গলার স্কার্ফটা রক্তে ভেজা। রক্তের ছিটে সাদা জামাটাতেও। হাত দিয়ে কোনও মতে গলার কাছটা চেপে ধরেছেন তরুণী। আঙুল দিয়ে চুঁইয়ে গড়াচ্ছে রক্ত।
সাদা জামার এই বছর একুশের যুবতীই এখন ইউক্রেনের বিদ্রোহী-মুখ। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর ছবি ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। সেই সঙ্গে শেয়ার আর কমেন্টের বন্যা।
শুধুমাত্র কালই ইন্ডিপেনডেন্স স্কোয়ারের পুলিশি-সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ৭০ জন বিক্ষোভকারী। রবার-বুলেটের বদলে সেনা যুদ্ধাস্ত্র তুলে নিতেই পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়ায়। বিদ্রোহীদের অভিযোগ, পেশাদার বন্দুকবাজ দিয়ে দেশের মানুষকে খুন করিয়েছে সরকার। দিনের শেষে তাই কিয়েভের রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায় মৃতদেহের সারি। আহত আরও হাজার খানেক।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ আজ অবশ্য খানিকটা নরম হয়েছেন। ইয়ানুকোভিচ ও বিরোধীদের সঙ্গে ম্যারাথন বৈঠকের শেষে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা জানান, এ হেন অচলাবস্থা নিয়ন্ত্রণে একটি “অস্থায়ী” শান্তিচুক্তিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সই করেছেন তিন পক্ষই। ইয়ানুকোভিচ আশ্বাস দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এগিয়ে আনা হবে। তবে ভোটের দিনক্ষণের কোনও উল্লেখ করেননি তিনি। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, সংবিধান সংস্কার কিংবা ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠনের উপরেও জোর দেবেন তাঁরা। |
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ছড়িয়েছে এই ছবি। |
তবে এই প্রতিশ্রুতির ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকেই।
আপাতত গত কালকের ঘটনা নিয়ে সরগরম ইউক্রেন তথা গোটা দুনিয়া। বিশেষত স্নাইপার হানা নিয়ে। বিরোধীদের দাবি, বহুতলগুলোর ছাদ থেকে সরকারের নিযুক্ত পেশাদার বন্দুকবাজরা নিশানা করেছিল বিক্ষোভকারীদের। তাঁদের যুক্তি, যাঁরা মারা গিয়েছেন, প্রত্যেকেরই হয় মাথায়, নয় ঘাড়ে, না হয় বুকে ঠিক একটি করে বুলেটের ক্ষত রয়েছে। পেশাদার খুনি ছাড়া এ কাজ হতে পারে না।
এমনই এক নিশানা হয়ে উঠেছিলেন ২১ বছরের ওলেসিয়া জুকোভস্কা। পেশায় চিকিৎসক। সেই নভেম্বর মাস থেকেই সরকার-বিরোধী সংঘর্ষের অংশীদার তিনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে না গিয়ে রাশিয়ার দিকে ঝোঁকেন ইয়ানুকোভিচ। তখনই দানা বাধে ক্ষোভ। যে কোনও বিক্ষোভে স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসক হিসেবে ছুটে যেতেন ওলেসিয়া। জানুয়ারিতে নিজের শহর ক্রেমেনেটস-এ ফিরে গিয়েছিলেন। নতুন করে কিয়েভ উত্তপ্ত হচ্ছে খবর পেয়ে দু’দিন আগেই রাজধানীতে ফিরে আসেন। গত কালও ইন্ডিপেনডেন্স স্কোয়ারের সামনে থেকে কিছু ক্ষণ অন্তর টুইট করছিলেন। গুলি লাগার মিনিট ২০ আগে টুইট করেন, “আপনাদের সমর্থন প্রয়োজন। আজ সকাল থেকে ফের হিংসা-হানাহানি শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি খুব খারাপ দিকে গড়াতে পারে।” তখনও জানেন না ওলেসিয়া, আর মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে ঠিক কী ঘটতে চলেছে।
ওলেসিয়ার এর পরের টুইটটাই ছিল, “আমি মরতে চলেছি।” টুইট করার কিছু ক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারান তিনি। বন্ধুরা কোনও মতে নিয়ে যান স্থানীয় হাসপাতালে। অস্ত্রোপচারে এ যাত্রা রক্ষা পেয়েছেন তিনি। কিয়েভের রাস্তায় পড়ে থাকা নিহত ওই বিক্ষোভকারীদের মতো পরিণতি হয়নি তাঁর। আইনসভার সদস্যা আইরিনা হেরাশচেঙ্কো তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনিই পরে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “ওলেসিয়ার জ্ঞান ফিরেছে।”
কিন্তু সরকারের কি টনক নড়েছে? যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ রাজধানী কিয়েভকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছিল, তার কী অবসান ঘটতে চলেছে? ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দেশগুলো বলছে, ইউক্রেন সমঝোতার পথে হেঁটে ভাল করেছে। তবে বাস্তবে কী ঘটতে চলেছে, তা বলবে সময়ই। |