দেহবল্লরীতে হাজার বছরের প্রাচীন নাচের মুদ্রা, বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে বাপ-ঠাকুরদার কাছে শেখা কবেকার সব বোল, নাটকের কুশীলবদের মুখে পাহাড়-জল-জঙ্গলের মানুষের আদিমতম বুলি সব মিলিয়ে যেন এক খণ্ড প্রাচীন ভারত। সেই ভারত, ইতিহাসও যাকে ভুলতে চেয়েছে বার বার।
শান্তিনিকেতন থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে, ইলামবাজার যাওয়ার পথে রাস্তার বাঁ দিকে সোনাঝুরি আর আকাশমনি জঙ্গলের ফাঁকে ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারি তিন দিন ধরে আদিবাসী সংস্কৃতির এই পরম্পরার সাক্ষী থাকা যাবে। উদ্যোক্তা, দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি)। আদিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে এনএসডি-র এমন উদ্যোগ এই প্রথম। গত পনেরো দিন ধরে উদ্যোক্তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি করেছেন তিনটি মঞ্চ। সেখানেই ৩৫টি আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রায় ৬০০ জন শিল্পী নিজেদের শিল্পকলা তুলে ধরবেন দর্শকদের সামনে। অনুষ্ঠানের পোশাকি নাম, ‘আদি বিম্ব’। ভাবনা-চিন্তার মূল কারিগর এনএসডি-র সভাপতি বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব রতন থিয়াম। |
আলাপচারিতায় ভাগ করে নিলেন আদিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞান। রতনের কথায়, ‘‘প্রযুক্তিগত সভ্যতার সঙ্গে সাংস্কৃতিক সভ্যতার লড়াই চলছে সর্বত্র। জঙ্গল-জীবনের নিজস্বতা হারিয়ে শহুরে মেকি বিনোদন ঘাঁটি গাড়ছে। কিন্তু প্রযুক্তি আর সংস্কৃতি দু’টোকেই বড় প্রয়োজন সমাজের। আদিবাসী সংস্কৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আধুনিক জীবনের শিকড়। তাই হারিয়ে যেতে বসা আদিম সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের জন্যই এমন অনুষ্ঠান।”
কিন্তু অনুষ্ঠানের জন্য কেন বেছে নেওয়া হল বীরভূমের এই এলাকাকে? কেনই বা নাটকের প্রতিষ্ঠান হয়েও আদিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে এমন কাজের কথা ভাবলেন এনএসডি কর্তারা?
প্রশ্নটার জন্য যেন মুখিয়ে ছিলেন উৎসবের প্রদর্শনী কিউরেটর ওয়ার্ধার মহাত্মা গাঁধী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওমপ্রকাশ ভারতী। বললেন, ‘‘লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডার পশ্চিমবঙ্গ। আর বীরভূম তার পীঠস্থান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেই সত্যিটা বুঝেছিলেন বলে শান্তিনিকেতন গড়ে উঠেছিল। গুরুদেবের আদর্শ ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। তাই এখানেই সূচনা অনুষ্ঠান।” |
এনএসডি-র অধিকর্তা ওয়ামন কেন্দ্রির কথায়, “সবটাই আসলে শিকড়ে ফেরার তাগিদ। সংস্কৃতির সঠিক বিকাশ তখনই সম্ভব, যখন আমরা সত্যি সত্যি শিকড়ে পৌঁছতে পারি।” ওয়ামন জানান, এই অনুষ্ঠানে সে সব শিল্পমাধ্যম পরিবেশিত হবে, তাতে আধুনিকতার কোনও মিশেল নেই। সবটাই সেই শিল্পমাধ্যমের প্রাচীনতম ‘ফর্ম’। মুম্বইতেও পরে এ ধরনের অনুষ্ঠান করা হবে বলে জানালেন রতন।
ইলামবাজার সড়কের উপরেই বনলক্ষ্মী বাস স্টপেজে ‘আদি বিম্ব’র বিরাট তোরণ চোখে পড়বে। সেখান থেকে দ্বারন্দার রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই দ্বিতীয় তোরণ। এখান থেকেই কানে আসবে ধামসা, মাদল, রেগড়ার ছন্দময় গুরুগম্ভীর শব্দ। আর একটু এগোলে বাঁশ-চট, প্লাই, মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছে তিনটি মঞ্চ। ফটকের দু’পাশে মস্ত গ্যালারি। তাতে আদিবাসী পোশাক, অলঙ্কার এবং শিল্প-সংস্কৃতির পটভূমির উপরে ছবির প্রদর্শনী। আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর ব্যবহৃত প্রায় ৩০০ বাদ্যযন্ত্র ও শতাধিক মুখোশও রাখা রয়েছে। সারা দিনই খোলা প্রদর্শনী। বিকেল ৫টা থেকে শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রবিবার উদ্বোধনে এসে অভিভূত শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। বললেন, “আমরাও লোকসংস্কৃতিকে ধরে রাখতে মাটি উৎসব করেছি। এই ভাবনাটাও খুব ভাল।” বাংলাদেশ থেকে শান্তিনিকেতন বেড়াতে এসে এমন বাড়তি পাওনায় উচ্ছ্বসিত কামাল লোহানি। নিজেও লোক-সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘ দিন। বললেন, “রতনের সঙ্গে কথা বললাম। আমাদের দেশেও যদি এমন অনুষ্ঠান করেন ওঁরা, সেই অনুরোধ করেছি।” |