|
|
|
|
জীবনের সঞ্চয় দিয়ে ভাষা স্মারক শিক্ষকের |
উত্তম সাহা • শিলচর
২১ ফেব্রুয়ারি |
সারা জীবনের সঞ্চয় ভেঙে ভাষা শহিদ-স্মারক তৈরি করলেন অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক প্রমাংশু দত্ত। ভাষা-শহিদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এই অঞ্চলে বা এর বাইরে প্রচুর স্মারক গড়ে উঠেছে বটে, কিন্তু এমনটা কোথাও দেখা যায়নি। শুধু কি আর শহিদ স্মারক? এই উপলক্ষে সম্পূর্ণ নিজের খরচে ‘বীক্ষণ’ নামে একটি স্মরণিকাও ছাপিয়েছেন প্রমাংশুবাবু। মোট খরচ ১০ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
৫০ ফুট দীর্ঘ ও ৩৫ ফুট প্রশস্ত এলাকা জুড়ে সুদৃশ্য বেদি। এর উপর ফাইবার গ্লাসে নির্মিত স্মারক। আজ করিমগঞ্জ জেলার জফরগড় এম ই স্কুলের জমিতে এর আবরণ উন্মোচন করেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সোমনাথ দাশগুপ্ত। সঙ্গে স্মরণিকার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটান করিমগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ রাধিকারঞ্জন চক্রবর্তী। এই স্মারক উন্মোচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষ শোভাযাত্রা, ভাষা বিষয়ক ক্যুইজ প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেন। রাজ্যের সমবায় এবং সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন মন্ত্রী সিদ্দেক আহমেদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রমাংশুবাবু বলেন, “আমি অকৃতদার। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত পেনশন পেয়ে যাব। তাই ভাষা শহিদদের স্মৃতিতে কিছু করতে চেয়েছিলাম। এটি আচমকা কোনও পরিকল্পনা নয়।” তাঁর ইচ্ছে ছিল, মা আমোদিনী দত্তকে দিয়ে এর উন্মোচন করাবেন। কিন্তু দু’বছর আগে মায়ের মৃত্যু হয়। আর দেরি করতে চাননি। কথা বলেন কলকাতার কুমোরটুলিতে। বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষার জন্য বারবার প্রাণদানের ঘটনাগুলি টেনে তিনি বলেন, “এমনটা ইতিহাসে বিরল। ১৯৬১-র একাদশ ভাষাশহিদ, ’৭২-এর বিজন চক্রবর্তী, ’৮৬-র জগন-যিশু এবং ’৯৬-এর ভাষা আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী তরুণী সুদেষ্ণা সিংহ। বরাকের সেই ১৫ জন ভাষাশহিদের স্মরণেই এই স্মারক।”
১৯৬১-র স্মৃতি আউড়ে বদরপুর নবীনচন্দ্র কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রমাংশুবাবু জানান, “সে আন্দোলনে বারইগ্রাম ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। অন্যান্যদের সঙ্গে আমিও ১৯ মে তারিখে ট্রেন আটকে দিই। রাতে শিলচরে গুলি চালনার খবর পাই। তখন মনের যে কী অবস্থা হয়েছিল ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বরাক উপত্যকার প্রতিটি পরিবার এমনই একাত্ম হয়ে উঠেছিল যে ২০ মে অরন্ধন ঘোষণা হলে সমস্ত বাড়িঘরেই উপবাস পালিত হয়। এমনকী চাষিরা সে দিন মাঠে পর্যন্ত যাননি!”
এ দিকে আজ ভাষা শহিদ দিবস উপলক্ষে গুয়াহাটিতে শুরু হল তিন দিনের ভাষা সংস্কৃতি মিলনোৎসব। বাংলা ও অসমিয়া ছাড়াও বড়ো, কার্বি, মিসিং, ডিমাসা, মণিপুরিসহ বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ এই উৎসবে অংশ নেন। এদিনের আলোচনার বিষয় ছিল ‘সাহিত্য ও বর্তমান প্রজন্ম’। আলোচনায় অংশ নেন অসম, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও দিল্লির শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবিরা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান আকর্ষণ পূর্ণদাস বাউল, বাংলাদেশের সির্দ্ধাথ বিশ্বাস। ‘একুশে সম্মান’ দেওয়া হবে কবি আনিস-উজ-জামান ও কন্ঠশিল্পী পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মরণোত্তর ‘একুশে সম্মান’ পাচ্ছেন শিবপ্রসাদ লোধ। গুয়াহাটির পাশাপাশি, বরাক উপত্যকাতেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভাষা দিবস পালিত হয়।
ভাষা দিবসে শঙ্করদেব মিশন শঙ্কর-সাহিত্য অনুবাদের জন্য সম্বর্ধনাও দিলেন। এদিন সকালে গুয়াহাটি প্রেস ক্লাবে এক আলোচনায় অংশ নেন সাহিত্যসভার প্রাক্তন সভাপতি তথা শঙ্করদেব মিশনের সভাপতি কনকসেন ডেকা, রাধিকামোহন ভাগবতী, সুরেন্দ্রনাথ বরা, শক্তিময় দাস। শক্তিময়বাবু সম্প্রতি প্রাচীন বৈষ্ণব সাহিত্যের চারহাজার পাতার কাব্যিক ‘চার-শাস্ত্র’ (কীর্তনঘোষা, নামঘোষা, ভক্তিরত্নাবলী এবং শ্রীমদভাগবতের দশম স্কন্দ) বাংলায় অনুবাদ করেন। কনকসেন ডেকা শক্তিময়বাবুকে সম্বর্ধনা দিয়ে বলেন, “অসমিয় ভাষা, বাংলা, ব্রজবুলির জ্ঞান ও বৈষ্ণব সাহিত্যের জ্ঞান ভিন্ন এই কাজ সম্ভব ছিল না। এই অনুবাদ কেবল অসম ও বাংলার সেতু মজবুত করল তাই নয়, আজ এক ইতিহাসও রচিত হল।” |
|
|
|
|
|