কেমিস্ট্রি ক্লাসে একটি ছেলেকে দেখে আর একটি মেয়ের অভ্যন্তরে পারমাণবিক বিস্ফোরণের আখ্যান। এ ধরনের কবিতা বা মেসেজে মুনশিয়ানা দু’রকম। এক তো এসএমএস ১৬০ ক্যারেকটারে শেষ করতে হয়। দ্বিতীয়ত, ছাপা কবিতায় আমি পুরোটা এক ঝলকে দেখতে পাই। আগুপিছু করে পড়তে পারি। কিন্তু মোবাইলে স্ক্রল করে নামতে হয়। একটি বা দুটি লাইন যখন পড়ছি, পরেরটি কী জানি না। ফলে পদে পদে রহস্য তৈরি করা যায়। কিছু কবিতার হাইকু-সদৃশ বাঙ্ময় পরিমিতি দেখে স্যামসন হতবাক হয়ে গেছিলেন। ফ্যানথোর্প-এর মনে হয়েছিল, কিছু কবিতা শেক্সপিয়রের মতো চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে পারো যদি আমার রহস্য উন্মোচন করো। ওঁরা বলেছিলেন, প্রতিযোগীরা বেশির ভাগ টিন-এজার হলেও, ভাষার উপর অসম্ভব দখল না থাকলে এ জিনিস করা যায় না।
ইন্টারনেট রিলে চ্যাট থেকে টেক্সটিং-এর শুরু। লক্ষ মাইল দূরে যখন একাধিক লোক রিয়েল টাইম মেসেজ লেনদেন করে, তখন স্পিডটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। টেক্সটিং আরও জমে উঠল মোবাইল আসার পর। মোবাইল ফোন তৈরি হয়েছিল ফোন করার জন্য, এসএমএস করার জন্য নয়। তাই QWERTY কি-বোর্ডের সুবিধা রাখা হয়নি। কোয়ার্টিতে sir লিখতে হলে তিন বার টিপলেই চলে, মোবাইলে দশ বার টিপতে হয়। খাটুনি কমাতে শর্টে মারা শুরু হয়।
ইনিশিয়ালিজ্ম ল্যাটিন এবং ইংরাজিতে দীর্ঘ দিন চলে আসছে। PM>Post Meridian, AD> Anno Domini, AKA>Also known as, LBW, PTO, PS, CD, DVD ইত্যাদি। সেই একই নিয়ম মেনে টেক্সটাররা তৈরি করেছেন bf> boy friend, gf> girl friend, lol> laughing out loud, asl> age, sex, location, ttt> to tell you the truth, hand> have a nice day.
আবার, টেক্সটাররা ভেবে পেলেন, ভাওয়েলের উপর ঝপাঝপ কোপ মেরে দিলেও মূল শব্দটি অনেক সময় চেনা যায়। যেমন, Txt> text, ezy> easy, msg> message, pls> please, spk> speak, wk> week, wknd> weeknd. কিন্তু কনসোন্যান্ট একমাত্র তখন বাদ দেওয়া যায়, যখন তা সাইলেন্ট বা প্রায়-সাইলেন্ট (wen> when, doin> doing, englis)। কিন্তু এগুলো কি খুব নতুন? Xmas, rly, rcpt, stn টেক্সটিং-এর আগে থেকে চলেছে। আর শব্দের যেখান-সেখান থেকে মুড়িয়ে দেওয়াও একটা পুরনো অভ্যেস। যেমন, Mr, Mrs, Kg, Ft, Sgt, Lft, Dpt, Asst, Jan, Dec.
কিন্তু শব্দের মধ্যে সংখ্যা ঢুকিয়ে দিয়ে টেক্সটাররা সত্যিই ভাষার একটা নতুন দিক খুলে দিয়েছেন। 4ever> forever, b4> before, 8> ate, d8> date, l8r> later, a3> anytime, anywhere, anyplace. শব্দের মধ্যে চিহ্ন ঢুকছে, thnk+> think positive, l%k^> look upwards. যা ছিল যতিচিহ্ন, পরিপূর্ণ শব্দ হয়ে যাচ্ছে। 2b o nt 2b dat s d?> to be or not to be that is the question.
এর ফলে চারদিকে একটা গেল-গেল রব উঠেছে ভাষার ভুস্টিনাশ হচ্ছে। বাচ্চারা ব্যাকরণ, বানান কিচ্ছু শিখছে না। ওস্তাদ টেক্সটাররা ব্যাকরণে ভালই দড়। তাই পরীক্ষার খাতায় এ সব লেখে না। ওরা জানে, এ সব করলে অচলায়তনে কাঁপন ধরে, বাবুদের রাগ হয়। আর এক দল অবশ্যই আছে, যারা ইংরেজিটা জানে না বলে যা খুশি লিখে দেয়। এরা টেক্সটিং-এর আগেও ছিল, পরেও থাকবে।
এমনও দেখেছি, সন্তান যদি টেক্সটিং ল্যাঙ্গুয়েজে মেসেজ করে তো বাবা-মা গোটা গোটা ইংরেজিতে উত্তর দেন। এটা বোঝাতে যে, তোমরা কালাপাহাড় আর আমরা ঐতিহ্য ধরে রাখছি। এই কল্পিত ক্রুসেডে হাসি পায়। lol! lol! Laughing out louder! উলটোটা করুন, দেখবেন ওরা মুহূর্তে বন্ধু বলে আপনাকে মেনে নেবে। ধরতে অসুবিধে হলে নেটে ঢুকে যে কোনও cyberspeak ডিকশনারির সাহায্য নিন। দু’দিনে অভ্যেস হয়ে যাবে। হতেই হবে। ছেলে যদি কোনও বান্ধবীকে মেসেজ করে prw, তা হলে আপনাকে তো বুঝতে হবে, ও বলছে parents are watching. ধমকে ওদের থামানো যাবে না। যাঁরা ধমকাচ্ছেন, তাঁরা ক’জন এক পাতা ইংরিজি কি বাংলা ঠিকঠাক লিখতে পারেন? এই ভণ্ডামি ওরা বুঝতে পারে।
আসল কথা হল, ব্যাকরণ মেনে ভাষা এগোয় না, এগোয় ব্যাকরণ ভেঙে। হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),/ হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না। এই কবিতায় আপ্তবাক্য ওই একটাই। বাকিটা শুধু মজা। ভাষা নিয়ে খেলার মধ্যে একটা নির্মল মজা আছে। একটি বাচ্চা যখন কথা বলতে শেখে, তার চোখে-মুখে এই আনন্দ ফুটে ওঠে। জুলিয়া-র কবিতাটি পড়ে কট্টর টেক্সটিং-বিরোধী মানুষও যদি একটু হেসে না থাকেন, তা হলে তাঁকে গোমড়াথেরিয়াম ছাড়া আর কিছু বলার নেই। আজ যদি এডওয়ার্ড লিয়ার, দাদাঠাকুর কি সুকুমার রায় বেঁচে থাকতেন তো টেক্সটিং ল্যাংগোয়েজে ফুল ফুটিয়ে ছেড়ে দিতেন।
টেক্সটাররা মাঝেমধ্যে ফুল ফোটাচ্ছেন। kiss-এর বদলে x, said-এর বদলে z এবং at-এর বদলে @, কে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন জানি না, এগুলো স্ট্রোক অফ জিনিয়াস। একই রকম বৈপ্লবিক হচ্ছে oo-র বদলে % বসানো। যেমন look> l%k, could> c%d, soon> s%n. oo এবং %-এর মধ্যে দুটো গোল্লার যে রূপগত সাদৃশ্য আছে, সেটাকে মেলাতে গ্রাফিক কল্পনার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। oo-র উচ্চারণ হয় উ। জুলিয়ার কবিতাটিতে তাই blue হয়েছে bl%.
গ্রাফিক কল্পনা সত্যিকারের পাখা মেলেছে ইমোটিকনে। যেমন, happy বোঝাতে :-), sad বোঝাতে :-(, কারণ এগুলো ক্লকওয়াইজ ঘুরিয়ে দিলে হাসি-হাসি আর গোমড়া দেখায়। আরও কিছু মজার উদাহরণ হল ~,~ মানে napping, {} মানে hugging, ><> মানে fish ইত্যাদি।
টেকনোলজি বার বার ভাষা এবং সংস্কৃতির খোলনলচে পালটে দিয়েছে। গুটেনবার্গ মুভেব্ল টাইপ আনার আগে লিপিকররা হাতে বই কপি করতেন। তাতে প্রচুর সময় ও মেহনত লাগত। উডব্লকে কিছু বই ছাপা হত। অর্থাত্, একটা বইয়ে ৩০০০ পাতা থাকলে ৩০০০টা উডব্লক তৈরি করো। প্রতি পাতায় একটা করে প্রুফ কারেকশন হলে আরও হাজারটা উডব্লক বানাও। সব মিলিয়ে সে এক বিকট ব্যাপার। ফলে তখন আজকের মতো গন্ডায় গন্ডায় গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের বই হত না। কে অত কপি করবে? হত শুধু পুরাণ, পুঁথি, ধর্মীয় গ্রন্থ আর উপাখ্যান। বইয়ের অভাবে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি দু-একটা টিমটিম করত। সাধারণ মানুষ লিখতে-পড়তে শিখত না। তাদের মনে রাখার সুবিধার জন্য পদ্য ও সুরের দরকার হত। ঘরোয়া চিঠিপত্র বা সরকারি কাজে এক ধরনের প্রত্নগদ্য ব্যবহার হত। মুভেব্ল টাইপ আসার পর বই সুলভ হল। সর্বঘটে পদ্যের প্রয়োজন ফুরোল। গদ্য উন্নত হতে শুরু করল। তার উপর ভিত্তি করে ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ফর্ম হিসেবে দাঁড়াতে পারল। বুর্জোয়া উদ্যোগপতিরা দুনিয়াকে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, খবরের কাগজ উপহার দিয়েছে। এখানেও শ্রীরামপুরের পাদরিরা ছাপাখানা না করলে বই হত না। বই না হলে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ কিস্যু হত না। ক’টা মুভেব্ল টাইপের এত দম!
পিসি, মোবাইল এবং ইন্টারনেট মুভেব্ল টাইপ এড়িয়ে নিজস্ব প্রকাশকে হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। আর বছর দশেকের মধ্যে কাগজ-কলমে লেখা উঠে যাবে। কাগজ আসার পর ঠিক যেমন ছেনি-বাটালি দিয়ে পাথরে লেখা ছেড়ে মানুষ কলম ধরেছিল। এতে :-(থেকে :-) বেশি। একশো পাতার একটা বই লিখতে এবং লাখ কপি ছাপতে ক’টা গাছ নষ্ট হয়, সেই হিসেব তো কেউ করে না। কলমের বদলে পিসি, মোবাইল, বিভিন্ন ডিজিটাল গ্যাজেট যদি লেখার মূল অস্ত্র হয় তো টেক্সটিং বাড়বে। সেটাই হয়ে উঠবে ভাষা বিবর্তনের প্রাইম মুভার। যেমন মুভেব্ল টাইপ গদ্যভাষার জন্ম দিয়েছিল।
ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো তো বটেই, চিন, জাপান, কোরিয়া, ইরান, সেনেগাল সর্বত্র টেক্সটিং ছড়িয়ে পড়ছে হু-হু করে। বাংলাকে যদি টিকতে হয় তো টেক্সটিং-এ যেতে হবে। রবি ঠাকুর-রবি ঠাকুর করে বাংলা বাঁচবে না। সাহিত্য দিয়ে কোনও ভাষা বাঁচে না। সবচেয়ে মহত্ সাহিত্যগুলো ল্যাটিন ও সংস্কৃতে রচিত হয়েছে। অথচ দুটোই মরে গেল। কারণ, যে ভাষায় মানুষ কথা বলছিল, যে ভাষা প্র্যাকটিস করছিল, তার থেকে ওরা দূরে চলে গিয়েছিল। ভাষার শক্তি বোঝা যায় তার সজীবতায়, রক্ষণশীলতায় নয়।
ইংরেজি বর্ণমালার সুবিধা: তার কিছু কিছু বর্ণ একটা ধ্বনিও বটে, আবার শব্দও বটে। যেমন, b> be বা bee, c> see বা sea, d> the, i> eye, p> pea বা pee, q> queue, r> are, t> tea, u> you, y> why. বাংলায় এই সুবিধা নেই। একমাত্র ঐ> ওই, চ> চল, থ> থম আর হ> হও বাদে। পিপুফিশু> পিঠ পুড়ছে ফিরে শুই, পিএনপিসি> পরনিন্দা পরচর্চা, এমবিবিএস> মা বাবার বেকার সন্তান এ রকম কিছু শব্দ দূরবিন দিয়ে দেখতে হয়। শব্দকে ভেঙে দেওয়ার উদাহরণও কয়েকটি মাত্র সেন্টু, ক্যালি, ফান্ডা, ট্যান হয়ে যাওয়া। চমকে দেওয়ার মতো সংক্ষিপ্তকরণ হল 52> বাঙাল, 5=E, 2= B. বা ১2> একটু।
বাংলায় যদি না কুলোয় তো ওড়িয়া, অহমিয়া, হিন্দি, ইংরিজি থেকে নিতে হবে। টেক্সটিং একটি মাল্টিলিংগুয়াল অ্যাক্টিভিটি। বিশেষত ইংরেজির প্রভাব সব ভাষার টেক্সটিং-এ দেখা যাচ্ছে। ড্যানিশ, জার্মান-এ ilu, omg> oh my god ঢুকে যাচ্ছে। এমনকী যাদের লিপি রোমান হরফের থেকে বহু দূরে, সেই চিনা এবং ফার্সি টেক্সটিং-এও ইংরেজির ছায়া পড়ছে।
শিক্ষাব্যবস্থার এখানে একটা দায়িত্ব থেকে যায়। অস্ট্রেলিয়ায় আট থেকে দশ বছরের বাচ্চাদের মধ্যে মূল ইংরেজির পাশাপাশি টেক্সটিং ল্যাংগোয়েজকে অপশন হিসেবে রাখা হচ্ছে। প্রশ্নপত্রে একটা অনুচ্ছেদ দিয়ে, সেটাকে টেক্সটিং ল্যাংগোয়েজে লিখতে বলা হচ্ছে। আবার টেক্সটিং প্যারা থেকে সাবেকি ইংরেজিতে অনুবাদ করানো হচ্ছে। দুটোকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করতে বলা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, তাতে বাচ্চাদের ভাষার উপর দখল বাড়ছে। কারণ, ওরা এটাকে খেলা এবং মজা হিসেবে নিচ্ছে, দারুণ উদ্ভাবনী শক্তি দেখাচ্ছে। এটা এখানে চালু করা উচিত। অসুবিধা একটাই। এখানে মাস্টারমশাইরা গতে বাঁধা পড়ানোতে অভ্যস্ত। খালি গেলো আর ওগরাও। মজা? মজা তোমার বার করে দেব। তোমার জন্ম কেরানি হওয়ার জন্য। সামাজিক ক্ষমতার অলিন্দে যে প্রজন্ম এখন ঘোরাফেরা করেন, তাঁরা না ম’লে এই জগদ্দল পাথর সরবে না, ভাষার মুক্তি সম্ভব হবে না। আজ যাদের বয়স পঁচিশের নীচে, তারা ক্ষমতায় এলে অবশ্য এটা জলচল হয়ে যাবে।
যদ্দিন তা না হচ্ছে, মিডিয়া এগিয়ে আসতে পারে। কাগজগুলো এসএমএস প্রতিযোগিতা আয়োজন করে দেখতে পারে কী দাঁড়ায়। কারণ, এদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। উত্সাহ দেওয়া দরকার। জোর গলায় বলা দরকার ইলু! ইলু! আই লাভ ইউ টেক্সট জেনারেশন।
|