বাঁ পায়ের অস্ত্রোপচারের জন্য ভর্তি হয়ে ডান পায়ে অস্ত্রোপচার করিয়ে ফিরেছিলেন প্রবোধ চৌধুরী। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ঘটেছিল ওই চিকিৎসা-বিভ্রাট। গত ডিসেম্বর মাসের এই ঘটনা সম্পর্কে তিনি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন স্বাস্থ্য ভবনে। তার পরে দু’মাসের বেশি কেটে গিয়েছে। প্রবোধবাবু কোনও জবাব পাননি।
পেটের সংক্রমণের জন্য গত সেপ্টেম্বরে সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন চঞ্চলা চট্টোপাধ্যায়। আট দিনে তাঁর হাসপাতালের বিল হয়েছিল ৭২ হাজার টাকা। অথচ, জেনারেল ওয়ার্ডেই ভর্তি ছিলেন তিনি। অস্বাভাবিক বিলের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের পাশাপাশি চঞ্চলাদেবী অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন স্বাস্থ্য ভবনেও। ছ’মাসেও কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
এমন নজির ভূরি ভূরি। অভিযোগ, বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য দফতরে অভিযোগ জমা পড়লে নৈঃশব্দ্য ছাড়া বিশেষ কোনও উত্তর জোটে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। কলকাতার বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের অপারেশন থিয়েটারে সরঞ্জাম সংস্থার প্রতিনিধি অস্ত্রোপচার করছেন এমন অভিযোগ জমা পড়ার পরেও মাসখানেক কেটে গিয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ভবন থেকে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরে থাক, কোনও খোঁজখবরও করা হয়নি এ বিষয়ে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তা হলে স্বাস্থ্য দফতরে অভিযোগ জানানোর যৌক্তিকতা কোথায়? স্বাস্থ্যকর্তাদের একটি বড় অংশই মেনে নিয়েছেন বেসরকারি হাসপাতালগুলির উপরে তাঁদের কার্যত কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই। ‘ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাক্ট’ না-মানলে লাইসেন্স বাতিলের মতো কিছু অস্পষ্ট নিয়মের অস্তিত্ব রয়েছে ঠিকই, কিন্তু আদতে তা কোনও কাজে আসে না বললেই চলে।
স্বাস্থ্য দফতরের ভার নেওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেসরকারি হাসপাতালগুলির উপরে নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। পরিষেবার মান যথাযথ রাখার ব্যাপারে কয়েক দফায় স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালগুলির কর্তাদের বৈঠকও হয়েছিল। বিশেষত সরকারের কাছ থেকে জমি বা অন্য নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করেছে যে সব হাসপাতাল, তারা যাতে রোগীদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে তা নিশ্চিত করার পন্থা সম্পর্কে ভাবনাচিন্তাও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার পরে বিষয়টি আর এগোয়নি। যদিও স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী নিজে বেসরকারি হাসপাতালগুলির কাজকর্মের উপরে লাগাম পরানোর পক্ষপাতী। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে তো দৈনন্দিন কাজের হিসেব রাখা সম্ভব নয়। পরবর্তী স্তরগুলিতে এ ব্যাপারে সক্রিয়তা প্রয়োজন। সেটাই হয় না।”
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের কোনও চিকিৎসকের ব্যাপারে অভিযোগ থাকলে তা মেডিক্যাল কাউন্সিলে জানানো যায়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করতে পারে কাউন্সিল। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ থাকলে তা বিবেচনা করার এক্তিয়ার কাউন্সিলের নেই। সে ক্ষেত্রে তা হলে ভুক্তভোগীরা কী করবেন? স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য দফতরে অভিযোগ জানানো যায়। কিংবা ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতেরও দ্বারস্থ হতে পারেন ভুক্তভোগীরা।
স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র সুমন বিশ্বাসের কথায়, “ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাক্টটাই এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য দফতরের হাতিয়ার। নিয়মকানুন না মেনে প্রতিষ্ঠান চালানো কিংবা রোগীর সম্মতি না নিয়ে কোনও ধরনের চিকিৎসা ইত্যাদির অভিযোগ এলে সরকারি তরফে তদন্ত শুরু হয়। তবে বেসরকারি হাসপাতালের পরিষেবা পেতে রোগীদের মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়। তাই পরিষেবা মনঃপূত না হলে বা অস্বাভাবিক বিল সংক্রান্ত অভিযোগ থাকলে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে যাওয়াই ভাল।”
অর্থাৎ, কলকাতার বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে রোগীর ফিমার বোনে সরঞ্জাম সংস্থার কর্মী ধাতব পাত বসাচ্ছেন বলে সম্প্রতি যে অভিযোগ উঠেছে, তার নিষ্পত্তির জন্য ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতের দিকেই তাকিয়ে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। প্রশ্ন উঠেছে, বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতা নিয়েও। কলকাতার ওই বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের অর্থোপেডিক রণজিৎ দত্ত অপারেশন থিয়েটারে বহিরাগতের উপস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবাদ জানিয়ে নিজে চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, রাতারাতি তো কোনও সরঞ্জাম সংস্থার প্রতিনিধি ওটি-তে ঢুকে অস্ত্রোপচার শুরু করে দেননি। ওই ‘প্র্যাকটিস’ নিশ্চয়ই আগেও ছিল। তা হলে আগে তিনি বা তাঁর সতীর্থেরা কোনও প্রতিবাদ করেননি কেন? দীর্ঘদিন সরকারি হাসপাতালে কাজ করার পরে বেসরকারি হাসপাতালে যোগ দিয়েছিলেন রণজিৎবাবু। তাঁর কথায়, “এক দিনে কোনও কিছুই হয় না। দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকা ক্ষোভেরই পরিণতি ওই ইস্তফা। এতে অন্য চিকিৎসকদের মধ্যেও প্রতিবাদের সাহস তৈরি হবে বলে আমার আশা।” |