রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
জাস্ট যাচ্ছি
ঘুমের প্রথম পরদাটা নেমেও নামল না। নীচের অংশ দিয়ে মঞ্চের কাঠের মেঝে, এক-আধটা চেয়ার, চলাফেরা করা পা দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হল নাটকটা চলছে, অভিনেতারা নড়াচড়াও করছেন। দর্শক হিসেবে আমাকে দেখতে দেওয়া হচ্ছে তলার অংশটুকু। বাকিটা পরদা দিয়ে আড়াল করা আছে ইচ্ছে করে। একটা গোলাকার আলো স্পট হয়ে থমকে আছে কঁুচি দেওয়া পরদার ওপর। ওই দিকে তাকিয়ে দশর্কদের আন্দাজ করে নিতে হবে পরদার ও-পারে কী ঘটছে। আর কেউ নেই। আমি একাই বসে আছি হলে। চারপাশে ফুটে আছে অজস্র লাল সিট, অন্ধকারে। কোথাও একটা ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট হয়েছে, তার করকরে আওয়াজটা কানে আসছিল। সেটা হঠাত্‌ ফুরিয়ে গেল। যেতেই পরদা উঠে গেল। কেউ নেই। পড়ে আছে দুভের্দ্য লাল অন্ধকার। উঠে দাঁড়ালাম।
আসার সময় কে যেন আলো দিয়ে সিট চিনিয়ে দিয়েছিল। এখন কেউ নেই। লাল শব্দের টিপ দেওয়া দরজা পেরিয়ে বাইরে আসতেই ঘুমটা ছিঁড়ে গেল। ডান দিকে কালীঘাট, বাঁ দিকে ঘুরলাম। মোড়ে পৌঁছে দেখি ডান দিকে চেতলা, তাই আবার বাঁ দিকে এগোলাম। রাসবিহারীর মোড়। দুটো রানওয়ের ক্রসিং। আকাশ দেখলাম। কোনও ফ্লাইট নেই এখন। জোরালো আলোয় ভাসতে ভাসতে, হাসতে হাসতে তাকিয়ে আছে এয়ার হোস্টেসরা। সোনার গয়না। পেলব স্কিন। কালচে লাল ঠোঁট। শ্যাম্পু-শুকনো চুল। এ ছাড়া, কড়ি আছে যার, তার জন্য হোম লোন। ঘাড় বাঁকিয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকা পর পর আলো বিজ্ঞাপনের মাথা জুড়ে। অনেক নীচে নিয়ন অন্ধকারে ডাকছে হলুদ সবুজ অটো। মানুষ গিলছে। পেট ভরলেই ছিটকে যাচ্ছে আর কোনওখানে।
পরিষ্কার দেখতে পেলাম ফুলে উঠেছে ক্রসিং-এর মধ্যবিন্দু। সেখানে এলোপাথাড়ি অস্ত্রোপচারের দাগ। লোহা খোদাই করা ট্রামলাইনের আঁকিবুকি। সারা দিন ধরে ভারী চাকার দাপটে মাথা তুলতে পারে না আন্ডারগ্রাউন্ড কলকাতার যাবতীয় উষ্মা। এখন ফুলে উঠেছে। হয়তো বিস্ফোরণও হতে পারে একটা। আর আছে নানা রকম লোভ। চকচক করছে, ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, আমিও গড়িয়ে গেলাম লেক মার্কেটের দিকে মুখ করে। ডান দিকের ফুটপাথে উঠলাম।
ছবি: লেখক।
শেষ মেট্রো চলে গেছে অনেক ক্ষণ। শাটার বন্ধ। আলো জ্বলছে। সিঁড়িতে কেউ কেউ বসে। এক বৃদ্ধ লাঠির ওপর থুতনি রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন। লাঠির ওপর পর পর গোল গোল ফুটো করা। সেখানে কান রাখলাম। ভেতরে নানা রকম শোঁ-শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কি বাঁশি?’ শ্লেষ্মা-ভরা ঘড়ঘড়ে শব্দে উত্তর এল, ‘আমি পাতালে নামি না কখনও, ওখানে আলো কম, অক্সিজেনও কম।’ পাশের পানের দোকানটাও বন্ধ। নারকেল দড়িটা এখনও লাইভ। লাল হয়ে জ্বলছে, প্রাণের সবুজ সংকেত। হ্যালোজেন আলোর কমলা রসে থইথই করছে ভাঙাচোরা, এবড়োখেবড়ো ফুটপাত। খালি হয়ে যাওয়ায় এখন চওড়া লাগছে। নতুন ট্রাইডেন্ট লাইট জ্বলছে পর পর, অনেক দূর পর্যন্ত। ত্রিস্তর নরম জ্যোত্‌স্না, ইলেকট্রিক ফানুস। তার আলোয় মানুষ চেনা দায়, প্রথম রাতের অন্ধকারে।
পর পর দোকান। সব বন্ধ। কীসের দোকান বোঝার উপায় নেই। কত বার হেঁটে গেছি এখান দিয়ে, অথচ মনে করতে পারছি না ঠিক কোন দোকান থেকে এক বার মুড়ুক্কু কিনেছিলাম। দোকানের ওপরে ময়লা দোতলা। কখনও অন্ধকার তিনতলার জানলা। দেখতে পাচ্ছি না। স্রেফ আন্দাজ করছি তার ভিতরে শোয়ানো পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ানের বেলোটা ফুলে উঠছে, প্রায় শব্দহীন নানা সুরে। ফুটপাত আর রাস্তার সীমানায় যাঁরা সবজি বিক্রি করেন, তাঁরা পড়ে থাকা সব কিছু তুলে নিয়ে গেছেন শহরের গোপন কোনও বনে। তাঁদের ঝুড়িগুলো বেঁধে রেখে গেছেন লোহার রেলিংয়ে। কোনারক মন্দিরের চাকার কথা মনে পড়ল। ভোর হলেই চক্রাসন পেতে দেওয়া হবে পথে। বন থেকে ফিরে আসবে সতেজ, সবুজ, সবজি।
অন্ধকার শপিং মলের আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ করা ভৌতিক বাক্সটার সামনে এক জন মানুষকে ঘিরে কুকুরদের জটলা। বিস্কুট ভেঙে ভেঙে দিচ্ছে। কিছুটা বেসুরে হলেও বুঝলাম গাইছে, আমার পরান যাহা চায়। আমাকে দেখে ছায়ামানুষ বলল, ‘সারা দিন মোড়ে মোড়ে ভূতে গান গায়। ল্যাম্পপোস্টের মাথায় হেমন্ত, কণিকাকে চড়িয়ে দিয়েছে। ছুটি নেই একেবারে। সারা দিন ডিউটি। এখন তো ওঁরা ঘুমোচ্ছেন, তাই আমি একটু গাইছি।’ বিস্কুটের পুষ্পবৃষ্টিকে ফেলে এগোলাম। ফাঁকা হয়ে গেল সামনের চত্বরটা। লেক মার্কেটের মোড় এসে গেছে।
রাতের কলকাতা ভাল নয়। রোজই শুনি। আগে এমন ছিল না। সবাই বলে। রাস্তার কালো পিচের ওপর সাদা চক দিয়ে কেউ লিখে গেছে টেক ব্যাক দ্য নাইট। তার পর একটা তিরচিহ্ন। সে দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল আর একটা লেখা ভয়শূন্য পথ। কে লিখেছে? কেউ নিশ্চয়ই ফেরত চাইছে শংকাহীন নিস্তব্ধতা। চোখ বুজলাম, শব্দগুলো ইকো হতে শুরু করল চারপাশ থেকে। এই জায়গাটা একেবারে ফাঁকা। ফুটপাতের সব ঝুপড়ি দোকানের ডালা বন্ধ। সব জায়গায় চাপ চাপ নিয়ন অন্ধকার। কেউ কোথাও নেই। তাই নানা রকম ছায়া দখল নিয়েছে পথের। কাটাকুটি খেলছে ভেঙে ফেলা পুরনো বাড়ির এখনও দাঁড়িয়ে থাকা, চোয়াল শক্ত করা অথচ অসহায় একলা দেওয়ালে। কিছু দূরের ট্র্যাফিক সিগনালটা আলো বদলাতে ভুলে গেছে। তারও ক্লান্তি আছে। লাল অথবা সবুজ কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। তাই, থমকে গেছে হলুদে। এবং সদ্য একটা হাওয়া ওঠা নাছোড়বান্দা ঠান্ডা অন্ধকারে। এটিএম-এর নীল উর্দি পরা চোখে তন্দ্রা নামা রক্ষীর মুখে সেই আলো- আঁধারির খেলা। তার হাতে ধরা একটা সস্তা মোবাইল ফোন। কেউ ফোন করেছে তাকে, কিন্তু ডাকছে না। তাই সবুজ আলোটা বার বার জেগে উঠছে অকারণে।
কোথা থেকে জানি না, একটা বেড়াল দৌড়ে এল, তার পর থমকে দাঁড়াল ফুটপাতের কোণে। যেন চাপা পড়তে পারে, যে কোনও মুহূর্তে চলে আসতে পারে ঝাঁক ঝাঁক গাড়ি। বেড়াল কেটেছে, আমিও দাঁড়ালাম। গড়িয়াহাটের মোড় দেখতে পাচ্ছি দূরে। ফাঁকা রাস্তার শেষে কিছু বিক্ষিপ্ত হেডলাইটের জটলা। এর পর রাসবিহারীর রানওয়েটা নিজেই উড়ে গেছে বালিগঞ্জ স্টেশনের দিকে। সেখান থেকে এক জোড়া আলো সোজা দৌড়ে এল আমার দিকে। মুহূর্তের মধ্যে বেড়ালটা লাফ মারল রাস্তায়, ছিটকে গেল ও-পারে। জোরে ব্রেক কষল গাড়িটা একেবারে আমার সামনে। চোখাচোখি হল যিনি চালাচ্ছেন তাঁর সঙ্গে।
অন্ধকারে চিকমিক করছে কানের দুলটা। মুখে ড্যাশবোর্ডের আলো। ইঞ্জিনটা চালুই আছে, এ বার অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই। কাচটা নামল। একটাই শব্দ শুনলাম, ‘যাবেন?’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.