বাংলাদেশে ভাষা শহিদ দিবসের আবেগের মধ্যেও মৌলবাদের চোখরাঙানি।
সারা দেশের শহরে-গ্রাম, স্কুল-কলেজে হাজার হাজার মানুষ যখন শহিদ বেদিতে ফুল দিয়ে ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, পাবনা ও কুষ্ঠিয়ায় তখন রাতের অন্ধকারে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে একের পর এক শহিদ বেদি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই দুষ্কর্ম নজরে পড়ার পরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সাধারণ মানুষ। ভাঙা শহিদ বেদিকেই ফুলে-মালায় সাজিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা একুশে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার চত্বর প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী নেত্রী বেগম রওশন ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া শ্রদ্ধা জানানোর পরে নানা সংগঠনের প্রতিনিধিরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের এই শহিদ মিনারের এসে পুষ্পস্তবক দেন। তার পরে হাল্কা ঠান্ডার আমেজে রাতের ঢাকার সব রাস্তা এসে মিলে যায় ভাষা-শহিদ মিনারে। খালি পায়ের জনস্রোত বয়ে চলে হাতে ফুল নিয়ে। শক্রবার বিকেল পর্যন্ত শহিদ মিনার চত্বর মেতে থাকে অসাম্প্রদায়িক মানুষের উৎসবে। জমজমাট একুশের বইমেলাও। বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদেই রয়েছে ভাষা শহিদদের স্মরণ-বেদি। একুশের সকাল থেকে সে সবও সেজে ওঠে শ্রদ্ধার ফুলে। |
ব্যতিক্রম পাবনার চাটমোহর ও কুষ্ঠিয়ার কুমারখালি উপজেলা। বুধবার রাতেই এই দুই এলাকার চারটি স্কুলের শহিদ বেদি কার্যত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা। বৃহস্পতিবার সকালে সাধারণ মানুষ এ জন্য ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ভাঙা শহিদ বেদিই সাজিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার মধ্যেই বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আরও দু’টি স্কুলের শহিদ বেদিতে ভাঙচুর করা হয়। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কথায়, জঙ্গি মৌলবাদীরাই চাটমোহর ও কুমারখালিতে এই দুষ্কর্ম করেছে। তারা যে লড়াইয়ে ক্ষান্তি দিতে নারাজ, এ ভাবে ভাষা-চেতনার গোড়ায় আঘাত হেনে পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদীরা তা বুঝিয়ে দিল। ইনু বলেন, এর আগে শাহবাগ আন্দোলনের সময়ে হেফাজতে ইসলামির নামে জামাতে ইসলামির দুষ্কৃতীদের রোষে ধূলিস্যাৎ হয়েছিল একের পর এক শহিদ মিনার। এর পরে তারা শক্তি প্রদর্শনের জন্য এ বারের একুশের দিনক্ষণ বেছে নিয়েছে। ইনু বলেন, “এই হামলা বাংলাদেশের মানুষের চোখ খুলে দিল। দেশের সরকার দখল করে যাঁরা ভাবছেন লড়াই শেষ, মৌলবাদীরা তাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রাখল।”
এক দিকে মৌলবাদের আস্ফালন, অন্য দিকে প্রাণঢালা আবেগ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শিবগঞ্জে ‘বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প সংস্থা’র গুদাম। ধারেকাছে কোনও শহিদ বেদি নেই। কাজেও ছুটি মেলে না যে ছ-সাত কিলোমিটার উজিয়ে গিয়ে ফুল দিয়ে আসবেন শ্রমিকেরা। একুশের সকালে সারা দেশ ভাষা-শহিদদের স্মরণ করে, কিন্তু তাঁদের সে উপায় নেই। বৃহস্পতিবার বিকেলে তাই চটজলদি জোট বেঁধেছিলেন সার গুদামের শ্রমিকেরা। সেখানেই কেউ প্রস্তাব দেন, আর বাকিরা উৎসাহে সায় দেন তাতে। গুদাম চত্বরেই তিনটে কাটা কলাগাছ মাটিতে পুঁতে বানানো হয় অস্থায়ী শহিদ বেদি। শুক্রবার সকালে শ্রমিক পরিবারের কয়েকশো মানুষ খালি পায়ে হাঁটে এসে তাতেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...আমি কি ভুলিতে পারি?’ |