে ছুঁয়ে থাকবে তাঁর ছবি। অস্বস্তিতে ফেলবে, বিব্রত করবে, হয়তো বিকর্ষণও, তবু চোখ ফিরিয়ে চলে যাওয়া যাবে না।
দেশে ফিরেও ভাল লাগার কোনও কারণ ঘটল না। সংকট বড় তীব্র তখন। কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভাঙন, খাদ্যাভাব, নকশাল আন্দোলন দানা বাঁধছে। ১৯৬৮-’৭২ কাটল মাদ্রাজে, হ্যান্ডলুম বোর্ডের আর্ট ডিজাইনার হিসেবে। পথ খোঁজার অস্থিরতা থেকে বেরোতেই বোধহয় সে সময় অবচেতনের রহস্যময় কল্পজগতে ফেরা। প্রলয়পয়োধিজলে ভেসে থাকা মাছ লতাগুল্ম সাপ জড়িয়ে রইল তাঁকে কিছু দিন। তবে আস্তে আস্তে অবসাদ কাটে, নিজের কথা নিজের মতো করে বলার জমি তৈরি হয়। ‘সেই সময়ের ভাবনাগুলোই ছিল আমার শিকড়, যা থেকে খুঁজে পেয়েছি আমার নিজস্বতা।’ এই নিজস্বতা আরও বাঙ্ময় হল দিল্লি-প্রবাসে। ১৯৭২-’৮৭ রাষ্ট্রপতি ভবনের শিল্পসংগ্রহের কিউরেটর পদে ছিলেন যোগেন চৌধুরী। ক্ষয়ের তীব্রতা আরও স্থূল ভাবে দেখতে পেলেন। ‘অনেক নতুন নতুন মুখ, নতুন জীবন কাছ থেকে দেখা’-র সুযোগ পাওয়ায় ছবি আঁকার পরিপ্রেক্ষিতটাই অনেকটা বদলে গেল। রাজনীতি এল ছবিতে। দল মত নয়, নেতা থেকে বণিক থেকে পৌত্তলিকের যাপিত জীবন লক্ষ্য হল তাঁর বিদ্রুপের। মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না, হামাগুড়ি দিয়ে চলে। ভালবাসতে পারে না, জড়িয়ে থাকে হাস্যকর দাম্পত্যে। চালকুমড়োর অবয়বে ‘বুদ্ধিজীবী’, নানা রূপে ‘গণপতি’/‘গণেশ’, রাজনীতিকদের নিয়ে ছবির সিরিজ এক দিকে সময় ও সমাজ-সচেতন শিল্পীর ঝাঁকিদর্শন, আবার অন্য দিকে ‘সুন্দরী’, ‘দম্পতি’, ‘পুরুষ ও নারী’ আরও গভীর, আরও স্থায়ী, বার বার ফিরে আসা বিষয় হয়ে রইল তাঁর ছবিতে।
পরের প্রায় দুই দশকে শান্তিনিকেতন পর্বে জগৎ ও জীবনের প্রতি অসীম কৌতূহল ও মমতা কখনও কখনও যেন তাঁর বিকৃতি-বিদ্রূপের ধার কমিয়ে দিয়েছে, তিক্ততার সঙ্গে সঞ্চারিত হয়েছে প্রশান্তি, আনন্দ। তবে মানুষ, মানুষের শরীর নিরবচ্ছিন্ন ভাবে তাঁর ছবির কেন্দ্রে থেকে গিয়েছে। পশুশরীর তাঁকে আকর্ষণ করে না। হবেই তো, তিনি যে বড় সামাজিক। ‘শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে মানুষের শরীরের মতো এত সম্ভাবনাযুক্ত আর কোনো বিষয় আছে কি? শরীরকে সাবলীলভাবে দুমড়ে-মুচড়ে যেমন ভাঙা যায় শিল্পসৃষ্টির প্রয়োজনে এমনটা আর কিছুতে ঘটে না।’ ছবিতে মানবশরীরকে তিনি যে ভাবে আয়তন দিয়েছেন, তা স্বতঃই ভাস্কর্যকে মনে করায়। এক দিকে ভারতীয় ধ্রুপদী ভাস্কর্য, কলেজ জীবনে কলকাতার ভারতীয় সংগ্রহশালায় ধ্যানমগ্ন প্রজ্ঞাপারমিতা-র মূর্তি তাঁকে সম্মোহিত করে রাখত অন্য দিকে বাংলার টেরাকোটা, দুই সূত্রেই তাঁর পুষ্টি। আর্ট কলেজে তো গোড়ায় ভাস্কর্যের ক্লাস করতে হয়েছিল, ‘হয়ত ভাস্করও হতে পারতাম’ বলেন আজও।
তবে নারী ও পুরুষের শরীরকে তিনি এক রকম ভাবে দেখতে চাননি। ‘মেয়েদের কখনোই বিকৃত করে আঁকতে পারি না আমি। পুরুষ চরিত্রেরই বরং ভীষণ বিকৃতি ঘটিয়েছি। মেয়েদের ক্ষেত্রে বাহ্যত সেই বিকৃতি কিছু ঘটলেও প্রকাশের নানা অভিব্যক্তিতে সহানুভূতিকে চেনা যায়।’ ‘নটী বিনোদিনী’ (১৯৭৫) ছবিতে যেমন সামাজিক দৃষ্টিতে বিনোদিনীর অবস্থান, সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার তীব্র ইচ্ছা এবং বেরোতে না পারার অসহায়তা স্পষ্ট। আবার ‘বশ্যতাস্বীকারকারী’ (২০০২) ছবিতে পুরুষের আপাত প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু তুলনায় আকারে অনেক বড় নারীশরীর ছবির বেশির ভাগ জায়গা জুড়ে যে ভাবে অতিরিক্ত ঝুঁকে থাকে তাতে সংশয় জাগে, এই প্রভুত্ব অনেকটাই ফাঁপা নয়তো? আর একেবারে সাম্প্রতিক ‘দুর্গাশক্তি’তে বোধহয় সেই মেকি প্রভুত্বের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলার ইঙ্গিত যা ব্যর্থতা থেকে সাফল্যে উত্তরণের বৃত্ত সম্পূর্ণ করল।
তবে এর পিছনে বৃহত্তর পারিপার্শ্বিকের অভিঘাত বড় কম নয়। ১৯৯০-এর শেষ দিক থেকে বিশ্বজুড়ে ‘মানুষের ওপর মানুষের নৃশংসতা ইরাকে, আমেরিকায়, রাশিয়ায়, ব্রিটেনে অথবা ভারতে’, তাঁকে বিচলিত করতে থাকে। ‘নিরপরাধ জনগণের ওপর সন্ত্রাসী আঘাত, বাংলার অথবা ভারতের অন্য প্রান্তের গ্রামে রাজনৈতিক হত্যা, তরুণীদের ওপর নিপীড়ন ও ধর্ষণ সবই আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই নিরুদ্ধ মানবিকতা আমাকে সতর্ক, বিষণ্ণ ও আন্দোলিত করে। তার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ঘটেছে আমার শিল্পে।’ গুজরাত থেকে আবু ঘ্রাইব ছড়িয়ে আছে তাঁর ‘ক্ষত’, ‘আহত’, ‘মৃত’, ‘মুখ’, ‘বলি’, ‘পরিণাম’ এমন বহু ছবিতে। কোথাও ভূপতিত শরীর, কোথাও নগ্ন শরীরে দগদগে ক্ষতচিহ্ন, ছিন্ন প্রত্যঙ্গ ছড়ানো কোথাও বা। উদ্বাস্তু জীবনের ছবি তাঁর সৃষ্টির শুরুতে এক অন্ধকার অসহায় জগৎ তুলে ধরেছিল, সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত একুশ শতকের মানুষ তাঁর পরিণত পর্বে আরও ব্যাপক ব্যঞ্জনা নিয়ে এল।
কিন্তু অবক্ষয় আর বিপর্যয়ের নেতিতেই ফুরিয়ে যান না যোগেন চৌধুরী। তিনি চূড়ান্ত আশাবাদী, অন্ধকারের সঙ্গে আলোকে দেখতে চেয়েছেন সব সময়েই। তাঁর গ্রটেস্ক যেমন বিকৃতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও সহমর্মিতা জাগাতে ভোলে না, কখনও শেক্সপিয়রের ক্যালিবান (টেম্পেস্ট) বা ভিক্তর হুগো-র কোয়াসিমোদো-র (হাঞ্চব্যাক অব নোত্র-দাম) কথা মনে পড়ায়, তেমনই তাঁর ক্ষতবিক্ষত মানুষরাও অভিব্যক্তিতে কোথাও স্থৈর্যের আভাস দেয়। উত্তরণের সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখে। সব তো শেষ হয়ে যায়নি, অবিশ্বাস মানেই তো অনস্তিত্ব। মেলাবেন তিনি।

উদ্ধৃতিগুলি যোগেন চৌধুরীর বিভিন্ন রচনা ও সাম্প্রতিক একান্ত সাক্ষাৎকার থেকে।
কৃতজ্ঞতা: যোগেন চৌধুরীর ছবি/ ব্যক্তি দেশকাল ও কল্পনা, অরুণ সেন (প্রতিক্ষণ)।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.