রাজীব গাঁধীর হত্যাকারীদের ফাঁসি রদের সিদ্ধান্ত লইয়া চতুর্দিকে নানা অসন্তোষ, নানা তর্ক। অনেক যুক্তি-প্রতিযুক্তির মধ্যে একটি গুরুতর কথা হারাইয়া যাইবার উপক্রম। তাহা হইল, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ভাবনা ও কার্যপদ্ধতির মধ্যে একপ্রকার অনিশ্চয়তা ও দোলাচল লক্ষণীয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা লইয়াও মানিতেই হয় যে, এই সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটির মধ্যে স্পষ্টতই কিছু অসমঞ্জসতা বিদ্যমান। এই হত্যাকারীদের ফাঁসির রায়ের প্রেক্ষিতে প্রাণভিক্ষার আবেদন যখন প্রথম পেশ হইয়াছিল, তাহার পর এগারো বৎসর চার মাস কাটিয়া গিয়াছে কেবলমাত্র এই যুক্তির ভিত্তিতেই যদি ফাঁসির মূল রায়টিই বরবাদ করিয়া দিবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাহা হইলে বুঝিতে হয়, রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষার আবেদনের নিষ্পত্তি কত দিনের মধ্যে হওয়া বিধেয়, তাহা লইয়া ভারতের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের একটি সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রহিয়াছে। কিন্তু বাস্তবেই কি তাহা আছে? প্রশ্নটি তলাইয়া দেখা প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক ইতিহাস বলিতেছে, একাধিক বার সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে ভিন্ন অবস্থান লইয়াছে। প্রথম অবস্থান, আবেদন আসিবার দুই বৎসরের মধ্যে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করিতে হইবে, বেশি অপেক্ষা করা যাইবে না। পরবর্তী কালে ডিভিশন বেঞ্চের মতে দ্বিতীয় অবস্থান, এ বিষয়ে কোনও সময়সীমা ধার্য করা সম্ভব নয়, যদিও দ্রুত নিষ্পত্তি বাঞ্ছনীয়। গত জানুয়ারি মাসে বিলম্বের যুক্তিতেই শীর্ষ আদালত যখন কয়েকটি মামলার মোট পনেরো জন অপরাধীর ফাঁসি রদের সিদ্ধান্ত লইয়াছিল (যাহাদের মধ্যে ছিল চন্দন-দস্যু বীরাপ্পানের চার সঙ্গী), তখন হইতেই ইঙ্গিত মিলে, আবারও পুনর্ভাবনার প্রবাহ বহিতেছে। শেষ অবধি রাজীব-ঘাতকদের মামলা-প্রসঙ্গেও সেই একই যুক্তির অবতারণা দেখা গেল। একটি বিষয় ইহা হইতে পরিষ্কার। ভারতীয় বিচারব্যবস্থাও নিশ্চিত নহে, কত দূর বিলম্ব হইলে তবে ফাঁসি রদের মতো গুরুতর সিদ্ধান্তে আসা যায়। নিশ্চিত হওয়া সত্যই মুশকিল। কেননা, এমনিতেই অতি-বিতর্কিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড যখন এ দেশে দুর্লভের মধ্যে দুর্লভতম ক্ষেত্রে প্রদত্ত হয়, তখন সেই শাস্তি আবার অন্য কোনও যুক্তির প্রভাবে আগাগোড়া মকুব হইয়া যাওয়ার মধ্যে বিচার-দর্শনের একটি স্ববিরোধিতা রহিয়াছে। বিচারের দীর্ঘ পদ্ধতি, দার্শনিক ভিত্তি, শাস্তি-ব্যবস্থার গুরুত্ব: সবই ইহার দ্বারা অর্থহীনতায় পর্যবসিত হয়। মৃত্যুদণ্ড রদের পরবর্তী যে ধাপ, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, তাহার মধ্যে আবার ‘যাবজ্জীবন’ শব্দটির ব্যাখ্যাভেদের কারণেও পুনর্বিবেচনার বিষয়টি দুরূহ হইয়া পড়ে।
সম্ভবত সেই কারণেই অন্যান্য দেশেও যেখানে মৃত্যুদণ্ডের প্রচলন আছে, অদ্যাবধি বিষয়টি একই রকম বিতর্কিত ও অনিশ্চিত। মৃত্যুদণ্ড লইয়াও যেমন যুক্তি-প্রতিযুক্তি অন্তহীন, মৃতু্যদণ্ড রদের বিষয়েও তেমন। শুধু বিলম্বের কারণে যে ফাঁসি বাতিল করা সঙ্গত নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই তাহার উদাহরণ উপস্থিত, যেখানে ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট কেনেডির ভাই রবার্ট এফ কেনেডিকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী আজ এত বৎসর পরেও সমানেই এই জেল হইতে ওই জেলে স্থানান্তরিত হইতেছেন, বার-চোদ্দো আবেদন পেশ সত্ত্বেও তাঁহার শাস্তি মকুব হয় নাই। বিষয়টি আসলে অনেক দিক হইতেই সংবেদনশীল। বিশেষত যে সাংবিধানিক ব্যবস্থায় আইন-শাসন-বিচার এই তিন বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব রাখিবার নীতিটি অলঙ্ঘনীয়, সেখানে শাসনবিভাগের প্রধান ব্যক্তির বিশেষ ক্ষমতার পরিধি শেষ পর্যন্ত বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপে কতদূর সীমায়িত হওয়া সঙ্গত, তাহাও একটি অত্যন্ত গভীর প্রশ্ন। অনাবশ্যক তাড়াহুড়া কিংবা ক্রমাগত অবস্থান-পরিবর্তনের দোলাচল দিয়া এত বড় প্রশ্নের মীমাংসার আশা নাই। বরং সেই অব্যবস্থিতচিত্ততার ফাঁক গলিয়া বিচারের নামে অ-বিচার ঘটিয়া যাইবার সম্ভাবনা। |