উচ্চ বর্ণের শাসনের অবসান ঘটিয়ে দলিত ও সংখ্যালঘুদের মাথায় বসিয়ে সরকার গড়ার স্বপ্ন। এই লক্ষ্য সামনে রেখে নতুন পথ চলা শুরু করলেন আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। আপাতত সিপিএমেই থাকছেন। তবে নবগঠিত ‘সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চে’র হয়ে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে প্রার্থী দেবেন। অনগ্রসরদের ক্ষমতায়নের জন্য এই সংগ্রামে দল থেকে বাধা এলেও থামবেন না, জানিয়ে রাখলেন সে কথাও।
রাজনৈতিক সত্তার বাইরে সংখ্যালঘু ও দলিতদের জন্য বেসরকারি সংগঠন গড়ে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছেন সিপিএমের বর্ষীয়ান বিধায়ক রেজ্জাক। রবীন্দ্র সদনে রবিবার গণ কনভেনশন করে এ বার যাত্রা শুরু হল সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চেরও। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য রেজ্জাকই ওই মঞ্চের সভাপতি। যে মঞ্চের লক্ষ্য ভবিষ্যতে এমন এক সরকার গড়া, যার মুখ্যমন্ত্রী হবেন দলিত সম্প্রদায়ের কোনও প্রতিনিধি। স্বরাষ্ট্র দফতর-সহ উপমুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব থাকবে মুসলিম কারও হাতে। কনভেনশনের মঞ্চ থেকেই রেজ্জাক এ দিন বলেছেন, “এক দিকে সুসংগঠিত বামফ্রন্ট। অন্য দিকে ক্লাবের মতো তৃণমূল। এর মধ্যে থেকে ফুঁড়ে বেরিয়ে আমাদের এগোতে হবে!” পরের বার আর ভোটে দাঁড়াতে চান না, সে কথা আগেই বলেছেন রেজ্জাক। সেই ঘোষণা করে এ দিনও বলেছেন, “৭২ বছর বয়স হয়েছে। আমার হাতে মেলা সময় নেই! যতটা সময় আছে, এই কাজেই দেব। তার জন্য কেউ ব্যবস্থা নিলে নেবে!” |
রেজ্জাক ও তাঁর সহযোগীরা অবশ্য মনে করছেন, অনগ্রসরদের উন্নতির জন্য তাঁরা যে কাজে ব্রতী হয়েছেন, তাতে কমিউনিস্ট পার্টির আপত্তির কিছু নেই। রেজ্জাকের আমন্ত্রণে কনভেনশন শুনতে এসে প্রশ্নের জবাবে সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ যেমন বলেছেন, “আমাদের পার্টি কংগ্রেসে আলোচনা হয়েছে এ ব্যাপারে। প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রকাশ কারাটের (সাধারণ সম্পাদক) নোটেও বলা আছে, দলিত, অন্যান্য অনগ্রসর, মুসলিম, জনজাতির কাছে পৌঁছনোর জন্য আমাদের মঞ্চ গড়ে কাজ করতে হবে। নেতা-কর্মীরা তা থেকে উঠে আসবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, আলোচনা করলেও দল সেই ধরনের মঞ্চ গড়ে তুলছে না।” এই জন্যই রেজ্জাকের আহ্বানকে তিনি সমর্থন করছেন বলে জানিয়েছেন লক্ষ্মণবাবু। মঞ্চ থেকে রেজ্জাক এবং দর্শকাসনে লক্ষ্মণ, দু’জনেই সামাজিক ন্যায়ের দাবি জোরালো করতে হাতিয়ার করেছেন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের তত্ত্বকে।
জাতপাতের রাজনীতির সঙ্গে এঁটে উঠতে না-পেরেই হিন্দি বলয়ে কোণঠাসা হয়ে রয়েছে বামেরা। বিভিন্ন রাজ্যে নানা জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্খার উপরে ভর করে গড়ে-ওঠা নানা দলের উদাহরণ দিয়েই রেজ্জাক নতুন তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। যে তত্ত্ব বলছে, শ্রেণি সংগ্রামের আগে জাত-বর্ণের সংগ্রাম। তাঁর যুক্তি, শিল্প বিপ্লব হয়নি বলে পুঁজিবাদের তত্ত্ব মেনে মালিক-শ্রমিকের ধ্রুপদী সম্পর্কের দ্বন্দ্ব ভারতীয় সমাজে অনুপস্থিত। সামন্ততন্ত্রের নানা চিহ্নই এই সমাজে ছড়িয়ে আছে। তাই জাত-বর্ণের সমস্যাকে মোকাবিলা না-করলে বামেদের পক্ষে এগোনো মুশকিল। রেজ্জাকের মঞ্চের স্লোগান, ‘যার যত সংখ্যা ভারী, তার তত ভাগীদারী’। তফসিলি জাতি, উপজাতি, ওবিসি ও সংখ্যালঘু মিলে মোট জনসংখ্যার ৯৪%-ই বঞ্চিত বলে দাবি করে উচ্চ বর্ণের আধিপত্য থেকে সরকার ও রাজনৈতিক দলকে মুক্ত করার ডাক দিয়েছেন তাঁরা।
তবে রেজ্জাক এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন, “বামপন্থীদের বিরোধিতা এবং তৃণমূলকে সাহায্য করার জন্য এই মঞ্চ নয়। বরং আমরা ঘোরতর ভাবে তৃণমূল বিরোধী! এই রকম একটা হিংস্র শক্তিকে মানুষ ক্ষমতায় এনেছেন বামপন্থীদের ত্রুটির জন্যই, এটা বলতে চাইছি।” কনভেনশন থেকে কংগ্রেস বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা, বিহারের সাংসদ আনোয়ার আনসারি, ফুরফুরা শরিফ ও বসিরহাটের দুই পীরজাদা হজরত কাশেম সিদ্দিকি ও হুমায়েত আমিন-সহ একাধিক বক্তাই রেজ্জাকের সুরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের ভাঁওতা দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। ঘটনাচক্রে, এ দিনই প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে এক বৈঠকের পরে দলের সংখ্যালঘু সংগঠনের সর্বভারতীয় চেয়ারম্যান খুরশিদ আহমেদ সৈয়দ অভিযোগ করেছেন, সংখ্যালঘুদের জন্য কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ এ রাজ্যে ঠিকমতো ব্যবহার হচ্ছে না। খুরশিদের অভিযোগ, “সাম্প্রদায়িক হিংসা রোধে কেন্দ্রীয় সরকার যে বিল আনার চেষ্টা করেছিল, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার আর উত্তরপ্রদেশ তাতে বাধা দিয়েছিল। নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করে এই সরকার সংখ্যালঘুদের আশ্বাস দেয়, অথচ সংসদে গিয়ে এই ধরনের বিলের বিরোধিতা করে।” গুজরাতে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে তুলনা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নরেন্দ্র মোদীকে ‘ভাই-বোন’ বলে খোঁচাও দিয়েছেন খুরশিদ! তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এ সবে গুরুত্ব দিতে নারাজ। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাল্টা আক্রমণ, “কংগ্রেস এখন সাইনবোর্ড। সিপিএমও বিলুপ্তপ্রায়। তাই বেনামে মাথাচাড়া দিয়ে নানা কথা বলছে! মানুষ সবই দেখছেন।” |