ছিয়াত্তর মিনিটের মাথায় প্রেসবক্স থেকে প্রথম দেখা গেল তাঁকে। চার্চিল রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে উঠে এসে শাবানাকে কিছু বললেন সুভাষ ভৌমিক। বাধ্য ছাত্রের মতো টিডির কথা শুনে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে গেলেন সুভাষের মিশরীয় মিডিও।
কী বলছিলেন? খেলা শেষে চার্চিল টিডি বলছিলেন, “যুবভারতীর কৃত্রিম মাঠে শিশির পড়ায় বল দ্রুত দৌড়াচ্ছিল। বলের দখল হারিয়ে তাই মাথা গরম করছিল শাবানা। ওকে সেটাই বলছিলাম।” এখানেই না থেমে নিউ আলিপুরের বাসিন্দা চার্চিল টিডি বললেন, “লম্বা লিগে এখন আমাদের একটাই লড়াই। তা হল অবনমন বাঁচানো।”
আই লিগের শুরুতে প্রথম নয় ম্যাচের পর এক পয়েন্ট নিয়ে সুভাষের দল দাঁড়িয়ে ছিল লিগ তালিকার শেষের দিকে। এ দিনের ম্যাচের পর লেনি-বলবন্তদের পয়েন্ট ১৫ ম্যাচে ১৪। মঙ্গলবার সকালেই চার্চিল হোটেলে আসে দুঃসংবাদ। গোয়ার বাড়িতে প্রয়াত হয়েছেন রাইট ব্যাক ডেঞ্জিল ফ্রাঙ্কোর বাবা। মাঠে নামার আগে শাবানারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জিততে না পারলেও হারা চলবে না। এক পয়েন্ট হলেও চলবে। সেটাই হবে ডেঞ্জিলের প্রয়াত বাবার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। |
সেই শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন হল। আটকে গেল ইস্টবেঙ্গল। যার পর যুবভারতী ফেরত লাল-হলুদ জনতার মনে প্রশ্ন, আর্মান্দো কোলাসোর পথ থেকে আই লিগ কি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে?
আর্মান্দো যদিও বলছেন, “আই লিগ জয়ের আশা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। লম্বা লিগে কখন কী হয় কে বলতে পারে? পরবর্তী ডেম্পো ম্যাচটা ভাইটাল হয়ে গেল। সেটা না জিতলে কিন্তু মনোবল কমবেই। তখন লিগ জয়ের লড়াইতে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে।”
যে ম্যাচ জিতে ফেরার কথা সেই ম্যাচ ড্র করে কোচের চিন্তা বাড়িয়ে দিলেন চিডি-মোগারা। ভারতীয় ফুটবল চষে ফেলা সুভাষ জানতেন মেহতাব-তুলুঙ্গারা ছোট-ছোট পাসেই তাঁর দূর্গে ফাটল ধরাতে পারেন। তাই শুরু থেকেই মাঝমাঠে বল তাড়া করে লাল-হলুদের মিডফিল্ড প্ল্যানের সাড়ে বারোটা বাজানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁর। সুভাষের এই টোপ শুরুতে প্রায় গিলে ফেলেছিলেন আর্মান্দো। শাবানা, লেনি, উলফদের প্রথম পনেরো মিনিটের ঝাঁকুনি সামলাতে এই সময় লং বল খেলার দিকেই ঝুঁকল লাল-হলুদ। ঠিক যা চাইছিলেন চার্চিল টিডি। এতে তাঁর দু’টো সুবিধা হয়ে গেল।
এক) বিপক্ষের ডিফেন্সিভ থার্ডে স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মোগা-চিডি জুটিকে বোতলবন্দি করে রাখলেন চার্চিলের দুই স্টপার সঞ্জয় বালমুচু এবং রাবণন ধর্মরাজ।
দুই) লাল-হলুদ রক্ষণ থেকে উড়ে আসা বল নিজেদের মিডল থার্ডে থামানোর পর সেকেন্ড বল ধরে পাল্টা আক্রমণ শাণালেন লেনি রডরিগস।
যে দুই চালে তিরিশ মিনিট ইস্টবেঙ্গল ফ্যাকাশে। এ সব ক্ষেত্রে ম্যাচ ঘোরানোর ‘পাসওয়ার্ড’ থাকে দলের আক্রমণাত্মক মিডিও-র ওপর। যে বল ধরে পনেরো-বিশ গজের সোলো রানে ঘাম ছুটিয়ে দেবে বিপক্ষ রক্ষণের। কিন্তু লাল-হলুদে সেই ভূমিকায় থাকা জাপানি সুয়োকার অবস্থা দেখা গেল তাঁর ভারতীয় সতীর্থদের চেয়েও খারাপ। না আছে বল কন্ট্রোল, না আছে টার্নিং। কাফ মাসলে চোটের পর উইথ দ্য বল দৌড়টাও উধাও। পরিচিত ড্রিবলও অদৃশ্য। সুয়োকার ফুটবলে এখন খালি ব্যাক পাস আর স্কোয়ার পাসটাই পড়ে রয়েছে। |
একদা গুরু-শিষ্য এক ফ্রেমে। ম্যাচের পর তুলুঙ্গা ও সুভাষ। |
আর্মান্দো বলছেন, “ফুটবলারদের কয়েক জন তো স্বার্থপরের মতো খেলছে। পাস দিতে চাইছে না।” কোচ নাম না বললেও ইঙ্গিতটা চিডির দিকে। পেনিট্রেটিভ জোনে মোগাকে পাস দেওয়ার বদলে শট মারতে বেশি ঝুঁকছেন তিনি। আর করমর্দনের দূরত্বে দাঁড়িয়ে প্রথমার্ধে যে বল দ্বিতীয় পোস্টে রাখলেই গোল, সেটাও দিব্য মিস করে লাল-হলুদের আই লিগ অভিযান জটিল করে তুললেন। যে চিডি কয়েকদিন আগেও শুনে এসেছেন,
“এ বি সি ডি
গোল করবে চিডি,”
তাঁকেই আজ শুনতে হল, ‘এ বি সি ডি
ঘাস ছিঁড়ছে চিডি।’
দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য ম্যাচে ফিরেছিল ইস্টবেঙ্গল। লেনকে নামিয়ে তিন ফরোয়ার্ডে চলে গেলেন আর্মান্দো। কিন্তু তাতে আক্রমণে ঝাঁঝ বাড়লেও মহার্ঘ্য গোল আর আসেনি। মেহতাবরা তখন বল ধরে খেলা শুরু করেছিলেন। লাল-হলুদকেও জার্সির রঙের মতো উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। আর্মান্দোর উচিত ছিল তখন সুয়োকাকে তুলে লোবোকে নামানো। তিনি সেটা করলেন, কিন্তু শেষ লগ্নে। অভিষেকের জায়গায় নেমে হরমনজ্যোৎ সিংহ খাবরা চোয়ালচাপা যুদ্ধটা চালালেন ঠিকই, কিন্তু ওভারল্যাপে গিয়ে মোগাদের জন্য ক্রস বেরোল না তাঁর পা থেকে।
নিট ফল আর্মান্দোর আই লিগ অভিযানের রাস্তায় কিছুটা কাঁটা বিছিয়ে দিয়ে গেলেন সুভাষ ভৌমিক। তাঁর চেয়েও বড় আশঙ্কা ধেয়ে এল। টিম স্পিরিট নিয়ে। মাঠ ছাড়ার আগে ইস্টবেঙ্গল কোচ বলে গেলেন, “ড্রেসিংরুমে কমফোর্ট নেই।” ম্যান-ম্যানেজমেন্টে দক্ষ কোচ (নিজেকে এ ভাবেই শংসাপত্র দেন আর্মান্দো) যদি এমন কথা বলেন, তা হলে ধরে নিতে হয় সমস্যা বাড়ছে। ‘প্রতিষেধক’ বার করতে কোচ-কর্তারা যত তাড়াতাড়ি সচেষ্ট হন, টিমের ততই মঙ্গল। |
ইস্টবেঙ্গল: গুরপ্রীত, অভিষেক (খাবরা), অর্ণব, গুরবিন্দর, রবার্ট, তুলুঙ্গা, মেহতাব, সুয়োকা (কেভিন লোবো), লালরিন্দিকা (লেন), চিডি, মোগা। |