কয়েক দিন ধরেই আশঙ্কাটা ঘোরাফেরা করছিল অনলাইন জগতে। এ বার তা-ই সত্যি প্রমাণিত হল। মঙ্গলবার টোকিওতে বন্ধ হয়ে গেল ইন্টারনেটে ব্যবহার করার জন্য তৈরি হওয়া বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা বিটকয়েন-এর অন্যতম বড় এক্সচেঞ্জ ‘এমটি গক্স’। সেখান থেকে প্রায় ৭.৪৪ লক্ষ বিটকয়েন (বাজার দর প্রায় ৪০.৯২ কোটি ডলার) চুরি হওয়াকেই যার কারণ হিসেবে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
লগ্নিকারীরা এ দিন টোকিও-তে এক্সচেঞ্জের সদর দফতরে বিক্ষোভ দেখালেও, পাত্তা নেই সংস্থা কর্তা মার্ক কার্পেলেস-এর। গত সপ্তাহেই বিটকয়েন ফাউন্ডেশন-এর পরিচালন পর্ষদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন যিনি। তাঁর বাড়ির ফোন বেজে চলেছে। উপচে পড়ছে মেল-বক্স। নেট থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে তাদের ওয়েবসাইটটি। সেখানে শুধু লেখা “সংস্থা ও লগ্নিকারীদের স্বার্থে ওয়েবসাইটটি বন্ধ করা হয়েছে। অবস্থার দিকে নজর রাখা হচ্ছে।”
বিটকয়েনের শুরুটা হয়েছিল কিছুটা উল্কার গতিতে, ২০০৯ সালে। ঠিক তার আগের বছরই শাতোশি নাকামোতো-র লেখা একটি প্রবন্ধে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় তার। আর পরের বছরই আত্মপ্রকাশ করে ইন্টারনেটে ব্যবহারযোগ্য এই বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা বিটকয়েন। নাকামোতোই যার স্রষ্টা। কিন্তু কে এই শাতোশি নাকামোতো? সে কি এক জন মানুষ? নাকি একটি গোষ্ঠী? কোন দেশীয়? হাজার চেষ্টা করেও এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বের করা যায়নি।
তবে তা বলে বিটকয়েনের অগ্রগতিও বন্ধ হয়নি। বরং মন্দার সঙ্গে যখন বিভিন্ন দেশের লড়াই চলছে, তখন কোনও দেশের সরকার দ্বারা স্বীকৃত না হওয়া সত্ত্বেও, গত পাঁচ বছরে নানা প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছে এর ব্যবহার। বিভিন্ন বিপণিতে অনলাইন কেনা-কাটা তো বটেই, এমনকী সাইপ্রাসের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ মেটানোর মাধ্যম হিসেবেও বিটকয়েনের ব্যবহার শুরু হয়েছে। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার-এ গত বছরই প্রথম চালু হয়েছে বিটকয়েন এটিএম। তৈরি হয়েছে বিটকয়েন মুদ্রাও। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানা দেশে তৈরি হয়েছে এর আলাদা এক্সচেঞ্জ। যেখান থেকে ব্যবহারকারী নিজের ইচ্ছেমতো বিটকয়েন কিনতে পারবেন, অবশ্যই দেশের মুদ্রার বদলে। যা পরবর্তীকালে ব্যবহার করতে পারবেন ইন্টারনেটে লেনদেনের ক্ষেত্রে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডলারে দরও বেড়েছে বিটকয়েনের। প্রায় নাগোরদোলা মতো এক সময় তা ছাড়িয়ে গিয়েছে ১,৩০০ ডলারও। ফের নেমে এসেছে তিন অঙ্কের ঘরে।
তবে এ সবের মধ্যেই বিতর্ক পিছু ছাড়েনি এই নয়া মুদ্রা ব্যবস্থার। ‘ওপেন সোর্স’ ব্যবস্থা হওয়ার কারণে যে কেউ এর ফাঁকফোকর বার করে ফেলতে পারে। যে কারণে প্রথম থেকেই এর সুরক্ষা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে নানা মহলে। ইন্টারনেটে বেআইনি লেনদেনে বিটকয়েনের ব্যবহার নিয়ে সরব হয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকারও। চিন-সহ বেশ কয়েকটি দেশে লেনদেনের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বিটকয়েন। আমেরিকায় গত বছরই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট। সেখানে গত বছরই ঝামেলায় পড়ে প্রাথমিক ভাবে একটি কার্ড গেম-এর সাইট হিসেবে তৈরি হওয়া ‘এমটি গক্স’-ও। ২০১১ সালেই যা পুরদস্তুর বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। গত বছর কয়েক দিনের জন্য বন্ধও রাখা হয় এক্সচেঞ্জটি। তবে শেষ পর্যন্ত লগ্নিকারীদের সব টাকাই ফেরানো হয়েছিল। তখনই কার্ল জানিয়েছিলেন, “বিটকয়েনে লগ্নি করা মানে বিপুল ঝুঁকি নেওয়া। পরের দিন আমার লগ্নি শূন্যে পরিণত হতে পারে জেনেই টাকা ঢালা উচিত।”
কিন্তু এ বারের সমস্যা অনেক গভীরে। গত কয়েক দিন ধরেই এক্সচেঞ্জে ক্রমাগত দাম কমছিল বিটকয়েনের (গত কয়েক দিনে যা প্রায় ৮৪% পড়েছে)। বিশেষজ্ঞদের মতে, বার বার চুরির কারণে তাদের প্রায় দেউলিয়ায় পরিণত হয়েছিল ‘এমটি গক্স’। তবে বিটকয়েনের অন্যতম পুরনো এক্সচেঞ্জটির এই দুর্দশা থেকে নিজেদের কিছুটা বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে অন্য এক্সচেঞ্জগুলি। এ দিন প্রথম সারির ছ’টি বিটকয়েন এক্সচেঞ্জের সম্মিলিত ঘোষণা, “এটি একটি মাত্র সংস্থার সমস্যা। এ জন্য বিটকয়েন অথবা অন্যান্য অনলাইন মুদ্রা ব্যবস্থাকে কাঠগড়ায় তোলা উচিত নয়।” |
বিটকয়েন কী? |
• অনলাইন লেনদেনে ব্যবহার করার জন্য এক ধরনের মুদ্রা ব্যবস্থা (ডিজিটাল কারেন্সি)
• ব্যবহার করা যায় মোবাইল, কম্পিউটার মারফত
• কোনও দেশের সরকার দ্বারা স্বীকৃত নয়
• ব্যবহার করা যায় না সব ওয়েবসাইটেও |
|