জেনিভা বৈঠক আবারও ব্যর্থ। দ্বিতীয় দফার এই শীর্ষ বৈঠকেও সিরিয়ার স্বৈরাচারী আসাদ জমানার কোনও গণতান্ত্রিক বিকল্প অন্বেষণের কাজ শুরু করা গেল না। সিরিয়ার শাসক গোষ্ঠী যে সেই প্রচেষ্টায় বাদ সাধিবে, ইহা একপ্রকার স্বতঃসিদ্ধই ছিল। ইতিপূর্বে ন্যাটো-মার্কিন আগ্রাসনের হুমকির চাপে পড়িয়া প্রেসিডেন্ট আসাদ রুশ মধ্যস্থতায় তাঁহার রাসায়নিক অস্ত্রসম্ভার রাষ্ট্রপুঞ্জের হাতে তুলিয়া দিতে নিমরাজি হইয়া যেটুকু দম ফেলার ফুরসত আদায় করিয়াছিলেন, তাহা কাজে লাগাইয়াও তিনি ওই অস্ত্র প্রেরণে অনাবশ্যক বিলম্ব ও গড়িমসি করিয়াছেন। পাশাপাশি পশ্চিমী দুনিয়ায় আল-কায়দা ও ইসলামি জেহাদিদের ব্যাপারে যে আতঙ্ক আছে, তাহা কাজে লাগাইয়া নিজেকে রাজনৈতিক ইসলামের জেহাদি প্রকরণের বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক রূপে প্রতিষ্ঠা করার অপপ্রয়াসেও আংশিক সফল হইয়াছেন। জেনিভা-২-এর শীর্ষ বৈঠকেও তাহার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ। সিরিয়ায় জমানা-বদলের কোনও সম্ভাবনা সেখানে খতাইয়া দেখা হইল না।
অথচ এই গৃহযুদ্ধ ইতিমধ্যেই লক্ষ-লক্ষ নিরীহ সিরীয়র প্রাণ হরণ করিয়াছে, হাজার-হাজার শিশু বোমার টুকরায় পঙ্গু হইয়াছে, লক্ষ-লক্ষ শরণার্থী আশপাশের দেশগুলিতে পাড়ি দিয়াছে। সম্পূর্ণ অসামরিক, ঘন-বসতিপূর্ণ এলাকায় ব্যারেল বোমা নিক্ষেপ করিয়া আসাদের ঘাতক বাহিনী নিরস্ত্র মানুষদের নিয়মিত হত্যা করিয়া চলিয়াছে, আস্ত জনপদ নিশ্চিহ্ন করিয়া দিতেছে। জবাবে যে-সকল বিদ্রোহী গোষ্ঠী পাল্টা হামলা চালাইতেছে, তাহাদের অস্ত্রসজ্জিত করিয়া আসাদের বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার প্রকল্পটিতেও মার্কিন প্রশাসন সে ভাবে সায় দেয় নাই। কেননা ওই সব গোষ্ঠী প্রথমত ঐক্যবদ্ধ নয়, পরস্পরের বিরুদ্ধে তীব্র হানাহানিতে লিপ্ত। ফলে এক গোষ্ঠীকে দেওয়া অস্ত্র অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়ার শঙ্কা প্রচুর। দ্বিতীয়ত, এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আল-কায়দার মতো জেহাদি সন্ত্রাসে বিশ্বাসীরাও রহিয়াছে, যাহারা সিরিয়া, ইরাক, লেবানন প্রভৃতিকে একটি অখণ্ড ইসলামি আমিরশাহিতে রূপান্তরিত করিতে চায়। ইহারা রাজনৈতিক ইসলামের সর্বাপেক্ষা কট্টরপন্থী ও ধ্বংসাত্মক গোষ্ঠী, যাহাদের হাতে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র পৌঁছাইলে সিরিয়াও আর একটি তালিবান-শাসিত আফগানিস্তানে পরিণত হইতে পারে। অন্তত ওয়াশিংটনের আশঙ্কা তেমনই। সে কারণেই পশ্চিমী বিশ্ব লিবিয়ার মতো কোনও সিদ্ধান্ত এ ক্ষেত্রে লইতে দ্বিধাগ্রস্ত। লিবিয়ার শিক্ষাও এ ক্ষেত্রে নেতিবাচকই প্রতিপন্ন হইয়াছে, যেমন হইয়াছে ইরাক ও আফগানিস্তানের শিক্ষাও।
প্রশ্ন হইল, তবে কি সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের নামে এই হত্যালীলা চলিতে থাকিবে? প্রেসিডেন্ট আসাদ যত দিন তাঁহার বাহিনীর সামরিক উৎকর্ষ সম্পর্কে নিঃসংশয় থাকিবেন, তত দিন তিনি যে আলাপ-আলোচনা তথা কূটনীতিকে আমল দিবেন না, তাহা স্পষ্ট। তাঁহাকে আবার নিশ্চয়তা দিতেছে পুতিনের রাশিয়া, দৃঢ় ভাবে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের পাশে দাঁড়াইয়া যে শক্তি তাঁহাকে যাবতীয় সমর্থন জোগাইতেছে। এই অবস্থায় কূটনৈতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হইতে বাধ্য। এ জন্যই সম্ভবত মার্কিন বিদেশ সচিব জন কেরি ফ্রান্স, ব্রিটেন, সৌদি আরব, তুরস্ক, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো ১১টি ‘সিরিয়া-বান্ধব’ রাষ্ট্রের গোয়েন্দা-প্রধানদের লইয়া জরুরি বৈঠক করিয়াছেন। সমাধান কি তবে দামাস্কাসের উপর সামরিক আগ্রাসন? প্রেসিডেন্ট আসাদ কি অন্য পথ খোলা রাখিতেছেন? |