প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী বলতেন, একটি বইয়ের একমাত্র প্রতিবাদ হতে পারে আর একটি বই। আমি এর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে ওয়েন্ডি ডোনিগারের বিতর্কিত বই ‘দ্য হিন্দুজ: অ্যান অলটারনেটিভ হিস্ট্রি’ নিষিদ্ধ করার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। কিন্তু নিষিদ্ধ কে করেছে? বস্তুত, মানসেন্দু কুণ্ডুর চিঠিতে (২০-২) যা লেখা হয়েছে বইটির বিরুদ্ধে ‘জেহাদ ঘোষণা’ করা হয়েছে তা ঠিক নয়।
ঘটনা হচ্ছে, ‘শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলন সমিতি’ বইটির কিছু মৌলিক গলদের প্রতি আঙুল দেখিয়ে এবং হিন্দু সমাজকে অপমান করার চেষ্টা হয়েছে এই ফরিয়াদ নিয়ে মামলা করেছিলেন। মামলা-ই করেছিলেন, দাঙ্গা করেননি, রাস্তা অবরোধ করেননি, ‘জেহাদ ঘোষণা’র কোনও প্রশ্নই ওঠে না বইয়ের প্রকাশক সংস্থা উত্তরে মামলাটা লড়তে পারত, হেরে গেলে উচ্চতর আদালতে আপিল করতে পারত। কিন্তু তা না-করে তারা বইটা বাজার থেকে তুলে নিল। এটা কি প্রকারান্তরে ‘শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলন সমিতি’র বক্তব্য মেনে নেওয়া নয়? ওয়েন্ডি ডোনিগার স্পষ্টতই বামপন্থী ঘেঁষা, হিন্দু বিরোধী এবং তাঁর বেশ কিছু লেখা (যেমন বেদের অনুবাদ) বিকৃতির অভিযোগে মাইকেল উইটজেল প্রমুখের দ্বারা প্রবল ভাবে সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর লেখার মূল্য বা অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে এই চিঠি নয়। আমার চিঠির প্রতিপাদ্য বিষয়, এই ধরনের ঘটনা পর্যালোচনা করতে গিয়ে যে দুই ধরনের মাপকাঠির আশ্রয় নেওয়া হয়, তাই নিয়ে। |
হুসেনের হিন্দু দেবদেবীকে নগ্ন করে আঁকা ছবির সমর্থনে বা মা কালীকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রসিদ্ধ’ মন্তব্যের সমথর্র্নে কলকাতার বহু বুদ্ধিজীবী গড়ের মাঠে ডিগবাজি খেয়েছেন। কিন্তু নিজের দেশ থেকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের চাপে বিতাড়িতা, মাথার উপর দাম ঘোষণা করা, অসম সাহসিকা লেখিকা তসলিমা নাসরিন যখন পৃথিবীর অন্য বাংলাভাষী শহরটাকে বেছে নিয়েছিলেন তখন সি পি এম সরকার একটা মেকি দাঙ্গাকে কাজে লাগিয়ে ২০০৭ সালে তাঁকে চরম অপমান করে শহর থেকে তাড়ায়। তখন এই পশ্চিমবঙ্গের কোনও বুদ্ধিজীবী (দু’এক জন ব্যতিক্রম বাদে) তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসেননি। এবং শুধু তাই নয়, বেশ কিছু ‘বুদ্ধিজীবী’ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন তসলিমা নাসরিনের আংশিক আত্মজীবনী বেআইনি ঘোষণা করতে।
এই দুই-মাপকাঠি বা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-এর মধ্যেই ওতপ্রোত হয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ভণ্ডামি, একদেশদর্শিতা এবং অন্তঃসারশূন্যতা। মানসেন্দুবাবুর আর একটি ধারণা, “আমি শিউরে উঠেছি...ভারতবর্ষও কি মৌলবাদের পথেই হাঁটছে?” তাঁকে আশ্বস্ত করে জানাই, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। ভারতবর্ষ যত দিন হিন্দুপ্রধান থাকবে, তত দিন এই ধরনের কিছু ঘটা অসম্ভব। ‘হিন্দু মৌলবাদী’ বলে কিছু হয় না (‘সমঝোতা এক্সপ্রেস’ বলে কেউ হাঁ হাঁ করে উঠবেন না, আগে আদালতে প্রমাণ করুন) এটা ‘কন্ট্রাডিকশন ইন টার্মস’। যে ধর্মে ঈশ্বরকে তেত্রিশ কোটি রূপে, এক রূপে, নেট রূপে, পুরুষ রূপে, নারী রূপে, শিশু রূপে এমনকী অর্ধমানব-অর্ধপশু (যেমন নৃসিংহ অবতার রূপে) কল্পনা করা যেতে পারে, সে ধর্মে মৌলবাদ অসম্ভব। মৌলবাদের প্রথম প্রয়োজন ‘এক ঈশ্বর, এক ধর্মগ্রন্থ, এক প্রেরিত পুরুষ’। যা হিন্দুর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব যত দিন না ভারতে হিন্দুত্বকে এই ধরনের মতবাদ গ্রাস করে নিচ্ছে, তত ক্ষণ ‘শিউরে ওঠা’র কারণ নেই। |
২৪ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান সংবাদের শিরোনামটি (‘আলিমুদ্দিনকে লক্ষ্মণের শক্তিশেল’) একটু ‘উল্টা বুঝলি লক্ষ্মণ’ গোছের হয়ে গেল না কি? লক্ষ্মণ তো রাবণের শক্তিশেল খেয়েছিলেন। আর লক্ষ্মণ শেঠ তাঁর দলের নেতাদের শক্তিশেল মারলেন। মেলাবেন আপনারা, মেলাবেন? |